অণুগল্পে সুব্রত সরকার

কাহো-র গল্প

অরুণাচল সীমান্তে ভারতের প্রথম গ্রাম কাহো।
অদূরে চীন। এই সীমান্তে বেড়াতে এসেছি। অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশ। লোহিতের মত অসাধারণ একটা নদী। মিশমি পাহাড়ের ঢালে পাইনের ঘন জঙ্গল। সব নিয়ে মন ভালো করে দেওয়া একটা গ্রামে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাকে নিয়ে এসেছে গাইড আর ডি মেয়র। এখানকার প্রধান ট্রাইবস্ হল মেয়র। আর ডির বাইকের পেছনে সওয়ারী হয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম কাহো ভিলেজে।

কাহোর ভিউ পয়েন্টে ছোট্ট এক মনাস্ট্রি আছে। সেই মনাস্ট্রির শান্ত ছায়ায় বসে কাহোকে দেখছি। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্যকে উপভোগ করছি। কিন্তু মাঝে মাঝেই এই শান্ত সুন্দর উপত্যকার সব সৌন্দর্যকে ধ্বংস করে দিয়ে ফায়ারিং এর নিনাদ বড় বিশ্রী ও বিরক্তিকর লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। জানলাম এগুলো ফৌজিদের নিয়মিত ফায়ারিং প্র্যাকটিশ। সীমান্তের সুরক্ষার স্বার্থেই এসব অভ্যাস তাঁদের রাখতে হয়।

অনেকক্ষণ ধরেই মনটা একটু চা চা করছিল। এসব ধূ ধূ প্রান্তরে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামে চায়ের দোকান চাইলেই পাওয়া যায় না। আর ডি বলল, “চলুন আমার পরিচিত দেশওয়ালি ভাইয়ার বাড়ি নিয়ে যাই। ওর ছোট্ট চা’দুকান ভি আছে।”

আর ডির ভাই বাড়িতে নেই। জঙ্গলে গেছে। ঘর লাগোয়া ছোট্ট দোকান। অনেক কিছুর সঙ্গে চাও পাওয়া যায়। ভাইয়ের বউ উঠোনে কাঠ কাটছিল। আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ করে বসতে দিল চেয়ার এনে উঠোনেই। আর ডি ওদের ভাষায় কি সব বলল। ভাইয়ের বউ হঠাৎ দেখি আমাকে কেমন ধন্যবাদসূচক প্রণাম জানিয়ে দৌড়ে চলে গেল দোকানে!…

পাহাড়ি উপজাতি মানুষের বাড়ির উঠোনে বসে আছি। কাঠের ছোট্ট বাড়ি। মাথায় সবুজ টিন। উঠোনে মুরগি, ছাগল, শুয়োর খেলছে । চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এসব দেখছি। রংবেরঙের ফুলের গাছও কয়েকটা চোখে পড়ল।

সুন্দর পেয়ালায় দুধ চা নিয়ে চলে এল ভাইয়ের বউ। বিনা চিনির কথা বোধহয় আর ডি বলে দিয়েছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ তৃপ্ত হল হৃদয়।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে টুকিটাকি কথা বললাম ভাইয়ের বউয়ের সাথে। সবই আমার কৌতূহলী ছোট ছোট প্রশ্ন। কেমন ওদের জীবনযাপন, ওদের উৎসব এসব জানতে চাওয়া।

একসময় হঠাৎ ভাইয়ের বউ আমাকে বলল, “মেরা বহিন কা তবিয়ৎ আজ আচ্ছা হ্যায়। হাম আপকো বহুত সুক্রিয়াৎ দেতা হ্যায়। “

আমি জানতাম না ডং ভ্যালির যে তাঁবুতে আমি রয়েছি সেই তাঁবুর মালকিন যে ওর ছোটবোন। কালকে রাতে ওর বোনের শরীর ভালো ছিল না। ঠান্ডা জ্বরে কাবু হয়ে পড়েছিল। আমি কয়েকটা ওষুধ দিয়েছিলাম। তাতে উপকার পেয়েছে। সেকথা দিদিকে জানিয়েছে বোধহয় আজ সকালে।
কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি যে এভাবে চলে আসব দিদির বাড়ি তা তো জানতাম না। আমাকে পেয়ে দিদি তাই ভীষণ খুশি।

চলে আসার সময় চায়ের দাম সে কিছুতেই নেবে না। অনেক বললাম, নিল না। বিড় বিড় করে বলল, “বহিন আচ্ছা হো গিয়া, আপকো পোরনাম।”

এই প্রণাম আমি রাখব কোথায় !..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।