• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে শর্মিষ্ঠা সেন

অতিমারী এবং ভোট উৎসব

চোখের সামনে কোনো স্থানের চরিত্র‌ পরিবর্তন হতে দেখেছেন? গত একবছরে আমি কলকাতার অনতিদূরে এই ‘হ্যাপেনিং’ জমজমাট শহরতলিকে বেমালুম পাল্টে যেতে দেখলাম! না বাপু, নাম ধাম বলা যাবে না, ধরে নিন ‘পলাশতলী’।
তা এই পলাশতলী খুবই প্রাণ চঞ্চল এক শহর।‌ এখানকার মানুষেরাও ততোধিক উদ্দীপনা বুকে নিয়ে বাঁচেন। সম্বৎসর খেলা, মেলা, বসন্তোৎসব, পথনাটক, তেইশে জানুয়ারি, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল সন্ধ্যা, রথযাত্রা কাম পাঁপড় উৎসব, প্রভাতফেরী, স্বাধীনতা দিবস, রক্তদান, বস্ত্রদান, চক্ষুপরীক্ষা, নাগরিক সভা ইত্যাদি প্রভৃতি নানান কর্মকান্ডের ঘনঘটায় পলাশতলি সদাব্যস্ত। আপনি বলবেন এ তো গোটা বাংলার চিত্র! না বন্ধু, সবুর করুন, খোলসা করি। ধরুন, এলাকায় বিনামূল্যে চক্ষু পরীক্ষার ব্যাবস্থা হয়েছে। আয়োজক ‘পটারি ক্লাব’ এবং লোকাল কাউন্সিলার। এবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত আপনি শুনতে পাবেন ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’ এবং মানবদরদী কাউন্সিলরের ক্রমান্বয় গুণগান! না শুনে যাবেন কোথায়? আপনার বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোষ্টেই যদি চারমুখো করে চারটি চোঙা বাঁধা থাকে? শব্দের মাত্রা সহ্যসীমার মধ্যে থাকলে কি হবে? প্রস্তুত থাকুন মনোটোনাস একঘেয়ে রিদম্ এর এ এক স্লো টর্চারে রোস্ট হবার জন্য। তবে, আপনার মাথা পুরোপুরি জট পাকাবার আগে এবার অ্যাড হবে ডাক্তার বাবুদের বিজ্ঞাপন। আপনি ঘরে বসেই জানতে পারবেন মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর ডঃ নয়নসুখ পোড়েলের কথা, অথবা অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে কিন্তু জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা ডঃ কমললোচন পান্ডার কথা যিনি আবার সুলেখকও বটেন। এক হপ্তা ক্রমাগত এই কথামালা শুনে আপনি হাত কামড়াতে থাকবেন গত পাঁচ বছর ধরে প্রাইভেট আই ক্লিনিকে সময় এবং টাকা নষ্টের কথা ভেবে! ভাববেন সাড়ে সাত হাজারের ফাইবার গ্লাসের চশমার কথা যাতে স্ক্র্যাচ পড়ে একসা!
পলাশতলীর মানুষেরা জানে কিভাবে আলোকবৃত্তে থাকতে হয়। বইমেলা, ফুল মেলা, খাদিমেলা, পরিবেশ মেলা সবই ঢাকঢোল এবং মাইক বাজিয়ে যোশের সাথে পালিত হয়। তা বলে হোশ থাকেনা এমন ভাববেন না। মানুষ এখানে বিশ্বকর্মা পুজোর খিচুড়িও এক কিলোমিটার লাইনে দাঁড়িয়ে খায়, ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি না করে। সুশৃঙ্খল ভাবে।
এহেন জমজমাট শহরে অতিমারী সব যেন কেড়ে নিল নির্দয় ভাবে! চৌমাথার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে থাকা চোঙায় আর গান বাজেনা! ট্রাফিক রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজায় না! পথনাটিকা বন্ধ! ‘জননাথ বাবা’র তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন আর শোনা যায় না! ঝুলনমেলার মালসা ভোগের কূপন দিতে কেউ দুপুর বেলা কলিং বেল বাজায় না! মায় পাড়ার উচ্চিংড়ে ছেলেপিলের দল পর্যন্ত বিকেলবেলায় সাইকেল রেস বন্ধ করে দিয়েছে! পাখপাখালির চেঁচামেচি নেই, বাইকের ঝড় নেই, সেল্ সেল্ সেল্ বলে ‘ফক্সেমবার্গের’ ভাড়া গাড়ির ঘোরাঘুরি নেই, তারপর সন্ধ্যার আগটা দিয়ে জলের কলে মহিলাদের ক্যালোর ব্যালোর নেই…..ভয়ানক ডিপ্রেশনে ডুবে যাচ্ছিলাম জানেন! হঠাৎ করে একটা সদাচঞ্চল শহরতলির এমন শোকস্তব্ধ অবস্থা জাষ্ট নেওয়া যাচ্ছিল না!
