কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

এবারের পুরী ভ্রমণ পর্ব ৮

(এবার শুধু আমার আমিকে চেনা)

আমি যতবার ই পুরী যাই,,,, যতবারই প্রভু জগন্নাথ দর্শনে যাই,, ততবারই আমার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নতুন নতুন অনুভূতি হয়। যার জন্য আমার কাছে এই জায়গা আর মহাপ্রভু কোনটাই পুরোনো হয় না।

এবারের ভ্রমণে একদম নতুন সব অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। জগন্নাথ দর্শন করতে যাওয়ার সময় নানা টানাপড়েন চলে আমার মনের মধ্যে। এমন এমন কথা মনে আসে যা আমি সত্যিই একদমই ভাবি নি। কিন্তু এই নানা ধরণের কথাগুলো কেন মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে বুঝতে পারি না।একে তো দর্শনের একটা টেনশন থাকেই তারপর আবার এইসব উটপটাং কথা মনে আসলে কেমন উথালপাথাল হয়ে যায় না মনটা? আগে আগে দুএকটা সিংহকে বলতাম কিন্তু কোন সমাধান বা সহানুভূতি তো মিলতোই না। উল্টে দোষারোপের উপর দোষারোপ।
পরিষ্কার কথা,,, তুমি ভেবেছো এইসব আজগুবি কথা তাই মনে এসেছে আর আমি তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারতাম না,,, আজ ও অবশ্য পারিনি যে,, যেগুলো মনে এসেছে বা মনে আসে সেগুলো আমি কোনদিন ভাবিইনি। আর ছুটে ছুটে জয় জগন্নাথ জয় জগন্নাথ করতে করতে আমি খামোখা এইসব কথা ভাবতেই বা যাব কেন?
দর্শন করতে যাওয়ার সময় মহাপ্রভুর,, বলরাম দাদার মুখ যেমন মনে পড়ে আবার নানা উল্টোপাল্টা কথাও আসে মনে।। এবারও একটা কথা মনে আসতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সিংহ মশাই কে আর বললাম না। কারণ ওকে আমার বন্ধু কম গার্জিয়ান বেশি লাগে।

ছোটবেলায় কোন বন্ধুর সঙ্গে কিছু হলে মা আমার কথা না শুনেই আমাকেই দোষী বানাত। আমি দোষ না করেও শাস্তি পেতাম। বিশ্বাসই করত না আমাকে।
এখন তার জায়গায় এসেছে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি আমার সিংহ মশাই।

সে যাক্ গে যাক্। প্রথমেই বলেছি আমি আমার মতো। কেউ না বিশ্বাস করুক আমি জানি আমি ঠিক কথাই বলেছি । বলিও। কে ভালো বললো খারাপ বললো আর কিছুই যায় আসে না আমার।
আমি আমাকে বিশ্বাস করি ভরসা করি। আমার কনফিডেন্স লেভেল একশোয় দুশো।
নিজেকে নিজেই খুব ভালোবাসি,, যে কোন কাজের জন্য নিজেই নিজেকে অ্যাপ্রিসিয়েট করি। নিজের ভালোলাগা নিয়ে থাকতে পছন্দ করি, নিজেকে সম্মানিত করি নিজেই, সাজগোজ করি নিজের জন্য নিজেকে দেখব বলে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে সাহস জোগাই দিনের পর দিন।
এই যে আজ ঊনত্রিশ দিন আমি দমদমে একা আছি,,, একটা ওয়াকারের ভরসায় চলাফেরা করছি একটা পা একদমই অফ করে। কোন আয়া রাখিনি শুধু নিজের মতো থাকব বলে নিজের সঙ্গে সময় কাটাবো বলে। এতগুলো দিন ভালো করে আকাশই দেখিনি আমি। দুদিন অন্তর ছোট মেয়ে আসে। রাতটুকু থেকে আবার চলে যায়। আমি থাকি আমার মতো। বন্ধু দের দেওয়া খাবার বাড়ি থেকে মেয়ের আনা খাবার গরম করে দিব্বি চালিয়ে নিচ্ছি। কোনো খারাপ লাগা নেই একাকিত্ব নেই। কারণ আমি জানি আমি এসেছি একা যাব ও একা। যত ই প্রিয়জন হোক যাওয়ার সময় কেউ সঙ্গ দেবে না। যেতে হবে আমাকে একাই। আর থাকতেও হবে সেই একাই। রোগের ভোগান্তিও একাই সহ্য করতে হবে।

