সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১০)

কেমিক্যাল বিভ্রাট
চার
তখন মধ্যরাত। চারিদিক সুনশান। ঔপমানব হঠাৎ ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ঘামে সারা শরীর জ্যাবজ্যাব করছে। চোখে-মুখে আতঙ্ক। উনি হাঁপাচ্ছেন।
আবার সেই স্বপ্ন!
মাঝে মাঝেই উনি এই স্বপ্নটা দেখেন। দেখেন, মোবাইল থেকে, কমপিউটার থেকে, ফ্রিজ থেকে একটা রে বেরিয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আগে নাকি টের পাওয়া গেলেও চোখে দেখা যেত না। কিন্তু এই রে-টা দিনকে দিন এত ঘন হয়ে উঠছে যে, এখন সেটা খালি চোখেও স্পষ্ট দেখা যায়। বোঝা যায়, এই রে-টা মানুষের শরীরে চুপিচুপি ঢুকে পড়ছে। ঢুকে শুধু শরীরই নয়, মানুষের মনটাকেও কুরে কুরে খাচ্ছে। উনি বুঝতে পারছেন, এই ভাবে চললে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যে দিন চল্লিশ বছর হওয়ার আগেই মানুষের দেহ ন্যুব্জ হয়ে যাবে। তার আগেই মস্তিষ্ক থেকে লোপ পেয়ে যাবে যাবতীয় বিচার-বুদ্ধি। যুবক হওয়ার আগেই ছেলেরা হারিয়ে ফেলবে বাবা হওয়ার ক্ষমতা। পুতুল খেলার বয়স পেরোতে না-পেরোতেই মেয়েরা খোয়াবে তাদের মা হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা।
তখন আর ষাট বছরে নয়, অফিস-কাছারিতে অবসরের বয়স বরাদ্দ হবে খুব বেশি হলে ছত্রিশ কি আটত্রিশ বছর। কারও বয়স বিয়াল্লিশ ছুঁলেই, অত বছর বেঁচে থাকার জন্য আলোচনার শিরোনাম হয়ে উঠবেন তিনি। তাঁর থুত্থুড়ে ছবি ছাপা হবে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। ফলাও করে দেখানো হবে বিদ্যুতিন মাধ্যমে।
যতই নিত্য-নতুন ওষুধ আবিষ্কার করে এই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, কোনও উদ্যোগই সফল হবে না। মানুষ যখন বুঝতে পারবে, নদীকে যত্ন করলে, গাছপালাকে ঠিক মতো লালন-পালন করলে, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ থেকে বাতাসকে একটু আগলে রাখতে পারলে, তারাই রক্ষা করতে পারত এই অনিবার্য পরিণতি, মানুষ যখন এটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করবে, তখন আর কিছুই করার থাকবে না। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সব কিছুই মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
উনি তাই ঠিক করেছিলেন, ওই ভয়ানক দিন আসার আগেই তাঁকে এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে আর ওই দিনের মুখোমুখি হতে না হয়। সে জন্য কম চেষ্টা করেননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল আঁকার প্রতি। না, ঠিক আঁকার প্রতি নয়। রঙের প্রতি। খুব ভাল যে আঁকতে পারতেন, তাও নয়। তবে যা-ই আঁকতেন, তাতে কম-বেশি করে এই রং, ওই রং, সেই রং মিশিয়ে মিশিয়ে এমন এক-একটা অভিনব রঙের জন্ম দিতেন যে, ওটা দিয়ে তুলির একটা সামান্য আঁচড় টানলেও বন্ধু-বান্ধবেরা একেবারে হাঁ করে সে দিকে তাকিয়ে থাকত।
পরে, আরও পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আর রং নয়, তিনি মেতে উঠলেন নানা রঙের তরল নিয়ে। যাকে সহজ ভাষায় বলে— কেমিক্যাল। বিভিন্ন অনুপাতে এই কেমিক্যাল, ওই কেমিক্যাল, সেই কেমিক্যালের মিশ্রণ ঘটিয়ে ঘটিয়ে উনি সৃষ্টি করতে লাগলেন তাক লাগানো এক একটা আবিষ্কার।
এই ভাবেই একদিন ডায়েরিতে লিখেছিলেন, টেবিলের উপরে রাখা পার্সটা সকাল থেকেই তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। না। সে দিন বাইরের কেউই তাঁর ঘরে ঢোকেনি। তা হলে কোথায় গেল! তাঁর বাড়ির বহু দিনের পুরনো কাজের লোক হরিহর আবার তুলে রাখেনি তো! এটা মনে হতেই হরিহরকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার পার্সটা দেখেছ নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে হরিহর বলেছিল, কই, না তো! আমি তো দেখিনি। দ্যাখেন, কোথায় রেখেছেন। আপনার যা ভুলো মন…
সে দিনই অসাবধানতাবশত হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল একটা টেস্টটিউব। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। টেস্টটিউবের ভেতরে থাকা তরল কেমিক্যালটা হাওয়ার সঙ্গে মিশে মুহূর্তের মধ্যে উবে গিয়েছিল। ওটা উবে যেতেই অদ্ভুত একটা নোনতা-নোনতা বিদঘুটে গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। পৌঁছে গিয়েছিল পাশের ঘরেও। আর তখনই, সেই হরিহরই ও ঘর থেকে পড়ি কি মরি করে ছুটে এসে বলেছিল, দাদাবাবু, টেবিলের উপর থেকে আপনার টাকার ব্যাগটা কিন্তু আমিই নিয়েছি।
কথাটা উনি শুনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওই ভেঙে যাওয়া টেস্টটিউবটা নিয়ে উনি এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, ও সব পার্থিব জিনিস নিয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় তিনি তখন ছিলেন না।