এমন সময়..না, না, অতিমারী পালায় নি, সে তো আবার আঁটঘাট বেঁধে নামছে, ফিরে‌ এসেছে নির্বাচন, গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। ভোটের বাদ্যি বাজা মাত্র জীবন্মৃত এই পলাশতলির শিরায় শিরায় রক্তপ্রবাহ। ভাগ্যিস! পাড়ায় পাড়ায় আবার শুরু হয়েছে ছোট ছোট সভা, জনতার মুখে মুখে মাস্ক এর আড়াল থাকলেও জননেতার মুখশ্রী দৃশ্যমান। এতে ফচকে ছোঁড়াদের লাভ হয়েছে বিস্তর। সকালবেলা লাল দলের মিটিং সেরে পাউরুটি-বোঁদের প্যাকেট বাগিয়ে রাতে নীল দলের মিটিং এ ডালপুরি আর ঘুগনী। আপনার এলাকার মিটিং এ খাওয়া দাওয়ার পাট নেই বলছেন? তাহলেই বুঝুন পলাশতলীর মহিমা। মাইরি বলছি আমাদের এখানে খাওয়া-খাওয়ি হয়। আর যদি কপালগুণে একখানা মিটিং আপনার বাড়ির ঠিক সামনের কালভার্টের ওপর হয় তাহলে তো সরাসরি চলচ্চিত্র চচ্চড়ি! আপনি ভোর সকালে উঠে দেখবেন দিব্যি একখানা মেকশিফ্ট মাচা বাঁধা হয়েছে। বড়, মেজ, সেজ নেতা নেত্রীর হাসি হাসি ছবি দেওয়া ফেস্টুনে আপনার পাড়া আলোকিত। একটু বেলা হতেই ইয়া বড় ধামসা ধামসা দুখানা সাউন্ড বক্সে দেশভক্তির গান, দলীয় ইস্তেহারের ব্যাখান, ইমপোর্ট করে আনা ইম্পর্টেন্ট নেতাদের রেকর্ডেড ভাষণ; আপনি সব পাবেন কানের গোড়ায়। দেখতে দেখতে খোলা নর্দমার দুধারে দেদার ছিটোবে ব্লিচীং। তারপর রাস্তা ঢেকে পাতা হবে চেয়ার। কোথাও সবুজ, কোথাও লাল। রঙের বিতর্কে যাবেন না। ছবিতে মন দিন। অবশেষে সন্ধ্যায় হ্যালো‌ ওয়ান টু থ্রি দিয়ে শুরু হয়ে কখন যে হেভিওয়েট নেতার ভাষণে মজে গেছেন আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনার বাড়ির ছাদ থেকে আপনি দেখবেন ন্যাতা ন্যাতা পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামা পরা নেতা দোমড়ানো রুমালে ঘাম মুছে প্রাণপণে বলছেন। বলতে বলতে স্বর পৌঁছে যাচ্ছে সপ্তগ্রামে, কপালের রগ ফুলে এই ফাটে কি সেই ফাটে, টেনশনে নিজের অজান্তে আপনি আপনারই নখ খেয়ে, কেটে আঙুল পর্যন্ত চিবিয়ে ফেলেছেন অনেকটা, ওমনি নেতা বাবু হালকা করে গলা নামিয়ে ফেললেন খাদে। আপনি হাঁফ ছেড়ে একটু বাথরুম ব্রেক নেবেন ভাবলেন, পেছন ফিরে পা বাড়াতেই গর্জন, “পিঠ দেখালে চলবে না।” আপনি চমকে উঠে নেতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলেন কথাটা আপনার জন্য ছিলনা, নেতা বাবু বলছেন, “পিঠ দেখালে একদম চলবে না, হাত হাত ধরে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে হবে। ভুলে যাবেন না, বাংলার ঘরে ঘরে রক্ত, বাংলার ঘরে ঘরে আজও সুভাষ জন্মায়, যাদের শিরায় শিরায় বয়ে চলে সেই সুভাষের রক্ত, যিনি এই বাংলার মাটি থেকে জন্ম নিয়ে ফৌজ গঠন করে দেশবাসীকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।” বলতে বলতে মুষ্টিবদ্ধ হাত সজোরে আকাশে ছুঁড়ে মারেন তিনি। ডান হাত, বাঁ হাত সমানে চলতে থাকে মুখের সাথে। আপনি ঘোর লাগা কানে শুনতে থাকেন আনমনে, নাকি শোনেন না? প্রবল হাততালির পর পরের বক্তা আসেন। আপনি দেখেন নেতা বাবু ধপ্ করে চেয়ারে বসে ঘাড় টাড় মোছেন, চুল ঠিক করেন, তারপর সামনে রাখা কাঁচের গ্লাসের জলটুকু ঢকঢক করে খেয়ে নেন। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। আপনি না বুঝলেও উনি ঠিক বুঝেছেন ওনার বক্তব্য উপস্থিত দর্শকমন্ডলী হট কেকের মতো খেয়েছেন। পোড় খাওয়া নেতা বাবু লোকের চোখের পাতা ফেলা দেখে বুঝে যান মাছ টোপ গিলছে না ওগরাচ্ছে। আপনার চাপের কিছু নেই। আপনি তো আধো অন্ধকারে, ছাদের নিরাপদ উচ্চতায়। এবার সত্যিই নীচে নেমে আসতে হবে, মশা বেড়ে যায় এ সময়টায়।
দেখতে পেলেন? আপনার জন্যই দৃশ্যের অবতারণা। রোজ ভোট উৎসব দেখছি আর ভাবছি ভাগ্যিস নির্বাচন নির্ঘন্ট এসে উপস্থিত, নইলে এই দ্বিতীয় ঢেউ এর ধাক্কায় না টঁসকালেও গান-বাজনা- আনন্দ-উৎসবহীন‌ পলাশতলী আমায় পেড়ে ফেলত ঠিক।
গণতন্ত্রের জয় হোক। ভোট উৎসব সাড়ম্বড়ে হোক, আমি আছি। দেখতে পাচ্ছেন? ঐত্তো, হাত উঁচিয়ে, একগাল হেসে মাস্কিত বা অ-মাস্কিত ভীড়ের আড়ালে…..
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *