ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || আফ্রিকার ডায়েরি- ৪ – সুব্রত সরকার

(মাসাইমারা ন্যাশনাল পার্ক, সাভানার ল্যান্ডস্কেপ, সানসেট গেম ড্রাইভ…)
মাসাইমারার AA Mara Lodge এ লাইন দিয়ে সুন্দর সুন্দর সব কটেজ। আমরা তেমন এক থ্রি বেডের কটেজ পেয়েছি। ব্যবস্থা বেশ ভালো। সঙ্গে বসে গল্প করার মত একটা বারান্দাও আছে। ঘরে তিনটে খাট। তিনটে খাটেই দারুণ সুন্দর ধবধবে সাদা মশারি এমন করে ঝুলিয়ে সাজিয়ে রাখা রয়েছে দেখেই ভালো লাগা তৈরী হয়। এই মশারিগুলো আমাদের দেশের মত একদমই নয়। ভীষণ অন্যরকম, আর্টিস্টিক মশারি। আফ্রিকায় সর্বত্র মশারি টাঙিয়ে ঘুমোতে হয়। তার কারণ পোকা- মাকড় ও মশা-মাছি থেকে সাবধান। ইয়োলো ফিভার ইনজেকশন যতই তুমি নিয়ে আসো না কেন!.. মশারিহীন মস্তানি নৈব নৈব চ!..আফ্রিকার কুখ্যাত সেৎসি মাছির গল্প অনেক শুনেছি। সুতরাং সুন্দর মশারিগুলো টাঙানো আছে দেখে ভালোই লাগল।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনজনে তৈরী হয়ে নিলাম। মাসা, মাইকেলও রেডি। আমাদের সবার জন্য প্যাকড্ লাঞ্চবক্স গাড়িতে তুলে নিয়েছে মাসা। জলের বোতলও দেখলাম যথেষ্ট। গেম ড্রাইভে লাঞ্চ জঙ্গলের আবহে বসে খেতে হয়। এটাও একটা অন্যরকম ভাইভস্। ল্যান্ড ক্রুজারে চক্কর মারতে মারতে আফ্রিকার আইকনিক ওয়াইল্ড লাইফ দেখো, ছবি তোলো, চোখ মন জুড়িয়ে নাও আর ধূ ধূ সাভানার প্রান্তরে বসে ভোজন করো মহানন্দে। গেম ড্রাইভের লাঞ্চ বক্সগুলোয় সুন্দর সুন্দর খাবার থাকে। তুমি হয়তো চিকেন বা পর্কে কামড় দিয়ে বার্গার খাচ্ছো, তখন হয়তো অদূরেই কোনও সিংহ মহারাজ থমসন গ্যাজেল শিকার করে বেশ রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছেন!.. টাইমিং এক। ভেনু এক। মেনুও প্রায় এক!.. কালিদা, তুমি তো আফ্রিকায় এখন!..
AA Mara Lodge থেকে মাসাইমারা ন্যাশনাল রিজার্ভ পার্ক খুব দূরে নয়। পথের হিসেবে দু-তিন কিমি হবে। লজটা এক পাহাড়-জঙ্গলের নির্জনতায়। গা ছমছমে ভাব আছে। লজ থেকে বেরিয়ে আমাদের ল্যান্ড ক্রুজার সবে রাজপথে উঠবে, ডুলুং হঠাৎ বলে উঠল.. ‘জেব্রা জেব্রা!..’
চোখ ঘুরিয়ে দেখি পথের ধারের ঝোপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটা জেব্রা আপনমনে ঘাস খাচ্ছে। এমন খোলা প্রকৃতির মাঝে এত কাছ থেকে জেব্রা দেখার একটা আনন্দ ও মজা আছে। শুরুটা ভালোই হলো!..
