কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

এবারের পুরী ভ্রমণ পর্ব ৯
(মন্দিরের কথা প্রভুর কথা)
ভগবান বলছেন কলিযুগে শুধু নামগান করলেই হবে। কলিযুগে সবাই খুব ব্যস্ত থাকবে বসে বসে পুজো করার সময় কোথায়,,অত পুজো করার প্রয়োজন নেই ভগবানের নাম করলেই কল্যাণ হবে। সব নামের সব মন্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ না জানলেও চলবে। শুধু হরিনামের মাধ্যমেই কাঙ্খিত সুখ শান্তি প্রাপ্ত হবেই হবে,,,,,
এটা শুনেছিলাম কোন এক কথাকারের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখে।
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ব্যাপার টা আমার ভালোই লেগেছিল। কত সহজ পথ, ভগবানের কাছে পৌঁছে যাওয়ার। তাই সারাদিন মুখে থাকুক, মনে থাকুক তাঁর নাম। ঘটা করে পুজোয় না বসেও।
আমি সেটাই করি। সারাদিন শুধু জগন্নাথ নাম। আর তা করে যে কী শান্তি পাই তা বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই।
অভ্যেস মতো জয় জগন্নাথ জয় জগন্নাথ বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত মন্দিরের চাতালে পৌঁছে গেলাম। শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে গেল। একটা শক্তি যেন ভর করল। মনে বল এসে গেল,, এত ভীড় কিন্তু মনে হল আমি ঠিক পারব। দর্শন হবেই। মন্দিরে এসে পড়েছি যখন দর্শন আমার হবেই। উফ্ কী আনন্দ হচ্ছে। ভগবান তোমার অশেষ দয়া অশেষ করূণা আমি শেষ পর্যন্ত এমন পা নিয়ে পৌঁছতে পেরেছি। জয় জগন্নাথ জয় জগন্নাথ ❤️
কিন্তু হঠাৎ মনে হল এই যে বার বার আসা। আসার আগেই পরের বারের হোটেল বুকিং টিকিট সব রেডি থাকে যার জন্য ফিরে আসার সময় মন খারাপ হলেও মনের ভেতর একটা আশার প্রদীপ জ্বলতে থাকে এই তো আবার কদিন পরেই আসব। চোখ মুছে ফিরে আসি।
আবার আমার দিন গোণা শুরু হয়। আচ্ছা আমি যদি হঠাৎ মরে যাই তাহলে তো আর আসতে পারব না এখানে কি হবে আমার! কেন আমার এমন মনে হল জানি না। আমি আগে থেকে এসব ভাবিই নি তবু আমার মনে হল। গায়ে কাঁটা দিয়ে কেমন শীত করে উঠলো। একটা অসম্ভব ঠাণ্ডা বরফের স্রোত আমার শরীরে যেন বয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দেওয়া অসম্ভব শীত। হঠাৎ করেই যেন টেনশন শুরু হল বুঝতে পারলাম। কারোর সঙ্গে শেয়ার করলে টেনশন কমে কিন্তু কাকে বলব একথা! কেউ তো নেই বলার মতো,,,
সত্যিই তো এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি তো আর আসতেই পারব না। মানুষ জন্ম নেব তার কোনো গ্যারান্টি নেই। জন্মালেও তিনি যদি না ডাকেন তাহলে তো আর দেখাই হবে না আমার তাঁকে। তখন আমি কি করব? এমন অনেক মানুষ আছেন যারা কোনদিন মহাপ্রভুকে দর্শন করেননি। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই করে নি কারোর বা ইচ্ছে থাকলেও আসা হয় নি এই শ্রী ক্ষেত্রে।
