ক্যাফে ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৩)

।। আজও চমৎকার – নির্জনতা ও নিসর্গময় শিমূলতলা ।।

পঁয়ত্রিশ বছর পর এসে আবার তোমার প্রেমে পড়লাম। তুমি আজও চমৎকার শিমূলতলা! সেই আবেশ জড়ানো স্নিগ্ধতা, সেই মনোরম ভালোলাগার পরশ গায়ে মেখে আজও আমি মুগ্ধ হলাম!..

ভোরের কুয়াশা মাখা শীতের গন্ধে শিমূলতলা

কেমন মায়াবী হয়ে ধরা দিল হৃদয়ে। স্টেশন থেকে সামান্য পথ পেরিয়ে অটোয় করে চলে এলাম বিশাল বাগান ঘেরা অবকাশ যাপনের নিরালা সুন্দর বাগানবাড়িতে।

সদর দরজা পেরোতেই ছুটে এল বজরঙ্গি ভাইজান। মুখভরা হাসি। এক সাদাসিধা কেয়ারটেকার। কি সহজ আপ্যায়নে প্রথমেই আমাদের আমবাগানে বসিয়ে এক কাপ করে গরম চা ধরিয়ে দিল।

শীত গায়ে মেখে রোদদুরে বসে চা খেতে খেতেই ঠিক করে ফেললাম জলখাবার খেয়ে প্রথমে পায়ে পায়ে পাশের গ্রামে-পাহাড়ে ঘুরে আসব।

দু’দিনের ছোট্ট ভ্রমণে এসেছি। তাই শুয়ে বসে ল্যাদ খেয়ে নয় বরং এই দুটো দিন একটু পায়ে পায়ে ছুটে বেড়াব চারপাশে।

শহর থেকে অনেকদূরে চলো কোথাও চলে যাই এর দেশ হল শিমূলতলা। এখানে কৃষ্ণচূড়া লালে লাল, বন্ধু হয় কিছু সাঁওতাল! এখানে চলে আসার জন্য এখন আর ডাক্তার, কবিরাজ কিংবা বদ্যির কোনও প্রেসক্রিপশন দরকার হয় না। নিজের ইচ্ছেয় এক দৌড়ে ছুটে আসা যায়। আর  চলে এলেই মন খুশ, সবুজ অক্সিজেনে ভরে যাবে হৃদয় আর ফুসফুস!…

গ্রাম ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লাম জলখাবার খেয়েই। গ্রামের নাম চেন্দুয়া।  আমরা হাঁটছি চলার ছন্দে, ভ্রমণের আনন্দে। পলাশ গাছ ভর্তি এই বনপথে। পলাশের জঙ্গল বলা যায়। এখন মাঘের শেষ। পলাশ কুঁড়ি আসে নি। পাতায় পাতায়  ঢাকা ঝাঁকড়া পলাশ গাছগুলো ফুল ফোটানোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি। ফাল্গুনে ওরা  ফুল ফুটিয়ে হাসবে, বনে বনে আগুন জ্বালাবে। তখন গান গাইবে বসন্তের কোকিল, “বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা, নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা, শুধু এই পথ চেয়ে থাকা, ভালো কি লাগে!..”

গ্রামের মেঠো পথে হঠাৎ দেখা এক গাঁও কা অউরৎ এর সাথে। আলাপ করে জানলাম, তার হাতের ঝুড়ি ভর্তি বিড়িগুলো সে মহাজনকে জমা করতে যাচ্ছে। এই বিড়ি বাঁধার পারিশ্রমিক এক হাজারে একশো টাকা। দিনে কম বেশী এক দেড়শো বিড়ি বাঁধা হয়।  অর্থ্যাৎ সপ্তাহে এক হাজার বিড়ি বেঁধে সে পায় একশো টাকা!.. ভ্রমণ এই সব অভিজ্ঞতারও সাক্ষী হয়ে যায়!

এবার এগিয়ে চললাম গ্রামের আরও ভেতরে। জনজাতি, আদিবাসী মানুষজনের বসবাস। ছোট্ট গ্রাম। একটা মন্দির আছে। চাষজমিগুলোতে হরেকরকম সব্জি হাসছে। দূরের ঐ পাহাড়টার কাছে যাব বলে হাঁটছি। পথের ধারে এক কুমোর বাড়ি দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির উঠোনে কুমোর মাটির চাকতিতে চা এর ভাঁড় বানিয়ে চলেছে আপনমনে। আলাপ করে নাম জানলাম বাল গোবিন্দ পন্ডিত। এও জানলাম মাটির এই ভাঁড় তৈরী করে সে পায় একশো ভাঁড়ে কুড়ি টাকা। পুড়িয়ে দিলে চল্লিশ টাকা। দিনে খুব বেশী হলে দুশো ভাঁড় সে বানিয়ে উঠতে পারে। সুতরাং মজুরি হিসেবে পায় সে চল্লিশ টাকা!.. বিস্ময় ও বিষাদ এসে জড়ো হয় হৃদয়ে। গ্রাম ভ্রমণ তখন অন্য মাত্রা পেয়ে যায় এই ভ্রমি জীবনে!..