মারা ল্যান্ড ক্রুজারকে ছোটাতে ছোটাতেই গল্প করছে। মারা কথা না বলে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না! আর খুব উইটি। মজার মজার কথাও বলে। নিজের দেশ কেনিয়া নিয়ে খুব পজেসিভ। মাসার কাছে আফ্রিকার সেরা দেশ হলো ওর নিজের দেশ কেনিয়া। এমন দেশভক্ত যুবককে ভালো না বেসে থাকা যায়!..
গাড়িতে যেতে যেতে পথের ধারে কয়েকটা মাসাই ভিলেজ চোখে পড়ল। মাসাইদেরও দেখলাম। কেউ কেউ ঘরের কাজ করছে। মাসাই রাখালরা গরু-ছাগল চরাচ্ছে। মাসাই বাচ্চাগুলো খেলছে। ডেভিডরা হয়তো এমনই কোনও এক গ্রামে থাকে। লজে চলে এসে কেমন আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে চায় পর্যটকদের ওদের গ্রামে। ব্যাপারটা বেশ ভালো।
মাসাইমারা পার্কের গেটের কাছে এসে গাড়ি থামল। মাসা গেটে গেল টিকিট কাটতে। এই ফাঁকে ছুটে এলো মাসাই মাসি-পিসিরা। ওরে বাবা, কি বকবকম!..ওদের সবার হাতে হাতের কাজের হরেক সম্ভার। “টেক ইট। টেক ইট। গুড পাইস। গুড পাইস। পোমোট মি। পোমোট মি! ” নাও। নাও। দাম একদম ঠিক। আমাকে উৎসাহ দাও।” এই সব বুলি বলেই চলেছে। ওদের সবার কাছে রঙিন পু্ঁতির সুন্দর সুন্দর জিনিস, মাসাই চাদর, চাবির রিং, ঘর সাজানোর মাসাই শিল্প কর্ম রয়েছে। আমরা সবে জঙ্গলে গেম ড্রাইভে ঢুকব। এখন নো মার্কেটিং। পরে করব যতই বলি শোনে না মাসাই মাসি-পিসিরা!..মাসা এসে উদ্ধার করে। সোয়াহিলি ভাষায় একটু বকা-ঝকা করল মনে হয়। তারপর দেখি মাসি-পিসিরা একটু অভিমানী সুরে বলল, “ওকে ওকে। গো। গো। হাকুনা মাটাটা!…”
মানে হলো, “ঠিক আছে। যাও তোমরা। নো প্রবলেম- হাকুনা মাটাটা!..”
আমাদের ল্যান্ড ক্রুজার ধীরে ধীরে গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। কেমন একটা যেন অনুভূতি হলো- আমি মাসাইমারায় ঢুকছি!..সেই মাসাইমারা!.. কতদিনের স্বপ্নের অধরা মাসাইমারা!..
সোনালী সাভানা ঘাসের বুক চিরে পথ চলে গেছে জঙ্গলের নানাদিকে। কি অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ।
জঙ্গলের পথ ইট-পাথর দিয়ে বানানো। গেম ড্রাইভের গাড়ি এপথ ধরেই ছুটতে শুরু করল। গাড়ির ছাদ তুলে দিয়েছে মাসা। আমরা তিনজনই দাঁড়িয়ে পড়লাম তিনদিকে। একদম অ্যাডভেন্চার ট্রিপের আনন্দ। অসীম অনন্ত মনে হচ্ছে মাসাইমারাকে। চোখের দৃষ্টি বহুদূরে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছাতার মত গোল আকাশিয়া গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছগুলোর আরও একটা নাম হলো – ইয়োলো ফিভার ট্রি।
ল্যান্ড ক্রুজার ছুটতে ছুটতে কিছুটা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল, মাসা ফিস ফিস করে বলল, “জিরাফ! জিরাফ! ”
আমরা মুগ্ধ হয়ে তখন দেখছি এক জিরাফ দম্পতি আমাদের গাড়ি থেকে বড় জোর দশ পনেরো হাত দূরে। বড় অপূর্ব এক দৃশ্য। চোখের দেখায় দেখলাম, মোবাইল ক্যামেরায় ছবিও নিলাম। আমরা তিনজনের কেউই বিরাট ক্যামেরা নিয়ে আসি নি। সে সব ক্যামেরায় এসব ছবি নিশ্চয়ই দারুণ হয়। আমরা মোবাইল ক্যামেরাতেই এই সব মুহূর্তগুলো বন্দী করে রাখছি।
এমন লম্বা গলা জিরাফ সেই কবে চিড়িয়াখানায় শেষ দেখেছিলাম, আজ এত বছর বাদে খোদ আফ্রিকায় এসে মাসাইমারার জঙ্গলের ধূ ধূ প্রান্তরে তাদের মনের সুখে চরে বেড়াতে দেখে বেশ লাগল। সত্যিই বন্যেরা বনে সুন্দর!..
