কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

এবারের পুরী ভ্রমণ পর্ব ৭

(ভালো কাজ করেও খারাপ থাকি আমরা আবার খারাপ কাজ করেও ভালো থাকি। কেন থাকি? ভগবান যা করেন তা তো আমাদের ভালোর জন্যই করেন। এই পর্বে আমি সেই কেনোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
কোন জ্ঞান দিই নি। আমি শুধু আমার অভিজ্ঞতা বলতে চেয়েছি।)

৮/৩/২০২৫ শনিবার দুপুর আড়াইটে। ল্যাঙচাতে ল্যাঙচাতে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছি। যদিও মন্দিরের দক্ষিণ গেট দিয়ে গেলে মূল মন্দিরে পৌঁছানোর রাস্তার দূরত্ব একটু কমই পড়ে‌। পা এর কথা ভেবে সেইজন্যই এই রাস্তা দিয়েই যাওয়া। সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। কষ্ট হচ্ছে বেশ। ওঠার সময় ডান হাঁটুতে প্রেসার পড়ছে। খচখচে একটা যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে কিন্তু তক্ষুনি জয় জগন্নাথ বললেই যেন মনে হচ্ছে,, না না সেরকম তো লাগছে না। আজ কিন্তু সিংহ মশাই এর হাত ধরেই উঠতে হচ্ছে। নাহলে ঠিক ব্যালেন্স পাচ্ছি না।

এমনি তে আমি মন্দিরে যাওয়ার সময় কারোর হাতটাত অত ধরি না। পাঁইপাঁই করে ছুটতে থাকি। কারণ আমি তখন কারোর না। কেউ আমার না। আমি একা আমি শুধু তাঁর। মোহ মায়া ত্যাগ করে তখন শুধু আমি আমার জগুদাদার। উদভ্রান্তের মতো ছুটি,, অসম্ভব একটা অমোঘ আকর্ষণের দিকে এগোতে থাকি দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে। শুধু একটু দর্শন। তাঁকে একটু দেখব এই আশায় আমি তখন পাগল বাহ্যজ্ঞান শূন্য।
আর আমি যে এমনটা করব সেটা আমার সঙ্গে আসা সবাই জানে বেশ ভালো ভাবেই।
বিশেষ করে আমার মেয়েরা,, সিংহ মশাই। তারাও ছুটতে থাকে আমার সঙ্গে।

বলাই থাকে একে অপরকে দেখতে না পেলে ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকবে সবাই। মন্দিরে হারানোর কোন ভয় নেই। আমি ভিড়ের মধ্যে ইচ্ছে করেই একটু ছিটকে ওদের থেকে দূরে চলে যাই। নিজের মতো করে তাঁকে দর্শন করি। সেই সময় কোন বন্ধন রাখতে ইচ্ছে করে না। আমার ঠাকুর কে দেখা তাঁর সামনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে নানান কথা কতজনের কত অভাব অভিযোগ ঠাকুরের কুশল বিনিময়,, তাঁর সাজগোজ বেশভূষা এসব দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাই।
আমার মহাপ্রভুর সবটাই আমার ভালোলাগে,,, সব কিছু মিলিয়ে আমার বেশ সময়ও লাগে,,, অন্তত দশ মিনিট। ঠাকুরের সামনে দশ মিনিট দাঁড়ানো মানে অনেকটা সময়। ঐ সময় মেয়েরা কাছে থাকলে ঠাকুরের দিকে মন দিতে পারি না। ওরা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে কিনা ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যাচ্ছে কিনা। এসব দেখব নাকি ঠাকুর দেখব।
তাই নিজের মতো করে নিজের সবিধে মতো জায়গায়
আমি সেই ভাবেই বাঁ দিকের একটা কোণ দেখে দাঁড়াই। যেখানে আমি অনেকক্ষণ দাঁড়াতে পারব। পুলিশ রাও ডিস্টার্ব করবে না।

কত কথা জমা হয় প্রতিদিনের! এককথায় দেখে ওমনি ঝপ্ করে বেড়িয়ে আসা যায়! সব বলতে হবে তো?
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি দুদণ্ড কথা বলব না তাঁর সঙ্গে! তাঁরও তো কত মানসিক চাপ। এই গোটা বিশ্বের দেখভাল করা,,,মুখের কথা? এক একদিন তো সাজুগুজু করারও সময় পান না। একটা আধময়লা ধুতি পরে কোন রকমে দর্শন দেন। সেদিন বুঝতে পারি তিনি খুব ব্যস্ত আর না হলে তাঁর মন ভালো নেই।