পাহাড়ের নাম মুরলী। খুব বড় পাহাড় নয়। পাহাড়ের পাদদেশে এই গ্রাম। গ্রাম ও পাহাড় ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলাম যশোদা ধামে।

মধ্যাহ্নভোজন শেষ করেই চললাম লাট্টু পাহাড়ের পথে। পঁয়ত্রিশ বছর আগে এসে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে উঠে পড়েছিলাম লাট্টু পাহাড়ের চূড়ায়। তারপর বন্ধুরা দলবেঁধে বসে কত আড্ডা, কত গল্প করে সূর্যাস্তের আলোয় নেমে এসেছিলাম। আজ এলাম অপরাহ্নের ছায়ামাখা দুপুরে। শন শন করে হাওয়া বইছে।  শীতের দাপট আছে বাতাসে। প্রথমে ভগ্ন সেই  রাজবাড়ি দেখে তারপাশের জলাশয়ের জলছবি ক্যামেরা বন্দী করলাম। কিছু সাদা বক ও পানকৌড়ির দেখা পেলাম।  এই জলাশয়ের তীরে ধর্মপতাকা পত্ পত্ করে উড়ছে। এখানে রামনবমীতে মেলা বসে। চারপাশের গ্রামগুলো পিপরাডি, আহারা, পান্না, গরিআম্মা, চম্পাতরী থেকে বহু লোক এসে জড়ো হয় এখানে। রামনবমীর উৎসব জমজমাট হয়ে ওঠে।

এবার লাট্টু পাহাড়ের পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম পাহাড়তলীতে। এখানে প্রচুর সোনাঝুরি ও খেঁজুর গাছ চোখে পড়ল। এত সোনাঝুরি দেখে মনে হল বনসৃজন পরিকল্পনার ফসল। লাট্ট পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য এখন সুন্দর সিঁড়ি করা রয়েছে দেখলাম। একশো চব্বিশটা সিঁড়ি ভেঙ্গে  ধীরে ধীরে উঠে গেলাম। চূড়ায় ছোট্ট  মন্দির। মন্দিরের ঘন্টায় হাত ছোঁয়াতেই ধ্বনী প্রতিধ্বনী হয়ে ছড়িয়ে পড়ল নিস্তব্ধ চরাচরে। সে এক অপূর্ব অনুরণন। মন্দিরের চাতালে বসে চারপাশের অপরুপ নির্জনতামাখা নিসর্গদৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখলাম আর মুগ্ধ হলাম। গল্পে গানে কেটে গেলে অনেকটা সময়।ফেরার পথে দিগন্তে দাঁড়িয়ে সূর্য মামার ডুবে যাওয়ার দৃশ্যসুখ বড় সুন্দর।

শিমূলতলা বাঙালির পশ্চিম বলে খ্যাত। আগে সবাই আসত স্বাস্থ্যদ্ধারে। তাই ঘরের বাইরে ঘর- এমন অনেক সেকেন্ড হোম বানিয়ে ফেলেছিল সৌখিন বঙ্গবাসীরা। আজ বাঙ্গালীদের সেই সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি ভগ্ন জীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। সে সব ইতিহাস নীরবে কাঁদছে। দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে ফিস ফিস করে কথা বলছে বাতাসে।

আজকের শিমূলতলায় এলে এখনো শরীর মনের অনেক উপশম হয়। হৃদয় জুড়োয়। ভালো লাগে প্রকৃতির এই অবাধ সৌন্দর্য। চারপাশের নিসর্গ বড় নান্দনিক। নির্জনতার কাঙ্গাল হয়ে এলে তার কাছে তো শিমূলতলা পরম বান্ধব। প্রাণ মনের শুশ্রুষা!