ওয়াকিটকিতে সমানে সোয়াহিলি ভাষায় ইনফর্মেশন আসছে। মাসাও সেই মত গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটছে। এভাবেই ছুটতে ছুটতে একের পর এক বন্যপ্রাণ দেখতে শুরু করলাম। এমন আদিগন্ত সাভানার প্রান্তরে পশুপাখিরা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়ে যায়। থমসন গ্যাজেলের একটা দলের কাছে গিয়ে মাসা গাড়িটাকে স্লো করে দিল। মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ওদের ছুঁয়ে ফেলতে পারব। থমসন গ্যাজেল বেশ নিরীহ প্রাণী। হরিণের মত দেখতে খানিকটা। সিংহ মহারাজদের প্রিয় খাবার এই সব গ্যাজেলরা।
এবার দেখা পেলাম বিগ ফাইভের একজনকে- কেপ বাফেলো। ব্যাটা ভুরি ভোজ করে
রেস্ট নিচ্ছে মনে হল। মাসা একদম ওর মুখোমুখি গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। কেপ বাফেলোরা খুব ডেঞ্জারাস হয় শুনেছি। স্বয়ং সিংহ মহারাজও ওদের ভয় পায়। সেই কেপ বাফেলো এখন আমাদের গাড়ি থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। দেখতে একদমই সুশ্রী নয়। মোষের চেয়েও কালো, একটু বেঁটে, মাথায় মোটা মোটা দুটো শিং ও বেশ বলশালী চেহারা। ছবি তুললাম অনেকগুলো। ওর কোনও ভ্র’ক্ষেপ নেই।
আবার এগিয়ে চলেছি। সাভানার প্রান্তরে আরও অনেক গাড়ি গেম ড্রাইভে ছুটে বেড়াচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার নীল। সূর্য মধ্যগগন থেকে সামান্য টাল খেয়ে হেলে পড়েছে পশ্চিমে। এখনো আমাদের তেমন খিদে পায় নি। মাসা বলল, “তোমরা যখন লাঞ্চ করতে চাইবে বলবে।”
বহুদূর থেকে এবার হাতির দেখা পেলাম। একটা দুটো নয়। দলবদ্ধ হাতি। মাসা বলল, “চলো ওখানে যাই। ”
ল্যান্ড ক্রুজার ছুটতে ছুটতে চলে এলো হাতির দলের কাছে। এই ব্যাপারটা দারুণ। বন্যপ্রাণের পাড়ায় বেড়াতে এসে ওদের প্রায়
গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখো। ওরা বিরক্ত হয় না। তেড়ে আসে না। লাফ মারে না। চিৎকার করে না। বকাও দেয় না!.. “তুমি এসেছো। বেশ তো। দেখো। ছবি তোলো। চলে যাও। আমাদের বিরক্ত কোরো না!..”