এইসব উটপটাং কথা কেন আমার মনে হলো জানিনা। বুকের ভেতরটা আনচান করে উঠলো। কান দিয়ে গরম বাতাস বেরোচ্ছে বুঝতে পারছি। আমি জয় জগন্নাথ বলে চিৎকার করে উঠলুম। মনটা অন্যমনস্ক করার প্রয়াসে। সিংহ চমকে আমার দিকে তাকালো আমি কিছু না বলে এগোতে থাকলাম। এবার একটু বসতেই হবে পা টা টনটন করছে। বটগাছের উল্টো দিকে একটা ছোট্ট মন্দিরের চাতালে বসে পড়লুম। পরিশ্রম আর দর্শনের চাপা টেনশনে আমি তখন বেশ খানিকটা পরিশ্রান্ত।
পাণ্ডা মশাই এর বলা নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আছি। কত ভক্ত কত পাণ্ডা কত কত মানুষ কী ভীষণ ব্যস্ত তারা। সকলের যাওয়া আসা দেখছি। কারোর দর্শন হয়েছে কেউ কেউ বা যাচ্ছে দর্শন করতে। কেউ বা একদম নতুন এসেছে। বড়ো বড়ো চোখ করে মন্দিরের বিশালতা দেখতে দেখতে মুখটা উপরে তুলে দিয়েছে।
দুপুর তিনটে বাজে। সবাই মোটামুটি মন্দিরের মাটিতে বসে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধ্বজা ওড়ানো দেখবে । হাজার লোক তো বসেইছে। আর আমরা ঠিক ধ্বজা ওড়ানোর সময় মন্দিরে ঢুকব কারণ ঐ সময় মন্দির একটু ফাঁকা থাকে। ধ্বজা ওড়ানো শেষ হলে তখন আবার দর্শনের জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হবে।
আমার প্রতিটা সময় জানা। কোন সময় ভালো করে দর্শন করতে পারব,, কোন সময় মন্দির ফাঁকা থাকবে,, কোন দিনে বেশি ভীড় হয়। কি কি বার মন্দির একটু হালকা থাকে সব জানা আমার। ইচ্ছে করেই জেনে রাখি। এখানের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় আমার জানতে ভালো লাগে। প্রভুর লীলা মন্দিরের নানা নিয়ম কানুন ভগবানের বিষয়ে নানা গল্পগাছা আমাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করে।
ঐ যে মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে মহাপ্রভুর ভোগের আরতি শুরু হচ্ছে। ধ্বজা ও রেডি করছে তিনচার জন পাণ্ডা। কয়েকজনকে চিনতে পারলাম। এদের ট্রেনিং শুরু হয় দশ এগারো বছর বয়েস থেকে। সাতাশ আটাশ এর পর আর ওরা উপরে ওঠে না। শরীর ভারি হয়ে যায় তো। এমনিতেই পাণ্ডারা বেশ সবাই একটু নাদুসনুদুস হয়। ভগবান ও খেতে ভালোবাসেন তাই তাঁর শরীরও তেমন নাদুসনুদুস আবার তাঁর দেশের সবাইই বেশ নাদুসনুদুস। আমাদের পাণ্ডা মশাই ও। এখানে কেউ রোগা নেই।
একজন পাণ্ডাও চোখে পড়লো যার ভুঁড়ি নেই। যেমন মোটাসোটা তেমনি গায়ে জোর বাপরে।
তো যা বলছিলাম এই যে যেসব বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা মন্দিরের উপর উঠে ধ্বজা টাঙায় তাদের শুধু এটাই কাজ। বংশানুক্রমে এরা এই কাজই করে যাচ্ছে। বিকেলে একবার সব ধ্বজা নিয়ে উপরে ওঠে। সব টাঙিয়ে সন্ধ্যা আরতি করে নেমে আসে। আবার রাত এগারোটার সময় উপরে ওঠে। যে ধ্বজা গুলো ওড়ে ঐ গুলো নামিয়ে আনে। একবার আগুন লেগে গিয়েছিল। আসলে ঐ উপরে একটা অখন্ড প্রদীপ জ্বলে। কখনো নেভে না। অত হাওয়ায় প্রদীপটা কিভাবে জ্বলে সত্যিই ভেবে আশ্চর্য লাগে।
