• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে সিদ্ধার্থ সিংহ

আব্বুলিশ

মেঝের উপরে শতরঞ্চি পাতা। তার উপরে গোল করে বসে চোর-পুলিশ খেলছে চার বন্ধু। তাদের একজন, দু’হাতের মুঠোয় ঝাঁকিয়ে চার ভাঁজ করা কাগজের টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিতেই, ওরা প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিল এক একটা কাগজ। আর, কেউ যাতে দেখতে না পায়, প্রত্যেকেই প্রত্যেককে আড়াল করে খুলতে লাগল সেই কাগজের ভাঁজ। যেই একজন দেখাল, তার কাগজে বড় বড় হরফে লেখা— চোর ।অমনি মুহূর্তের মধ্যে সূর্য উধাও। কিচিরমিচির করতে করতে ঝাঁক ঝাঁক পাখি দল বেঁধে ফিরতে লাগল বাসায়। একটা বাড়ির উল্টো দিকে অন্ধকারের মধ্যে বসে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে লাগল সে— কখন ওই বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়।
তার পাশের জন চুপিচুপি কাগজটা খুলে যখন দেখল, তার কাগজের টুকরোটায় লেখা— ডাকাত। অমনি তার সঙ্গে জুটে গেল ষণ্ডামার্কা কতগুলো ছেলে এবং বুক চিতিয়ে একটা ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়ল তারা। সোজা গিয়ে হাজির হল ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সামনে। তার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে সে বলল, চাবিটা দে।
তার উল্টো দিকে বসেছিলেন যিনি, তিনি কাগজটা খুলে যখনই দেখলেন, তাতে লেখা রয়েছে— মন্ত্রী। অমনি টানটান করে শতরঞ্চির উপরে সেই কাগজটা রাখলেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ডাঁয়ে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল কতকগুলো দেহরক্ষী। গাড়ির সামনে হুটার বাজিয়ে ছুটতে লাগল এস্কর্ট ভ্যান। মুখের সামনে জড়ো হল হাজার একটা টিভি চ্যানেলের বুম। এ জানতে চাই ওটা, সে জানতে চায় সেটা।
— আপনি কি জানেন গোটা দেশ এখন চোরে চোরে চেয়ে গেছে?
— আপনার কাছে কি এখনও খবর এসে পৌঁছায়নি যে, মধ্য শহরের একটা ব্যাঙ্ক এখন ডাকাতদের কবলে?
— চারদিকে যে ভাবে দুর্নীতি বাড়ছে, তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আপনারা কী কী করছেন?
একের পর এক প্রশ্ন। মন্ত্রী সব শুনলেন। তার পরে ডান দিকে একটু ঘাড় ঘোরালেন তিনি। তাঁর ঘাড় ঘোরানো দেখেই সচকিত হল সে। যে একটু আগেই তাঁর সঙ্গে খেলছিল। যার কাগজের টুকরোয় লেখা ছিল— পুলিশ। এবং ‘পুলিশ’ দেখেই সবার সামনে কাগজটা মেলে ধরেছিল সে। আর তার পরমূহূর্তেই পৌঁছে গিয়েছিল থানায়।
মন্ত্রী ইশারা করতেই সে তাঁর সামনে গিয়ে হাজির। মন্ত্রীর নির্দেশ দিলেন, যাও, এক্ষুনি গিয়ে ডাকাত ধরে নিয়ে এসো। মন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র পুলিশ ছুটতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতে সেই ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কের ভিতর থেকে দলবল নিয়ে তখন সবেমাত্র ডাকাতরা বেরোচ্ছে । পুলিশকে দেখেই, তারা তাদের লুট করা ব্যাগের ভিতর থেকে কিছু টাকার বান্ডিল ছুড়ে দিল তার দিকে। পুলিশ সেটা কুড়িয়ে নিল। টাকা পেয়ে সে মহাখুশি। থুতু দিয়ে টাকা গুনতে লাগল। গুনতে গুনতে সে ভুলেই গেল, কী জন্য সে এসেছিল। ততক্ষণে ডাকাত তার দলবল নিয়ে হাওয়া
খবরটা গিয়ে পৌঁছুল মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী তো রেগে কাঁই। সঙ্গে সঙ্গে তলব করলেন পুলিশকে।তলব পেয়েই, গত কাল ডাকাতদের ছুড়ে দেওয়া টাকার ক’টা বান্ডিল সুদৃশ্য মোড়কে মুড়ে ফেলল পুলিশ । তার পর সেটা নিয়ে সোজা মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী কিছু বলার আগেই সে সেটা রেখে দিল মন্ত্রীর টেবিলে। ওটা রাখতে দেখে, মন্ত্রী তাকালেন তার দিকে। চোখে চোখে কী কথা হল কে জানে! মন্ত্রী সেটা হাতে নিয়ে বললেন, থুড়ি, ডাকাত নয়, যাও, চোরকে গিয়ে ধরো।
পুলিশ ছুটল চোর ধরতে। তখন সকাল হয় হয়। মালপত্র বোঁচকা বেঁধে চোরটা তখন সে বাড়ির দরজা অল্প ফাঁক করে, চারদিক ভাল করে দেখে-টেকে নিয়ে, সবে পা রাখতে যাচ্ছে রাস্তায়, খপ্‌ করে তাকে ধরে ফেলল পুলিশ। — এই ব্যাটা চোর, পালাচ্ছিস কোথায়?
