সাপ্তাহিক অণু উপন্যাসে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৯)

বনবাসের বর্ণমালা

নয়

চা-মোমো খাওয়া শেষ হতেই লিটুন দা আবার বললেন, “অমিত এবার গান শুরু কর।”
অমিত গান ধরল। বেশ ভারী রেয়াজি গলা। চড়ায় নামা ওঠা করছে দিব্যি। গানের কথা গুলো একদম ক্যাম্পের জন্যই লেখা, “আমরা এসেছি পাহাড়ে, পাহাড় আমাদের বন্ধু/ ও সবুজ বন, ও নীল আকাশ তোমরাও আমাদের বন্ধু…” অমিত প্রাণ ঢেলে গাইছে। বাকি বন্ধুরাও তালে তালে সুরে সুরে গেয়ে যাচ্ছে, “বছরে কয়েকটা দিন, হয়ে যাই দারুণ রঙিন/ ক্যাম্পের কোলাহলে, খুঁজে পাই নতুন কত বন্ধু।”
এমন গানে, গল্পে, আড্ডায় সময়টা বেশ কাটল। লিটুন দা এবার সদলবলে ফিরে যাচ্ছেন। আবার আসবেন সামনের সপ্তাহে। তখন দেখা হবে। শুভ্র মনে মনে ভেবে রাখল, ওদের সাথে সোনাখাঁয় ও আবার যাবে। কটা দিন ওখানে থেকে এলে হয়। সুদেব খুশিই হবে। এবার গেলে একদিন ট্রেক করে সুদেবের সাথে ওই ন্যাড়া পাহারটার চূড়ায় উঠবে। চুই চুই নদীর জলে চান করবে। জঙ্গলের আরও গভীরে নিয়ে যাবে বলেছিল সুদেব। সেসব ঘুরে বেড়িয়ে দেখে নেবে।
মনমাতিয়ার ভিক্টোরিয়ার সাথেও দেখা হবে! ওর বানানো সুন্দর ভেজ মোমো আবার খেতে পারবে। ওর সাথে দুটো গল্প করা যাবে। ভিক্টোরিয়ার মধ্যে বেশ একটা আকর্ষণ আছে। ভালো লাগে ওর কাছে গেলে। এ নিছকই একটা অন্য রকম ভালোলাগার অনুভূতি। কিন্তু এই অনুভূতিটা খুব দামী শুভ্রর কাছে! ভিক্টোরিয়া সেদিন কেমন দ্বিধা নিয়ে বলেছিল, “লোকডাউন কেয়া চিজ হ্যায় স্যার?”
সেদিন শুভ্র একদমই বুঝতে পারে নি, ভিক্টোরিয়া যে এই লকডাউনের কথাই বলেছিল! তাই শুভ্র ওর এই কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্য কথায়, গল্পে চলে গিয়েছিল। এখন হাসি পাচ্ছে। সত্যিই সেদিন কল্পনায়ও ভাবা সম্ভব ছিল না বেড়াতে এসে এমন এক লকডাউনের অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়বে। দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি যে ভ্রমণে এমন বিভ্রাট অপেক্ষা করেছিল জীবনে!
শুভ্র লিটুনদা’দের বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা পাহাড়ের পথে গান গাইতে গাইতে জঙ্গলের সবুজে হারিয়ে গেল! আজকের সকালটা বেশ অন্য রকম কাটল। এবার আরাধনাও চলে যাবে। যাবার আগে কেমন অভিমান করে বলল, “হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ গুলোর রিপ্লাই পাই না কেন?”
শুভ্র লাজুক হেসে বলল, “মেসেজ গুলো খুব সুন্দর। পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু কি যে উত্তর দেব বুঝতে পারি না!”
“ভেরি ব্যাড এক্সকিউজ!” আরাধনা একটু বিরক্ত হয়েই বলল।
শুভ্র হেসে প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলল, “এখানে নাকি একটা ফোর্ট আছে? এখন একদম রুইন্ড হয়ে পড়ে রয়েছে!”
আরাধনা উৎসাহিত হয়ে বলল, “ইয়েস। আমরা বলি পুরানা কিল্লা। ইট ইস অ্যান এনশিয়েন্ট ফোর্ট! আপনার ভালো লাগবে। ড্রয়িং করতে পারবেন।”
“এখান থেকে কতদূর?”
“যাদা নেহি। বাট দা রোড ইজ ভেরি অ্যাডভেঞ্চারাস। আপনি যাবেন দেখতে? আমি নিয়ে যাব। ওটা আমার ফেভারিট প্লেস।”