প্রথমদিনের ভ্রমণ পরিপূর্ণ করে দ্বিতীয় দিনের পরিকল্পনা মত বেড়িয়ে পড়লাম সকাল সকাল সকলে। যাওয়ার আগে ভোরের খেজুর রস খেয়ে নিলাম এক গ্লাস করে।

আজ চললাম ধারারার পথে। ওখানে পাড়ুয়া নদীর তীরে ঝাঁঝোয়া গ্রাম। সেই গ্রামে রয়েছে প্রসিদ্ধ এক শিব মন্দির। শিমূলতলা স্টেশন রোড পেরিয়ে তেলুয়া মোড় থেকে বামদিক ধরে দূরে লাট্টু পাহাড়কে পেছনে ফেলে যত এগিয়ে চললাম চোখ মন তত আনন্দে আত্মহারা। ল্যান্ডস্কেপ বিউটি এ পথের বড় সম্পদ। চোখ বারবার মুগ্ধ হবে। ভালোলাগায় ভ্রমণ সার্থক হয়ে ওঠে। দূষণমুক্ত নির্জনতম এক নিরুপম পথে চলার আনন্দ মনকে প্রফুল্ল করে দেয়।

দু’চোখের সামনের পুরোটাই এক প্যানোরামিক ভিউ।

পাড়ুয়া নদী পারের সৌন্দর্যও বড় আকর্ষনীয়। ছড়িয়ে থাকা কালো কালো পাথরের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে পাড়ুয়া নদীর জল কুলকুল করে বয়ে চলেছে। তীরে দাঁড়িয়ে সে জলধ্বনি শোনার আনন্দ খুব উপভোগ করলাম। পায়ে পায়ে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে মজাও করলাম। এখানেও চারপাশ জুড়ে নিসর্গের ভাস্কর্য। আর পলাশ বনের সৌন্দর্য।

বিকেলে গেলাম হলদী ঝর্ণা দেখতে। শিমূলতলা থেকে এক ঘন্টার সড়ক পথে পৌঁছে গেলাম এক বন জঙ্গলের গ্রামে। গ্রামের নাম বাতনাবরণ। শাল মহুলের জঙ্গল পথে আমাদের সঙ্গী হল গ্রামের দুই বালক। সরফরাজ ও রিজওয়ান। ওরাই পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল ঝর্ণা দেখাতে। ঝর্ণা দেখে মন ভরে নি। কিন্তু ভালো লেগেছে এই ছোট্ট সুন্দর ট্রেকিং।

ফিরে এসে শিমূলতলার হাট দেখলাম স্টেশন রোড জুড়ে। রবি ও বৃহস্পতিবার এই হাট বসে।গ্রামীণ হাট। এখানে তাই সব কিছুই পাওয়া যায়। শীতের সতেজ শাক সব্জি হাট জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। কাপড় জামা কাঁচের চুড়ি রঙিন চটি বাঁশের ঝুড়ি মাটির হাঁড়ি সবই পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘুরে ঘুরে দেখতে বেশ মজা।

স্টেশন রোডের এক মিষ্টির দোকানে চা সিঙাড়া ও ছানার মুড়কি খেলাম। এখানকার ছানার মুড়কির খুব সুনাম। খেয়ে ভালোই লাগল।

হাট থেকে সন্ধে নামার একটু আগে ফিরে আসছি। ঠান্ডার আমেজে  শিরশির করছে শরীর।

এই ফেরার পথে আজও সূর্য ডোবার সাক্ষী থাকলাম নির্জন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে। তারপর ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এল শিমূলতলায়।

নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ। সব শব্দ নীরবতায় ডুবে গেলে প্রকৃতি তখন আরও অপরুপ হয়ে ওঠে। সেই নিঝুমা অপরুপাকে দেখার ইচ্ছে নিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারায় তারায় ভরে আছে আকাশ। নির্মল নীল আকাশ। আর্বান পলিউশন কোথাও নেই। পাহাড় জঙ্গলেের নির্মলতায় আকাশ এখানে আরও নীল নির্মল। এই আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক দিন আগে পড়া প্রেমেন্দ্র মিত্রর কবিতার পংক্তিগুলো কি সুন্দর মনে পড়ে গেল, “কোনওদিন গেছো কি হারিয়ে / হাট বাট নগর ছাড়িয়ে / দিশাহারা মাঠে / একটি শিমূলগাছ নিয়ে আকাশের বেলা যেথা কাটে…”

সেই কতকালের চেনা শিমূলতলায় কত বছর পরে এসে সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিলাম! তাই মন হারানোর আনন্দে নতুন করে আবারও ভালোবেসেছি আজকের শিমূলতলাকেও!..

কিভাবে যাবেন – হাওড়া থেকে সরাসরি শিমূলতলায় আসা  যায় মোকামা এক্সপ্রেসে। হিমগিরি বা বিভূতি এক্সপ্রেসে করে এলে ঝাঁঝায় নেমে খুব সহজেই শিমূলতলায় চলে আসা যায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।