— না বাবু, পালাচ্ছি না।
— তবে?
— আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম হুজুর।
— আমার কাছে?
— হ্যাঁ হুজুর। এত মাল কি আমি একা নিতে পারি? এই নিন আপনার জিনিস। বলেই, চোরটা তার বোঁচকা থেকে এটা ওটা সেটা বার করে পুলিশটার হাতে ধরিয়ে দিল। তার পর যখন বোঁচকাটা তুলে কাঁধে নিতে যাবে, পুলিশটা তখন বোঁচকাটার দিকে একবার তাকাল, আর একবার তাকাল তার নিজের হাতে ধরা জিনিস গুলোর দিকে। তার পর বলল, মাত্র এইটুকু!
— আপনাকে অর্ধেকেরও বেশি দিয়েছি হুজুর ।
— নামা দেখি, আর কি আছে….
— হুজুর, আজকের দিনটা ছেড়ে দিন। সকাল হয়ে আসছে। কাল আপনাকে পুষিয়ে দেব…
— ঠিক বলছিস?
— জবান, জবান । ভদ্রলোকের এক কথা।
— ঠিক আছে। তা হলে মাথাটা একটু ম্যাসাজ করে দে। বড় ঝিমঝিম করছে… বলেই, একটা বাড়ির রকে বসে পড়ল পুলিশটা। চোর তার মাথায় ম্যাসাজ করতে লাগল। এ দিকে সকাল হয়ে এসেছে। লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। অনেকেই পুলিশটাকে চেনে চোরটাকেও চেনে। দু’জনের ওই কীর্তি দেখে লোকজন দাঁড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। এটা ওটা বলছে। এ দিকে, ম্যাসাজ নিতে নিতে আরামে দু’চোখ বুজে এসেছিল পুলিশের। হঠাৎ চোখ খুলে যেই দেখল, লোকজন দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা জটলা তৈরি হচ্ছে। তাদের দেখে কী সব বলাবলি করছে, অমনি, রে রে করে উঠল সে। এই, কী চাই? কী চাই এখানে? বলেই তেড়ে গেল।
মন্ত্রীর কাছে এই খবর পৌছতেও সময় লাগল না। তিনি ফের ডেকে পাঠালেন পুলিশটাকে। পুলিশটা এসেই মন্ত্রীর টেবিলের উপরে রাখল একটা টিফিন ক্যারিয়ার।
ওটা দেখেই মন্ত্রীর মনে হল, এই টিফিন ক্যারিয়ারটা নিশ্চয়ই সে দিন ওই বাড়ি থেকেই চোরটা নিয়েছিল! সে দিনই চুরি করেছিল, নকি অন্য দিন কে জানে! না হলে এটা এল কোথা থেকে!
— এটা কী? চোখমুখ কুঁচকে, নাক সিঁটকে প্রশ্ন করলেন মন্ত্রী।
— খুলেই দেখুন না স্যার। আপনার জন্য যৎসামান্য…
— কী? বলতে বলতে টিফিন ক্যারিয়াটার ঢাকনাটা খুললেন তিনি। কী রে এটা? পায়েস, না ক্ষীর!
— আজ্ঞে, যা বলবেন স্যার। আপনার বৌমা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।
মন্ত্রীর মুখ খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল। একটা আঙুল টিফিন কৌটার মধ্যে ঢুকিয়ে জিভে ঠেকালেন। — বাঃ, দারুন তো! তোর বউ তো খুব ভাল রান্না করে রে। মাঝেমধ্যে একটু আধটু খাওয়াতে পারিস তো…
ঠিক আছে স্যার, আনবোখ’ন। কিন্তু আমাকে তলব করেছেন কেন স্যার? যদি জানতে পারতাম …
— ঠিক আছে স্যার আনবখ’ন। কিন্তু আমাকে তলব করেছেন কেন স্যার? যদি জানতে পারতাম…
— তলব! কাকে!
— আমাকে স্যার।
— কে বলল?
— আপনার পেয়াদা স্যার।
— তাই নাকি? কবে?
— আজকেই সকালে স্যার।
— কী জানি, আমার তো মনে পড়ছে না! বলেই, টেবিলে রাখা অফিস বেলটা দু’বার বাজাতেই ঘরে ঢুকল পেয়াদা।
— কী রে, আমি কি ওকে তলব করেছিলাম?
— আজ্ঞে, হ্যাঁ হুজুর। ওই যে, চুরির মালের ভাগ নেওয়ার জন্য ওর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জমা পড়েছে…
— জমা পড়েছে বুঝি!
— হ্যাঁ হুজুর।
— চোপ। মন্ত্রীর চিৎকারে গোটা ঘর থরথর করে কেঁপে উঠল। ওকে দেখে কি মনে হয় ও চুরির মালের ভাগ নিতে পারে?
— আজ্ঞে, আপনি হুকুম করেছিলেন দেখেই স্যার…
— আমার কোনও হুকুম নেই। আব্বুলিশ।
‘আব্বুলিশ’ শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই সব উধাও। আবার সেই ঘরের মেঝে। আবার সেই শতরঞ্চি। আবার সেই চার বন্ধু। এবং আবার সেই চার ভাঁজ করা কয়েকটা কাগজের টুকরো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।