গদ্যানুশীলনে সুব্রত সরকার

অণুগল্প
প্রেমিক
পাহাড়চূড়ার ছোট্ট গ্রাম- ফুলচাখা। ডুকপাদের গ্রাম। কয়েকটা মাত্র ঘরবাড়ি। হাতে গোনা দুটো হোম স্টে। সমতল থেকে আট কিমি ট্রেক করে উঠে এসেছি। শিবুন বলে দিয়েছিল দিদির হোম স্টের কথা। সেই দিদির হোম স্টেতেই উঠেছি আমি আর মানস।
কাঠের দোতলা বাড়িটার নিচে দিদি থাকে। দিদিকে এখনো দেখি নি। ওপরে তিনটে ঘর। অপূর্ব একটা লম্বা বারান্দা। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশের পাহাড় ও দূরের পাঁচ নদীকে পাখির চোখে দারুণ দেখা যায়। মানস আর আমি ক্লান্ত শরীরটাকে চেয়ারে হেলিয়ে দিয়ে চারপাশের নিসর্গকে উপভোগ করছি। পাহাড় বড় টানে আমাদের।
কাঠের পাটাতনে ঠক ঠক শব্দ। লাঠিতে ভর করে টুক টুক করে কাছে এসে দাঁড়ালেন একজন বৃদ্ধা। অনুমানে বুঝলাম, ইনিই হোম স্টের মালকিন। হেসে বললেন, “আপলোক কলকাতা সে আয়া হ্যায়?”
মানস বলল, “হ্যাঁ।”
“আপলোক বাঙালি হ্যায়?”
আমি বললাম, “আমরা বাঙালি।”
বৃদ্ধা এবার বললেন, “মেরা জামাই কলকাতাকা লেড়কা। বাঙালি লেড়কা।”
“আপনার জামাই কলকাতার ছেলে!..” আমরা দুজনেই অবাক হয়ে বললাম, “বাঙালি লেড়কা!”
বৃদ্ধা এবার বেশ খুশি মনে যা বললেন, তা শুনে আমরা তো ফিদা!..
অনেক বছর আগে কলকাতা থেকে এক বাঙালি ছেলে এই ডুকপাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছিল। বেড়াতে এসে প্রেম!..তারপর আরও দুবার এসেছে। চতুর্থ বার এসে দিদির মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। সে মেয়ে খুব ভালো আছে। সুখে আছে। দিদির এক নাতি আছে। নাতির মুখে ভাতে গিয়ে জামাই বাড়ি বেড়িয়ে এসেছে। কলকাতা দেখেছে। জামাই দীঘায় নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের মানুষকে সমুদ্র দেখিয়েছে। এভাবেই পাহাড় নেমে এসেছিল সমুদ্রের কাছে!..
মানস দিদির মুখের গল্প শেষ হতেই বলল, “জামাই কলকাতার কোথায় থাকে?”
“মালুম নেহি!..” দিদির সরল স্বীকারোক্তি।
“তোমার জামাইয়ের নাম কি?” আমি জানতে চাইলাম।
“মালুম নেহি।” এবারও দিদির সহজ জবাব।
“জামাই কি করে?”
“অফিস মে কাম। বহুত আচ্ছা লেড়কা।” দিদির মুখে শান্ত হাসি। গর্বের হাসি।
আজ ট্রেক করে এতটা পথ এসে যতটুকু ক্লান্ত হয়েছিলাম, দিদির হাসিমুখটা দেখে সব ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। আমাদেরও বড় আনন্দ হচ্ছে দিদির জামাইয়ের জন্য, গর্ব হচ্ছে এমন এক প্রেমিক আমাদের কলকাতায় আছে জেনে।
দিদি এবার বলল, “ঠিক হ্যায়। তুম লোক রেস করো। আরাম করো। ফির বাত হোগা।”
দিদি লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে চলে যাচ্ছেন। একজন গর্বিত মা, ডুকপা জননী এগিয়ে যাচ্ছেন। খানিকটা দূরে চলে গেছেন, মানস ফিস ফিস করে বলল, “ছেলেটা কত বড় প্রেমিক বল!”
আমি হেসে বললাম, “আরে আমরাও তো প্রেমিক…পাহাড় প্রেমিক!..”
।। সমাপ্ত।।