পৃথিবীতে এত অনাচার অবিচার ব্যাভিচার হতে থাকলে তাঁর মন ভালো থাকে কিভাবে? ভক্তরা সৎ পথে থাকলে,
তাঁকে ভালোবাসলে যেমন তাঁর মন ভালো হয় আবার অবিশ্বাস করলে তাঁর সিদ্ধান্তে সন্দেহ প্রকাশ করলে ,, পাপ কাজ করলেও তো তাঁর কষ্ট হয়,, যন্ত্রণার ছাপ সারা মুখে ছড়িয়ে থাকে।
এই যে আজ ২৬ হাজার পরিবার পথে বসল। সৎ পথে থেকেও ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে দাঁড়ালো। ভেসে যাবে হয়তো তাদের সদ্য গড়া সংসার। আমাদের সবার যেমন কষ্ট হচ্ছে প্রভুরও তো কষ্ট হচ্ছে! সবাই বলছে ঠাকুর তুমি এ কী করলে কেন করলে আমরা তো কোন অন্যায় কাজ করিনি। কি বলবে ভগবান! আমরা সবাই ভগবান কে দোষী করছি। কিন্তু আসলে
আমরা তো সবাই যে যার মতো আমাদের কর্ম ফল ভোগ করছি।

আর যারা অসৎ উপায়ে পাওয়া চাকরি হারালো তাদের তো আরও বেশি গেল। হতে পারে ছেলেটির মেধা অতি তুচ্ছ অতি সাধারণ তার ও তো চাকরি চাই। একটা সিস্টেম ফেলিওর। আমরা সেইভাবে তৈরি করতে পারি নি ছেলেমেয়েদের। সরকারি স্কুলে রাজনীতি হয় পড়ানোর বদলে।সবার পক্ষে তো ইংরেজি মাধ্যম বা ভালো নামকরা স্কুল সম্ভব নয়। একটা পদের এর জন্য হাজার দুহাজার জন ছুটছে। সবাই কি ফার্স্ট হয়? হয়না। যেখানে অভাব যেখানে ক্ষিদে সেখানে তো দুর্নীতি হবেই। পেটের ক্ষিদে বড়ো দায়। তখন পাপ পূণ্য কিছুই মাথায় থাকে না। যে করে হোক সংসার টাকে দাঁড় করাতে হবে। সেই জন্যই বড়ো নেতার ঘর থেকে সোনার গয়না জমি বাড়ির দলিল ও পাওয়া যায়।

কার দোষ ?
ঐ ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পারেনি প্রলোভন সামলাতে । একটা সুস্থ জীবন চেয়েছিল তারা। তাদের সর্বস্ব গেল। তারা তো পরীক্ষাতেও বসতে পারবে না। কিন্তু যারা সৎ তারা পারবে তো পরীক্ষা দিয়ে আবার পাশ করতে! সেই মনের জোর আছে ?

আজকে একজন শিক্ষকের কান্না মাখা কতগুলো কথা মনটাকে নাড়িয়ে দিলো। “আমি কোন দুর্নীতি করি নি। দুর্নীতির সঙ্গে ছিলাম না তাহলে এতবড় অন্যায় আমার সাথে কেন হলো? সত্যিই তো আমরা তো প্রায়ই দেখি অসৎ লোকেরা ভালো আছে আর যে সৎ পথে থাকে তার যেন ততো কষ্ট।
অমন বদমাইশ লোক কেমন সুন্দর আছে দেখো! আহা অমুক ভালো লোক কি ভুগছে গো ভগবান তাকে দেখেও দেখছে না। কেন এমন হয়? মনে হয় তো,, সবার মনে হয়। আমারও মনে হয়েছিল। ভগবানের ঘরে সবাই সমান। ভালো মানুষ কেন কষ্ট পায় তবে?