ভগবান আমাদের নানা ভাবে তাঁর উপস্থিতি বুঝিয়ে দেন। কিন্তু আমরাই বুঝতে পারি না। অত রাতে অন্ধকারে খাঁজ বেয়ে বেয়ে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঐ উপরে ওঠা ভাবা যায়! আজ পর্যন্ত কোন রকম এক্সিডেন্ট হয় নি। ভগবান তাঁর ভক্ত দের কিভাবে রক্ষা করেন ভাবলেও কান্না পায়।
ধ্বজা ওড়ানোর সময় একদম চক্রের মাথায় উঠে বড়ো একটা ধ্বজা টাঙিয়ে চক্রে পা জড়িয়ে দুটো হাত ছেড়ে নিজেকে যখন ভগবানের কাছে সমর্পণ করেন। আর তখন হাজার হাজার ভক্তদের জয় জগন্নাথ ধ্বনি আর হাততালির আওয়াজে আকাশ বাতাস সেই মন্দির চত্বরে যেন স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে। যেন স্বর্গের দেবদেবীরা নেমে আসেন সেই চরম মুহূর্তের সাক্ষী হতে। আহা কী যে অসাধারণ পরিবেশ গায়ে কাঁটা দেয়। জয় জগন্নাথ ধ্বনির তালে তালে যেন নেচে ওঠেন স্বর্গের অপ্সরা অপ্সরীরা।
চোখ মুছতে মুছতে আর দেখতে দেখতে ঘাড়ে ব্যাথা অনুভব করলেও চোখ সরাতে ইচ্ছে করে না। কী অপরূপ দৃশ্য! পিঠে অমন ভারি বোঁচকা বেঁধে ঐ বাচ্চা গুলো কেমন তরতরিয়ে উঠে যায় একটুও ভয় লাগে না ! এটা আশ্চর্য নয় ! এমন বিরল দৃশ্য মনে হয় দেখেই যাই দেখেই যাই কিন্তু পাশ থেকে তার কথায় আমি বাস্তবে ফিরে আসি।” চল চল দেখা হয়েছে অনেক। আর কত দেখবে,,, যতবার আসছ ততবারই তো হাঁ করে দেখছ।”
কি বলি আর। বলার মতো কিছু ভাষা খুঁজে পাই না। তবে এবার আর অত দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করি নি কারণ মাথায় আছে ধ্বজা ওড়া শেষ হলেই সবাই ছুটবে দর্শনের জন্য। মারাত্মক ভীড় হবে। এত ভীড়ে আমি এই অবস্থায় পেরে উঠব না। তাই একটু দেখেই লাইনের দিকে পা বাড়ালাম।
ইতিমধ্যেই বাসুদেব পাণ্ডা মশাই এসে গেছেন। উনিই বললেন ভোগ লাগছে। এতক্ষণ মন্দির বন্ধ ছিল। ভগবান ভোগের আগে সাজুগুজু করেন। শম্পা দি প্রভুর শৃঙ্গার শেষে হল আজ দেখবে কেমন লাগছে চল চল তাড়াতাড়ি চল । আরে তাড়াতাড়ি চল বললে হয়। সেখানে আমার মতোও অনেক পাবলিক লাইন দিয়েছে ফাঁকায় ফাঁকায় দর্শন করবে বলে। মন্দির চাতালে লোকে লোকারণ্য সবাই বসে পড়েছে। মাথার উপর সূর্য গনগনে আগুন ছড়াচ্ছেন। জলের পাইপে মন্দির চাতাল ভিজিয়ে দিচ্ছে মন্দির কর্মচারীরা। কিন্তু এত গরম এত গরম জল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেঝে শুকিয়ে যাচ্ছে।এমন তেতে রয়েছে পা যেন পুড়ে যাচ্ছে। কোনমতে ছুটতে ছুটতে লাইনে দাঁড়ালাম।
জয় জগন্নাথ ❤️