অণুগল্পে সুব্রত সরকার

অদলবদল

শিবু মাড্ডির মাঠভরা পাকা ধান চোখের নিমেষে খচ খচ করে কেটে সাবাড় করে দিল মেশিন। দানবের মত শক্তিধর মেশিনটা পাক খেয়ে খেয়ে অত বড় জমির সব ধান নিমেষে কেটে ফেলল। শিবু গামছা দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে হাসছে। বড় তৃপ্তির হাসি। একটু দূর থেকে হলেও স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ব্রতীন শিবুর সেই চাপা হাসি দেখতে পেল।

 

নতুন ধান কাটা হয়ে গেল !.. এবার শুরু হবে ঘরে ঘরে নতুন ধানের উৎসব – নবান্ন। কিন্তু ওরা কেমন সুন্দর হেসে হেসে বলে, ‘নবান’, কেউ বলে ‘লবান’! গ্রাম ধরে ধরে আলাদা আলাদা দিনে এই’ নবান’ বা ‘লবান’ হয় এই অঞ্চলে। তখন ব্রতীনেরও নেমন্তন্ন থাকে!…

 

মেঠো পথ দিয়ে একটা বউ হন হন করে হেঁটে আসছে। আদিবাসী বউ তো মনে হয় না। কিন্তু হাঁটার গতিতে আদিবাসী মেয়েদের মতই ক্ষিপ্রতা।

 

স্কুলের চাতালে বসে শীতের আলতো রোদে ব্রতীন খবরের কাগজ পড়ছে। জেলার পাতাটায় চোখ। স্কুলের গেট খুলে ধীর পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল সেই বউ,” দাদা, ভালো আছেন?”

“আছি। তোমরা কেমন আছো? তোমার শ্বশুরের ভাঙ্গা পা ঠিক হয়েছে?”

“অল্প অল্প হাঁটছে উঠোনে।”

“আবার চেক আপ কবে?”

“সামনের মাসে নিতে বলেছে ডাক্তারবাবু।”

“নিয়ে যেও। দেখিয়ে আনবে কিন্তু।”

 

বউটা এবার আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে, “দাদা, আমার ছেলের তো ছ’বছর হল। ওকে সরকারী স্কুলে ভর্তি করে দেব। আর আপনার স্কুলেও পাঠাব। ওর নামটা লেখাতে এসেছি।”

ব্রতীন চেনে এই মহিলাকে। ওর মেয়ে মালতী পড়ে ব্রতীনের বিনি পয়সার পাঠশালায়। তাই মালতীর মাকে বলল, “কিন্তু আমরা তো এবার একটা নিয়ম করেছি, এবছর থেকে এক পরিবারের দুজনকে নেব না। “

“হ্যাঁ দাদা শুনলাম। কিন্তু!.. “

“আমরা তো চাই সবাইকে একটু পড়ার সুযোগ করে দিতে। সাঁওতাল পাড়ায় এখনো অনেক বাচ্চা রয়েছে। ওদেরও তো নিতে হবে। তাই সব পরিবার থেকে একটা করে বাচ্চা পড়বে। আর তো আগের মত পারব না। এখন অনেক ছাত্র ছাত্রী বেড়ে গেছে।”

“দাদা, একটু দেখুন.. আপনার স্কুলে পড়লে ওরা অনেক কিছু শিখতে পারে…”

“তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা তো এবার নিয়মটা করেছি, এত দায়িত্ব নিতে পারব না ভেবে…”

“দাদা, ওকে টিফিন দেবেন না।”

“তা হয় নাকি?”

“ওকে জামা, জুতো, ব্যাগ দেবেন না।”

সবাইকে দেব, ও পাবে না। সবাই টিফিন খাবে, ও না খেয়ে বসে থাকবে তা হয়!..”

“দাদা, একটা কথা বলব,..”

“নিশ্চয়ই। বলো…”

“মালতীর তো মাথা ভালো না। কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না।..

“না না। এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো হয়েছে। ছবিও তো আঁকছে সুন্দর।”

“দাদা, আমরা তো গরীব ঘর।  মেয়েকে বেশি পড়াতে পারব না। টেনেটুনে যতটুকু হয় হবে। বিয়ে দিয়ে দেব। বরং ছেলেটা পড়ুক। ওর বাবা তো টোটো চালায়। আয় বেশি হয় না।”

“ছেলেকে অন্য কোথাও পড়াও।”

” দাদা,আপনার কাছেই পাঠাতে চাই আমরা।”

“না গো। এবার আর হবে না। নিয়ম ভাঙলে স্কুল চালাতে অসুবিধা হবে।”

 

মহিলা ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। বারবার শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছছে। ব্রতীন খুব অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ” তুমি, কাঁদছো কেন? জিনিসটা বুঝতে হবে তো।”

মহিলা কান্না চেপে এবার বলল, “দাদা, মালতীকে আর পাঠাব না। ও বাড়িতে পড়বে। আপনি ওর বদলে আমার ছেলেটাকে ভর্তি নিন!..”

“মানে!…” ব্রতীন হাতের খবরের কাগজ গুছিয়ে রেখে বলল, “তোমার মেয়েকে ওয়ান থেকে এই থ্রি পর্যন্ত পড়িয়ে শিখিয়ে বড় করে তুললাম। মেয়েটা এখন পড়তে পারছে। ছবি আঁকছে। তুমি ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে চাইছো!..”

“কি করব দাদা, একজনের বেশি আপনি  তো পড়াবেন না!..”

“তাই বলে, মেয়ের বদলে ছেলে!”

 

মহিলা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্রতীন একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কিছুটা রাগ, আর কিছুটা হতাশা থেকে বলে, “তুমি একজন মেয়ের মা হয়েও এমন ভাবতে পারলে!.. “

 

মালতীর মা স্কুলের গেট খুলে চলে যাচ্ছে। ব্রতীন কয়েকমুহূর্ত খুব অস্থির হয়ে থাকল। ভীষণ একটা কষ্ট হচ্ছে বুকের পাঁজরে। স্কুলের মধ্যে শিশুদের কলরব। ব্রতীন সেই কলরবে ডুবে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল একটা ক্লাসের কাছে, সেই ক্লাসে মালতী বসে আছে। লক্ষ্মী কিস্কু পড়াচ্ছে। মালতীর চোখ কালো বোর্ডটার দিকে। দিদিমণি লিখছে বোর্ডে, মালতী লিখছে খাতায়। কি সুন্দর পড়ছে মন দিয়ে মালতী।

এই মালতীকে ওরা আর পাঠাবে না বলছে!..

মালতীর বদলে ওর ভাইকে পাঠাতে চায়!..

হায়!..কি সহজ অদলবদল এর ভাবনা!..

 

শিবু মাড্ডি সব ধান কেটে মাঠ শূন্য করে হাসি মুখে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ব্রতীন বিষন্ন হৃদয়ে আনমনে সেদিকে চেয়েই রইল!..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।