হাতির দলের ছবি মনের সুখে তুললাম। হাতি দেখার মধ্যে বেশ একটা বিরাট কিছু দেখার আনন্দ ও গর্ব অনুভব হয়। আমাদের নর্থ বেঙ্গলের জঙ্গলে খুব সামনে থেকে বহুবার হাতি দেখেছি। হাতিদের ভয়ংকর সব গল্প শুনেছি। আফ্রিকার হাতি দেখেও বেশ লাগল। শুনেছি অ্যাম্বোসেলির হাতির আয়তন হয় বিরাট বিরাট। ওদের কান ও চেহারা বিশাল হয়। আমরা পরে যাব অ্যাম্বোসেলিতে। এখন মাসাইমারার জঙ্গলের হাতি দেখে চোখ সার্থক করছি।
এবার একজোড়া চমৎকার পাখি দেখলাম। ক্রাউন বার্ড। ওদের মাথার ঝুঁটিটা মুকুটের মতই। ওরা দুজনে দুজনে ঘুরে বেড়ায়। প্রেম করে। গল্প করে হেসে খেলে দিন কাটায় জঙ্গলে।
এবার লাঞ্চ ব্রেক ঘোষণা হলো। মাসা সুন্দর একটা গাছের ছায়ায় নিয়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো। দেখলাম মাইকেল নেমে চারপাশটা ভালো করে দেখছে। ঘাসগুলোকে পরখ করছে। খুব নিখুঁত পর্যবেক্ষণ। তারপর চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাছের ডালগুলো দেখে নিয়ে বলল, “প্লিজ কাম ডাউন!”
আমরা তবুও কেমন ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। মাসাইমারার জঙ্গলে প্রথম পা ফেললাম। মনে মনে প্রণাম জানালাম মাসাইমারার মাটিকে। হে পুণ্য, হে মহান অরণ্য, আমি সেই কোটি কোটি সৌভাগ্যবানদের একজন, সামান্য এক মুসাফির, যে স্বপ্ন দেখেছিল, স্বপ্নকে লালন করে রেখেছিল, আজ সেই স্বপ্ন ছোঁয়া আনন্দে এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছি তোমার মহারণ্যে, তোমাকে প্রণাম!..
অরণ্যের নির্জনে মধ্যাহ্নভোজন শুরু হলো। খাচ্ছি কিন্তু চোখ সতর্ক, চারপাশ বারবার দেখে নিচ্ছি। প্যাক্ড লাঞ্চ বক্সে অনেক খাবার। পেট ভরানোর জন্য যথেষ্ট। স্যান্ডউইচ, চিকেন রোস্ট, ডিম সেদ্ধ, কেক, কলা, আপেল, চকলেট ও ফ্রুট জুস। পৃথিবীর এক বিখ্যাত জঙ্গলে বসে এভাবে প্রিয়জনদের সঙ্গে লাঞ্চ করার মুহূর্তগুলো তো জীবন থেকে পাওয়া বড় দামী উপহার। দু’হাত পেতে নিতে শিখেছি এই মহার্ঘ্য উপহার। আজও কৃতজ্ঞ চিত্তে তা গ্রহণ করে হৃদমাঝারে রাখলাম। ভুলে যাব না কোনওদিন!..
গেম ড্রাইভ আবার শুরু হল। মাসা নিয়ে চলেছে নতুন নতুন জঙ্গলের পথে। মাসাইমারার এই আদিগন্ত ধূ ধূ অরণ্যেরও অপরূপ এক সৌন্দর্য মনকে বারবার মুগ্ধ করে। এবার দেখা পেলাম হায়নার। তিনটে হায়না শিকারের খোঁজে রয়েছে। এরা খুব ধূর্ত হয়। এদেরকে জঙ্গলের পশু পাখিরা এড়িয়ে চলে। দেখতে ভালো না। জানি না ওদের এই ধূর্ত স্বভাবের জন্যই কিনা ওরা সুশ্রী চেহারার হতে পারে নি!..
ঘুরতে ঘুরতে এবার একদঙ্গল জেব্রার মুখোমুখি। একসঙ্গে এতগুলো জেব্রাকে দেখার বেশ একটা মজা আছে। মাসা বলল, জেব্রার সাদা- কালো ডোরাকাটা দাগগুলো আসলে কালোর ওপর সাদা সাদা দাগ কাটা। জেব্রাকে বেশ সুন্দর দেখতে লাগে। ছবি তুলেও মজা পাওয়া যায়।
ওয়াকিটকিতে কোনও খবর এলো, মাসা ল্যান্ড ক্রুজারকে ছোটাতে শুরু করল হঠাৎ, সোহম জানতে চাইল, “মাসা, এনি নিউজ?”
“ইয়েস, কিং ইজ স্লিপিং!..” মাসার মস্করা শুনে হাসলাম।
জঙ্গলের রাজা ঘুমিয়ে আছেন। তার খবর চলে এসেছে ওয়াকিটকিতে। আমরা ছুটছি সেই ঘুমন্ত সিংহ মহারাজকে দেখতে। এই মুহূর্ত গুলো খুব এনজয় করার। ভীষণ থ্রিলিং। মনে মনে খুব রোমাঞ্চ অনুভব হয়।
সত্যিই অবাক করার মত দৃশ্য, বেশ বড় সাইজের এক সিংহ মহারাজ কেমন দিব্যি সোনালী সাভানার শয্যায় পরম সুখে দিবানিদ্রা দিচ্ছেন। তাকে ঘিরে অন্তত দশ বারোটা ল্যান্ড ক্রুজার স্টার্ট বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। সব গাড়িতে পর্যটকরা রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কাটাচ্ছেন, কখন তাঁর ঘুম ভাঙ্গার মুহূর্তটা আসবে, একটা অসাধারণ ছবি পাওয়া যাবে। যা সারাজীবনের সেরা উপহার হয়ে থাকবে। মাসা খুব কায়দা করে আমাদের গাড়িটাকে এমন জায়গায় প্লেস করল, ঘুমন্ত মহারাজকে পুরো দেখতে পেলাম। একদম লেজ থেকে মুখমন্ডল সবটাই দেখলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। এমন বিশাল এক খোলা প্রকৃতির মধ্যে স্বাধীন সুন্দর সুস্বাস্থ্য নিয়ে পশুরাজ ঘুমিয়ে আছেন, আমি মাত্র কয়েকহাত দূর থেকে তাকে দেখছি, দেখেই যাচ্ছি- এ যে কত বড় আনন্দ তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়!
একসময় হঠাৎ দেখি কোথা থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি চলে এলো। তাঁরা সবিনয়ে বললেন, “আপনারা এবার এ জায়গা ছেড়ে চলে যান।” অনেক গাড়ির ভিড়ে সিংহ মহারাজের ঘুম ভেঙ্গে যাক, সেটা তাঁরা চাইছেন না। ওদের এমন সুখনিদ্রা ভঙ্গ হোক – এই না চাওয়াটাকে এত মর্যাদা দেওয়া হয় দেখে খুব আনন্দ পেলাম। আমাদের গাড়িগুলো একে একে জায়গা ছেড়ে চলে গেল অন্যপথে। মহারাজ তখনও সোনালী শয্যায় চমৎকার কুম্ভকর্ণ হয়ে রয়েছেন!.তোমার দেখা পেলাম, তোমার চোখের তারা দেখা হলো না!.এই না দেখা গুলোও কখনো কখনো দেখার চেয়েও অনেক বেশি দামী স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় জীবনে!..
গেম ড্রাইভে ছুটে বেড়ানোর একটা মজা আছে। এত বড় অরণ্যে, চারপাশের পাহাড়শ্রেণীর ঘেরাটোপে, সোনালী সাভানার সৌন্দর্যে শুধু ঘুরে বেড়ানোটাও একটা অপূর্ব ভ্রমণ।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে অনেক বন্যপ্রাণ দেখা তো হয়ই। বারবারও দেখা হয়ে যায় ওদের সঙ্গে। দিন শেষের দিকে গড়াচ্ছে। আকাশ রক্তিম আভা নিয়ে সেজে উঠেছে। আমরা তৃপ্ত। খুশি মাসাইমারার প্রথমদিনের গেম ড্রাইভে। বিগ ফাইভের মধ্যে আজ দেখা পেলাম লায়ন, এলিফ্যান্ট, কেপ বাফেলো। বাকি রইল লেপার্ড ও রাইনো। মাসা বলল, আজ ওদের দেখা না পেলেও তোমরা এই সফরে ওদের দেখা পেয়ে যাবে। লেপার্ড দর্শন নাকি ভাগ্যের ব্যাপার।
ওয়াকিটকিতে আবার খবর এলো সোয়াহিলি ভাষায়। আমরা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু মাসা দেখি গিয়ার চেঞ্জ করে তখনই ছোটাতে শুরু করল ল্যান্ড ক্রুজারকে। পৌঁছে গেলাম জঙ্গলের আরেকপ্রান্তে। গিয়ে দেখি বিশাল লম্বা গাড়ির ভিড়। মাসা আমাদের গাড়িটাকে নিয়ম মেনেই পেছনে দাঁড় করাল। এ যেন পুজোর ভিড়ে ঠাকুর দেখার লাইনের মত। তফাৎ শুধু পরিবেশের। এখানে জঙ্গলের আবহে সবাই চুপ, শান্ত হয়ে আছি। কারণ এখনই দেখতে পাব এক সদ্য হান্টিং করা দৃশ্য!..চিতার বনভোজন। সে একটু আগেই এক গ্যাজেলকে বধ করে রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছে! সত্যিই তাই। খানিক অপেক্ষার পর আমরা যখন তার মুখোমুখি হলাম চিতার সারা মুখে তাজা রক্তের ছোপ। মাড়িগুলো সচল। মৃত আধখাওয়া হতভাগ্য গ্যাজেলটা মাটিতে পড়ে রয়েছে। চিতার পরিতৃপ্ত চোখ মুখের ছবি তোলা হলো। শিকার সহ এমন খাদ্য ও খাদকের ছবি খুব দামী তো বটেই, গল্প করার মত বিষয়ও! এখানেও দেখলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি পাহারা দিয়ে সবাইকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য এই দুর্লভ দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেখেই সরে যেতে হচ্ছে সেই স্থান থেকে। কারণ চিতার এই খাওয়াকে গ্লোরিফাই করার মত মজাদার ইভেন্ট সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে যাক, সেটা তারা বেশ দায়িত্ব ও যত্ন নিয়ে করে বলেই মাসাইমারা আজ গ্রেট মাসাইমারা হয়েছে!..
সূর্য এবার ডুবু ডুবু। আজকের মত সানসেট ড্রাইভ প্রায় শেষ। একবেলার এই বনভ্রমণ মন ভরিয়ে দিয়েছে। আমি তো বন্যপ্রাণ দেখার চেয়েও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছি মাসাইমারার প্রকৃতিকে। আহা!.. কী অপূর্ব সুন্দর এই সাভানার প্রান্তর।
গেটের দিকে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আগামীকাল সকাল থেকেই আবার শুরু হবে দ্বিতীয় দিনের গেম ড্রাইভ।
শরীর একটু ক্লান্ত ছিল, চোখ শান্ত। এমন সময় হঠাৎ মাইকেলের আর্তনাদ, “লুক, লুক। দ্যাটস এ বিগ এলিফ্যান্ট!..”
বিশাল একটা হাতি আমাদের গাড়ির সামনে তখন। গজদন্ত দুটো তরোয়ালের মত বাঁকানো সুন্দর। মাসা গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছে। হাতিটা রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে।
সূর্যাস্তের আকাশ আরও রক্তিম হয়ে গেছে। সন্ধ্যা আসন্ন। আমরা ফিরে যাব। গেট আর সামান্য দূরে। এমন এক সময় সে যেন পথ আটকে বলছে, “যেতে নাহি দিব!..”
ক্রমশ…
খুব উপভোগ্য বর্ণনা।
Very enchanting narrative!