ঠিক হলো আরাধনার সাথে একদিন ফোর্ট দেখতে যাবে শুভ্র। ব্রিটিশ আমলের তৈরি এই কেল্লায় গোরা সৈন্যরা তখনকার দেশীয় রাজা-প্রজাদের বন্দী করে রেখে খুব অত্যাচার করত। তাই নাকি কেল্লায় ছোট ছোট অনেক কুঠুরি আছে। এই ঐতিহাসিক কেল্লার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে অতীতের অনেক দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। সেই অতীতের গল্পগুলো আরাধনা জানে। ওর বাবার কাছে সব শুনেছে। ভালোই হল কেল্লা ভ্রমণে একইসাথে অতীত দর্শন ও ইতিহাসের অজানা গল্প শোনা হয়ে যাবে। আর সত্যিই তো কিছু স্কেচ করে নিয়ে আসলে তা সারা জীবনের এক অমূল্য নথি হয়ে থাকবে!
আরাধনা খুব খুশি মনে ফিরে গেল। হরি দা, টিনা ভাবী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেলা গড়িয়ে গেছে অনেকটা। কিন্তু এই পাহাড়ে তা বোঝার উপায় নেই। ছায়া ছায়া মনোরম এক পরিবেশ এখন। শুভ্র নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে দোতলায় উঠছে। বারান্দায় পা দিতেই পকেটের মধ্যে রিংটোন বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল, মণিকুন্তলার ফোন। গত কয়েকদিন ওর সাথে আর কোনো কথা হয় নি। তাই একটু ভয়ে ভয়ে ফোনটা ধরে বলল, “হ্যাঁ রে বল, কেমন আছিস?”
“সারা জীবন আমিই শুধু বলব!” বড় অভিমানের মত শোনাল মণিকুন্তলার কথাটা। শুভ্র একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল, “বল কেমন আছিস?”
“একটা খবর আছে।”
“কি খবর?”
“জামাইবাবুর কোভিড পজিটিভ ধরা পড়েছে।”
“সে কি রে, এতো খারাপ খবর। এখন কি অবস্থা?” শুভ্র উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে।
মণিকুন্তলা শান্ত হয়ে বলল, “স্বাস্থ্য দপ্তরের গাড়ি এসে জামাইবাবুকে নিয়ে চলে গেছে। দিদি ও মান্তুকে হোম কোয়ারেন্টিনে চোদ্দ দিন থাকতে বলে গেছে। আর ওদের বাড়ি সিল করে দিয়েছে।”
“জামাইবাবুকে কোথায় নিয়ে গেছে?”
“জানি না।”
“সে কি রে! জানিস না কেন?”
“বলছি তো জানি না!”
শুভ্র বুঝতে পারে মণিকুন্তলা এবার বিরক্ত হচ্ছে। তাই কথা পাল্টে বলল, “আমি তো আরও উনিশ দিনের জন্য বন্দী হয়ে গেলাম!”
কথা বলে না মণিকুন্তলা। খুব চাপা একটা কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে শুভ্র। কি বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। কান্নার দমক বাড়ছে। শুভ্র অনেক কিছু ভাবছে, কিন্তু কোনো কিছুই বলতে পারছে না। তবু শেষ পর্যন্ত এটুকুই বলতে পারল, “কাঁদছিস কেন? কথা বল…”
“তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয় শুভ্র!” কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা ছেড়ে দিল মণিকুন্তলা।
ঘরে এসে শুভ্র আছড়ে পড়ল বিছানাটার ওপর। ওর বুকের ভেতর কেমন যেন এক কষ্ট শুরু হল। এমন তো আগে কখনো হয় নি! হঠাৎ মনে হল, কিছুই যেন আর ভালো লাগছে না। ফিরে যাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে পড়ল।
অনেক পরে অশান্ত মন নিয়ে শুভ্র ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই থাকল। শান্ত, নির্জন চারপাশ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। এই পাহাড়-জঙ্গলে নির্বাসিতের মত আরও উনিশ দিনের বনবাস পর্ব শুরু হল আবার। পৃথিবীর এই অসুখ কবে সারবে কেউ জানে না! এখন শুধুই অপেক্ষা…!
দু’চোখের সামনে অনন্ত সবুজ নির্জনতা। সেদিকে আনমনে চেয়ে থাকতে থাকতে শুভ্র ভাবছে, মণিকুন্তলা কেন এমন করে বলল, ‘তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয় শুভ্র’!…

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।