আমার মা গল্প করতে করতে হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বলেছিল বুকটা যেন কেমন করছে মামনিকে ডাক,,, তারপর এক সেকেন্ডে সব শেষ। মায়ের মৃত্যুর পর আমায় শুনতে হয়েছিল অমন মৃত্যু ভাবা যায়! একটু কষ্ট পেল না? পূর্ণাত্মা মানুষ ছিলেন।
তারপর প্রায় চার বছর পর হঠাৎ ই একদিন শুনতে হল” কী বিচার ভগবানের ! যে যত পাপ করবে সে ততো ভালো থাকবে ভালো যাবে।
আর যারা সৎ তাদের কী দুর্দশা দেখো। সমস্ত ভোগান্তি যেন তাদের।
তোমার মা একটুও ভোগেন নি। কেমন সুন্দর কথা বলতে বলতে চলে গেলেন একটুও কষ্ট পেলেন না।
চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম তাহলে বলছ আমার মা অসৎ,, পাপী ছিল তাই অমন না ভুগে ড্যাঙডেঙিয়ে চলে গেল?
,,,, না তা নয় আসলে যে যতো পাপ করে সে ততো ভালো থাকে তো তাই বলছি।
ভালো লোকেরাই তো কষ্ট পায়। কিছুদিন আগেই ওনার উনি গত হয়েছেন এবং বেশ ভুগেছেন। আর কষ্টও পেয়েছেন খুব।
ওনার কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। ঠাকুর কে প্রশ্ন করেছিলাম কেন এমন হয় ঠাকুর? ,,,,,,আজ সেই নিয়েই বলতে বসেছি।

তো যা বলছিলাম ভগবান কে আমরা মোটামুটি সবাই কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। আমি তো কোন পাপ করি নি ঠাকুর তাহলে কেন আমার এমন হল। অনেকেই দিনে রাতে এই কেনো র উত্তর খোঁজে। আমার মনেও প্রশ্ন ছিল কিন্তু একদিন আমি ভগবানের কৃপায় এর উত্তর পেয়েছিলাম আজ সেই কথাই বলি।

ফেসবুক বা ইউটিউবে অনেক সাধু সন্তের প্রবচন শোনা যায়। আমি প্রায় প্রায়ই শুনি। আজ যেটা বলছি সেটা আমি কার থেকে শুনেছি সেটা মনে নেই। কিন্তু যেটা শুনেছি সেটা আমার আত্মায় গেঁথে গেছে। এবং আমি সেই সন্তের কথা বিশ্বাসও করেছি।

আমাদের জীবনের সব পাপ পূণ্য ধরে নিচ্ছি একটা ইউ সেফের কাচের ফানেলের মধ্যে রয়েছে। যার একদিকে পাপ আর একদিকে পূণ্য রয়েছে।
পাপ পূণ্য একেবারে সমান সমান। স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে।

এবার আমি পরের পর খুবই পাপ কাজ করছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি খুব ভালো ভাবেই জীবন যাপন করছি।
ফানেলে পাপের জায়গা দিয়ে একটু একটু করে পাপ ঢুকছে। কিন্তু ফানেলের সবটাই তো ভর্তি। তখন পাপ জায়গা করার জন্য পূণ্যকে ঠেলছে। পূণ্য ফানেল থেকে বেরিয়ে আসা মানেই সেই পূণ্য ফল আমি ভোগ করব। তারমানে আমি অন্যায় কাজ করেও পূণ্য ফলের জন্য ভালো থাকছি। কিন্তু এই ভাবে পাপ করতে করতে যখন পূণ্য সব বেরিয়ে যাবে তখন শুরু হবে আমার বিচার। সেই পাপের ফল আমাকে ভোগ করতেই হবে। এ জন্মে শেষ না হলে পরের জন্মে আমি সেই প্রারব্ধ ফল ভোগ করবই। খুব ভালো মানুষ হয়েও ভালো কর্ম করেও গত জন্মের পাপের ফল আমাকে ভোগ করতেই হবে। ভগবানের কাছে কোন ক্ষমা নেই। তখন ফানেলের প্রায় সবটাই পাপে ভর্তি। ভগবান কী করবেন?

আবার এমন অনেক মানুষ আছেন যাকে আমরা কোন খারাপ কাজ করতে দেখি নি কিন্তু তিনি খুবই কষ্টে আছেন। কষ্টে থেকেও তিনি কারোর ক্ষতি করেন না সৎ পথে থাকেন। লোকের উপকার করেন।
তাঁর জীবনের অর্জিত পূণ্য ঐ ফানেলের মধ্যে ঢুকছে। পূণ্য জায়গা না পেলে পাপ কে তো ঠেলবেই। পাপ বেরুলো মানে সেই পাপের ফল তো ভোগ করতেই হবে। আর এইভাবে ফানেলের পুরোটাই যদি পূণ্যে ভরা থাকে। তাহলে তো লাইফ ঝিঙ্গা লালা।

তাহলে আমরা কিভাবে চলব? এই প্রসঙ্গে ভগবান বলছেন গৌতম বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করো। তবেই তুমি এ জন্মে থেকেও পরের জন্মের ভালো থাকাটা নিশ্চিত করতে পারবে।
জয় জগন্নাথ ❤️

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *