T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় সুনৃতা রায় চৌধুরী

দেবী
উমাকে দেখতাম রোজ প্রতিবেশী দত্তদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করতে আসতো। কাজ বলতে কাজ? এত্ত এত্ত বাসন মাজা,কাপড় কাচা, ঘর উঠোন সাফ করা, কুয়ো থেকে বালতি বালতি স্নানের জল তোলা, মশলা পিষে দেওয়া, বারো ঘরের ফাইফরমাশ খাটা, একেবারে দশভুজা যেন। কোন্ ভোর বেলায় আসতো, বেরোতো যখন, সূর্য তখন মাথার উপর। সঙ্গে গামছায় বাঁধা থালায় ভাত তরকারি।
এই খাবারটুকুর জন্যই ও মুখ বুজে সারাদিন কাজ করতো। বাড়ি ফিরে সেই একজনের খাবার থেকে তিনজন ভাগ করে খেতো। অন্য দুজন হলো ওর খুদে দুটো ছেলে কাত্তিক আর গনশা। মা কাজে বেরিয়ে গেলে ওরা সারাদিন পথে পথে ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে খেলে বেড়াতো। পোশাক আসাকের বালাই ছিল না, শিক্ষা স্বাস্থ্য তো অলীক স্বপ্ন! শুধু মায়ের দৌলতে গ্রাসাচ্ছাদন। বাপ তো নেশার খোঁজে অথবা নেশার ঘোরে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন পর ওই ভাত খাবার সময় ওর বাৎসল্য উপচে পড়তো।
সেদিনও উমা এই রকম ভাবে কাজে বেরিয়েছে, বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো পাড়া! খানিকটা হৈচৈ, কে একজন দৌড়ে এসে উমাকে খবর দেয় যে, কাত্তিক গণশা আর ওদের বস্তিরই আর দুটো বাচ্চা ছেলে খেলতে খেলতে ডাস্টবিনের পাশে একটা বল দেখতে পায়। তার থেকেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ছিন্নভিন্ন করে দেয় চারটি শিশুকে। এমন তো কতই শোনা যায়, সবাই কোনো না কোনো উমার সন্তান।
উমার কাজ তখনও শেষ হয়নি, তাই দত্তগিন্নী আপত্তি করলেও উমাকে ধরে রাখা যায়নি। পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে ভীড় ঠেলে রক্তাক্ত সেই স্থানে পৌঁছেও কোনটা গনশার পা, কি কাত্তিকের কনুই, কিছুই চিনতে না পারার দরুণ কেমন বেভুল হয়ে পড়ে রইলো। চিৎকার করলো না, কাঁদলো না। পুলিশ এসে সরিয়ে দিলে একপাশে সরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। আর ঘরে ফিরে গেলো না। তার দুপুরের খাবারের ভাগীদার নেই জেনেও কাজে ফিরলো না আর।
পথে পথে ফেরে। পরনের কাপড় ময়লা, ছেঁড়া, তার মাথায় জটা, চোখ ঘোলাটে ভাষাহীন। কেউ কিছু দিলে খায়, বেশিরভাগ সময় ফেলে রাখে, কাকে ঠোকরায়, কুকুর তাড়া করে। কখনো রাস্তা ঘাটে বাচ্চা কাচ্চারা পেছনে লাগে, ঢিল ছোড়ে। ও কিছু বলেনা।
অসুস্থ পরানদার বৌ মায়া বৌদি ওকে একটা দুটো রুটি দেয় প্রতিদিন। কখনো শুকনো, কখনো বা একটু গুড় দিয়ে। তার বেশি তার সামর্থ্য কই? ওদের মেয়ে লক্ষ্মী কলেজে পড়তে যায়। লেখাপড়ায় বড্ডো ভালো শান্তশিষ্ট মেয়েটা। ভুখা পেটে কলেজ থেকে ফেরার পথে দুটো বাচ্চাকে পড়িয়ে ফেরে। সে বাড়ির কাকিমা বড়ো ভালোবাসেন লক্ষ্মীকে। প্রায় দিনই অন্ধকার হলে কাকু ওকে সঙ্গে করে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দেন।
সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি। লক্ষ্মী ফিরছে একা। কাকু কোনো কাজে বাইরে। অন্ধকারে ঝুপসি বাঁশ ঝাড়ের দিকটা থেকে তিনটে কালো মূর্তি বেরিয়ে এলো। তীব্র মদের গন্ধ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। চোখ চকচক করছে নারী মাংসের লোভে। তিন দিক থেকে ঘিরে ধরলো মেয়েটাকে। লক্ষ্মী হকচকিয়ে গিয়ে পালানোর অথবা চিৎকার করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। এমন সময় কোথা থেকে উদয় হলো উমা। একটা শাবল কোথা থেকে জুটিয়ে এনেছে। তাই দিয়ে এলোপাথাড়ি মার। কী ভয়ানক সংহারিণী অসুরদলনী মূর্তি তার! কপালে কি তৃতীয় নয়ন জ্বলছে? না, ওদের প্রতিআক্রমণে কপালে ক্ষত, তবু ওর রোগা ক্ষয়াটে হাতে কী শক্তি! একজনের মাথা ফেটেছে, একজনের একটা চোখে আঘাত, রকমসকম দেখে ওরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়েছে। হাওয়ার মুখে পাতার মতো লক্ষ্মী কাঁপছিল। এবার অস্ত্র ফেলে উমা বাড়িয়ে দিল হাত। লক্ষ্মী ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লো ওর পূতিগন্ধময় শতচ্ছিন্ন আঁচলের নিচে। উমা বলছে, “আর ভয় নেই মা।”
উমা কথা বলছে। কত যুগ পর ওর বাণী ফিরে এসেছে! এতদিন পর ওর পাষাণ হয়ে যাওয়া দু চোখ বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। ভিজে যাচ্ছে লক্ষীর মাথার চুল। ভিজে যাচ্ছে বসুন্ধরা।