আমি মনেকরি আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধু হল আমি নিজে। যেখানে কোন রাখঢাক নেই। সবটুকুই যেন খোলা পাতার মতো স্বচ্ছ। আমার দোষ আমার গুণ আমার অক্ষমতা আমার অপারগতা আমার ব্যর্থতা আমার সাহস ভয় ভীতি আমার কলঙ্ক আমার অপমান সব, সব আমার আমিকে জবাবদিহি করা। তাই আমার কোন চাপ নেই। আমার জগতে আমি নিজেই বিনা চাপে ঘুরে বেড়াই। কোন জবাবদিহি আমি যেমন দিতে পছন্দ করি না নিতেও করিনা।
প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আমাকে ভালো বলার লোক যে থাকবে না সে আমি খুব ভালো করেই জানি। আমার কোন এক্সপেক্টেশন নেই কারোর প্রতি। তেমনি কারোর কোন দায় নেই আমার প্রতি।

আমাকে যে এই পৃথিবীতে এনেছে সেই দেখবে,, তাঁর আশ্রয়েই তো আছি। আমার মনিব ঐ একজন বাকি সবাই যেমন রয়েছে তেমনি থাকুক আমার কোন অসুবিধে নেই কিন্তু এইসব সম্পর্কের সেরকম কোন বাঁধনই আমি অনুভব করি না হয়তো সেটা আমার দুর্ভাগ্য। কিন্তু আমি মনে করি সেটা আমার সৌভাগ্য তাইতো দিনে রাতে আমি ঐ একজনের নাম করে যাচ্ছি বিনা সংকোচে। তিনি ই আমার সব।

তো যা বলছিলাম দক্ষিণ দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছি হাত পা ধুয়ে।
মনে মনে ভাবছি খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে ছুটতে হবে ,,যত তাড়াতাড়ি যাব তত তাড়াতাড়ি আমি প্রভুকে দেখতে পাব। চেষ্টা করছি খুউব ছুটতে,,সেই আগের মতো। কিন্তু মনে করলে কি হবে,, যাচ্ছি তো খুবই ধীরে ধীরে। সন্তর্পনে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমার প্রভুকে ডাকছি। প্রায় শেষ আর একটা দরজা পার হব হব।

সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই প্রাচীন ঝুড়ি বিহীন হাজার বছরের পুরোনো সেই চেনা বটগাছটাকে। আহা আমার নিজের জায়গায় এসে পড়েছি গো। এই বটগাছ টাও আমার অতি প্রিয়,, আমার আপনজন। সেখানে মনের আশা নিয়ে ঢিল বাঁধলে সেই আশা পূরণ হয়। ঐ তো যেন দেখতে পাচ্ছি তার বাঁ দিকেই বট গণেশ। আর একটু গেলেই বট জগন্নাথ। যাঁকে দেখার সময় আমি তাঁর ভুঁড়ি তে মাথা রাখি। আহা কি সুন্দর নরম তুলতুলে ভুঁড়ি। তাঁর হাত দুটো ধরি পায়ের কাছে হাত রাখি মাথা ঠেকাই। মুখটা ধরে আদর করতে করতে বকা খাই পাণ্ডা দের কাছে সঙ্গে পিছনে দাঁড়ানো সিংহের কাছে। দু হাত দিয়ে দুটো গাল ধরে বলি আমার সোনা বাবা,,, তখন আমি তাঁকে বাবা ভাবি নাকি বড়ো দাদা নাকি ছোট ভাই কিংবা আমার ছোট বাচ্চা জানি না। কি যে আপনজন আমার মনে হয়! যার কোন নাম হয় না কোন সম্পর্ক হয় না শুধু কেমন একটা যেন টান। কী ভালোবাসা কী যেন একটা অন্তর আত্মায় হাত রাখা,, আত্মায় আত্মায় কথা বলা, যেন নাড়ির টান,,, আমি হয়তো ঠিকমতো বোঝাতে পারছি না‌।

মনে হয় এই একজন থাকলে আমার কোন চিন্তা নেই। কোন চাপ নেই। কোন পাপ করার ভয় নেই পুন্য সঞ্চয়ের অহং বোধ নেই দান করার গর্ব নেই,,,নেই কোন যন্ত্রণা আশাভঙ্গের,,কোন কামনা নেই ইচ্ছে নেই অনিচ্ছেও নেই,,, সুখ দুঃখের অঙ্ক নেই। কিচ্ছু নেই। তাঁর সামনে এই যে দাঁড়িয়ে থাকা জোড়হাতে এটাই পরম সেই মুহূর্তের ভালোলাগা যার কোনো মূল্যায়ন হয় না।

এই অসীম বিশ্ব জগত তাঁরই অধীন। জগতের সবকিছুই তাঁরই ইচ্ছায় পুনঃ পুনঃ হয় সৃষ্টি এবং তাঁরই ইচ্ছায় অনন্তকালে হয় বিনষ্ট।

প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ।
ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।। ৮
রাজগুহ্যযোগ ভগবৎ গীতা।।
জয় জগন্নাথ ❤️
চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *