সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ৪০)

আমার মেয়েবেলা
আমার প্রথম প্রেমের গল্প
জীবনে কোন না কোন সময় আমরা সবাই এক আধবার প্রেমে পড়ি। সেটা কোন বড়ো ব্যাপার নয়। প্রেম তো একটা স্বাভাবিক ঘটনা। বরং জীবনে প্রেম না আসাটাই অস্বাভাবিক।
এখন যেমন বুক ঠুকে প্রেম নিয়ে বেশ একটা লেকচার দিতে পারছি। বলতে পারছি হ্যাঁ,,, আমিও প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই সময় এসব বলার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিল না।
প্রেম তখন একটা নিষিদ্ধ যৌন শব্দ। গ্রামে গঞ্জে এই যৌনতার ছাপ যদি তোমার গায়ে লাগল,,হয়ে গেল। কোত্থাও বিয়ে হবে না। তুমি খারাপ তাই কেউ বন্ধু হবে না। রাস্তায় বেরুলে ফিসফাস। আর বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের টেড়া চোখ, বেঁকা কথা। তোমাকে দেখলে বাবার ভ্রুকুটি আর মায়ের গুমগুম কিল চড়। জীবনটা তখন একেবারে নরক। না- সেই ছেলেটির সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবে, না- তোমার কোথাও বিয়ে হবে। তখন বাড়ির পুরুষ মানুষদের একটা মেল ইগো কাজ করবে। কেন আমরা কি একটা ভালো ছেলে ওর জন্য জোটাতে পারতাম না? যেন বিয়ে করার জন্যই প্রেম।
একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি। তোমার লেখাপড়া বন্ধ হবে। গান শোনা বন্ধ হবে। সবার মধ্যে থেকেও অসহায় তুমি তখন যেন একটা নির্জন দ্বীপে একা। তখন নানা কথার বিষে জর্জরিত তুমি,, আত্মহত্যা করা বা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবে না।
এবার তুমি হয়তো ধীরে ধীরে সেটা কাটিয়ে উঠলে, বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে কেটে বেড়িয়ে গেলে সামনের দিকে। কিন্তু তোমাকে তোমার আত্মীয় স্বজন (যারা জানে) তোমায় ভালবেসে সারাক্ষণ,, এবং সারা জীবন মনে করিয়ে দিতে থাকবে যে তোমার কাউকে ভালো লেগেছিল। হয়তো ভালোবেসেছিলে খুব,, হয়তো মনে হয়েছিল এভাবে পার করে দিতে পারি হাজারটা বসন্ত!
আমি হলফ করে বলতে পারি এই একটা কাজ কিন্তু সবার আত্মীয় স্বজনেরাই খুব নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে করে থাকে।
আবার বাড়ির ছেলে,, যে কোন মেয়ের সঙ্গেই প্রেম বা যে কোন জাতেই বিয়ে করুক আপত্তি নেই। যদি মেয়েটি বড়োলোক ঘরের হয়। আর তাছাড়া ছেলেটি যদি রোজগেরে হয়। সেখানে এ বিষয়ে কোনো কথাই থাকতে পারে না। কিন্তু কলেজ পড়ুয়া মেয়ে যদি করে,,, উফ্ আর রক্ষে থাকবে না। আজ সেই গল্পটাই বলতে বসেছি।
সেই আশির দশকে,, যারা কলেজ জীবন কাটিয়ে এসেছে। তারাই জানে। কী নিরামিষ জীবন আমরা,, মানে মফস্বলের মেয়েরা কাটিয়েছি। সেইসময় আমাদের কলেজে শাড়ি পরেই যেতে হত। খুব সাধারণ শাড়ি। ভালো শাড়ি পরলেও বিপদ। ততধিক সাধারণ সাজগোজ। লিপস্টিক লাগানোর কথা ভাবাই যেত না। ভালো মেয়ে যদি হতে চাও খারাপ মেয়েদের মতো ঐটি লাগানো চলবে না। তোমার রূপ সৌন্দর্য কে যতটা সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। লিপস্টিক মানেই খারাপ,, লজ্জাজনক কাজকর্ম। তবে বাড়ির কথায় একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করে এক মাসের মধ্যে প্রেগন্যান্ট হওয়াটা লজ্জা তো নয়ই, বরং গর্বের। বংশরক্ষা বলে কথা।
তো যাইহোক আমাকে কেউ কোনদিন কোনবিষয়েই আটকাতে পারেনি। আমি বেরুলে লিপস্টিক লাগাতামই।
কোথাও বেরোনোর কথা উঠলেই ঠাকুমার ফিসফিস, ‘লিপস্টিক লাগাবি না খারাপ মেয়েদের মতো।’ ঠাঁয় আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত আমি যাতে লিপস্টিক না লাগাতে পারি। কিন্তু আমিও তো কম বদ্ ছিলাম না। সদর দরজায় কিংবা গলির দরজায় এসে টুক করে লাগিয়ে নিতাম। আসলে ঠাকুমা চাইত আমাকে কেউ যেন খারাপ না বলে। আর আমি মনে করেছিলাম এটা অন্যায় এবং এর বিরুদ্ধে কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। পরবর্তীতে কলেজে আমাকে দেখে আমার অনেক বন্ধুরাই একটু আধটু সাজগোজ করে আসত। একদিন ঠাকুমাকে বলেছিলাম নিজে তো সারাক্ষণ পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে বসে আছ। তোমার আর কী?
যাইহোক একটা দেখতে না পাওয়া, মনের শান্তি দেওয়া ছোট্ট টিপও আমরা কলেজ যাওয়ার সময় পরতাম না। কোথাও গেলে টেলে তখন টিপ পরা। কোনরকমে মাথায় চিরুনিটা ঠেকিয়ে চুলটা জড়িয়ে,,খুব জোর একটা বিনুনি বেঁধে মাথা নিচু করে,, এপাশে ওপাশে না তাকিয়ে ছুটতে ছুটতে গঙ্গা পেরিয়ে কলেজ। আর তখন সেখানে মুক্তি শুধু মুক্তির খোলা হাওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে,, চল্ শুধু একটা জীবন তোর সঙ্গে কাটাই,,,,,
তবে যে যাই করুক আমি কোনদিন অমন ভাবে কলেজ যাই নি। কারণ আমার মন সায় দেয় নি। তাই বলা যায়,,, কেউ আমাকে যাওয়াতেও পারে নি । হালকা করে একটু কাজল পরতামই। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে কখনো একটা বিনুনি বাঁধতাম। কিংবা চুলে গার্ডার লাগাতাম শুধু। আমাদের সময়ে ক্ল্যাচার ট্ল্যাচার ওসব ছিল না। কোঁচকানো চুল বাঁধলেও এদিক ওদিকের চুল আমার চওড়া কপালে খেলা করতই। লুকিয়ে পাউডারের পাফ্ একটু হালকা করে বুলিয়ে নিতাম। ঠোঁট ফেটেছে এই অজুহাতে একটু ক্রিম ঠাকুমার কাছ থেকে নিয়ে বুলিয়ে দিতাম আমার গোলাপি ঠোঁটে। আর যে কোন শাড়িই পরতাম ভীষন পরিপাটি করে। কেউ দেখবে বলে নয়। আমিই আমাকে দেখব বলে।
শাড়ি পরাটা দেখে শিখেছিলাম আমার স্কুলের টিচার আর বি দির থেকে। সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি পরতেন। কিন্তু সেই পরার গুণে তার থেকে চোখ ফেরানোর উপায় ছিল না।
ছোট থেকেই আমার ঈশ্বর প্রদত্ত একটা ব্যাপার ছিল। ব্যাপার না বলে গুণ বলা যেতেই পারে। কিন্তু নিজের সম্পর্কে বলছি তো তাই একটু দ্বিধা রেখে বলা।
ভগবানের অসীম কৃপায় আমি যে কোন বিষয়ই খুব সহজেই করায়ত্ব করতে পারি। সেটা তখন বুঝতে পারি নি। এখন মধ্যবয়েসে এসে নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে করতে বুঝতে পারি। তবে হ্যাঁ অঙ্ক নিয়ে কোন কথা হবে না।
যাইহোক আমি লেখালেখি শুরু করেছি ষোলো সালের মাঝামাঝি একটা গল্প দিয়ে। হঠাৎ মনে হল কিছু লিখি। ফেসবুক করে সাধারণের মতো জীবন কাটানো আর সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাস্ ভেতর থেকে তাগিদ আসল। শুরু হল নতুন যুদ্ধ। এবং একগুঁয়ে বেপরোয়া আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারলই না। যে কোন ব্যাপারই যে আমাকে লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হবে সেটা এখন মেনে নিয়েছি। তাই জয়টা অনায়াসেই চলে আসে।
আর সেই গল্পই কিনা এবার ইন্টারন্যাশানল মাইক্রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমাকে সম্মানিত করল।
তো যাইহোক যেটা মনে করি করবই সেটা করেই ছাড়ি। আর সেটা আমার চরিত্রের একটা গুণ নাকি অপগুণ সেটা জানি না। আর এইভাবেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শিখে যাই যেটা আমি শিখতে চাই। তাইবলে অঙ্কের কথা ভাবতে বলছি না।
######
কলেজে প্রথম দিন কারোর সাহায্য না নিয়েই খুব সুন্দর গুছিয়ে মায়ের একটা টিয়া রঙের জর্জেট শাড়ি পরেছিলাম। মনে হয়েছিল আমাকে সুন্দর করে শাড়ি পরা শিখতেই হবে। যে করেই হোক।এবং পরার পর নিজেই ভীষন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে ভেতর থেকে কাজ করার ইচ্ছেটা যদি থাকে,, মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি। আর এই বিশ্বাসটা আমার মা বাবা মনের ভেতর গেঁথে দিয়েছিল। বাবা বলত কোন কাজে ‘না’ বলতে নেই। না বলা মানেই মাথা ৯০% কাজ করা বন্ধ করে দিল। শত চেষ্টাতেও সেই কাজে ঠিকঠাক সাফল্য আর আসবে না।
যেটা বলছিলাম আমি সেইসময় সাজগোজ করে কলেজ যেতাম এই নয় যে,, আমাকে সবাই দেখবে বলে। এই যে,, আমি নিজেকে নিজেই ঐ ভাবে দেখতে পছন্দ করতাম। আমি তখনও যেমন নিজের জন্য সাজতাম, এখনও তাই। আসলে নিজের কাছে স্যাটিসফাই থাকলে যে কোন মানুষের কনফিডেন্স লেভেলটাই বেড়ে যায়, এটা আমার মনে হয়।
ব্যক্তিত্বহীণ মানুষ যত সুন্দরই হোক ঠিক জমে না। নিজেকে ভালোবেসে নিজের মন, নিজের শরীর যত্নে রাখতে পারলে তবেই না!
মন সুন্দর মানেই সব সুন্দর। আত্মবিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরি। তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ক্ষতি করে আমাদের। আমি বলতে চাইছি যে কোন সাধারণ মেয়েই নিজেকে ভালোবেসে নিজের প্রতি যত্নশীল হলে এবং অবশ্যই নিজের কাছে সৎ থাকতে পারলে সর্বপরি নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারলেই তার শরীরে মনে যে উজ্জ্বলতা আসে, যে দীপ্তি আসে তাতে তার আর কোন মেকআপের দরকার পড়ে না।
আমার মনে হয় শক্তি সম্পত্তি আর সৎ বুদ্ধি থাকলে যে কোন সাধারণ মেয়েই পৃথিবী কাঁপাতে পারে। আর সেটা অর্জন করার জন্য কারোর সাহায্য দরকার পড়ে না। একটু আত্মবিশ্বাস থাকলেই হলো।
ব্যক্তিত্বময়ী নারী আমাকে সবসময়ই আকর্ষণ করে। ওটাই তো তার রূপ। ওটাই তো তার সম্পদ। আর ওটাই হল তার এমন সৌন্দর্য যা দীর্ঘস্থায়ী, যা আজীবন রয়ে যাবে।
আমি সাধারণ একটা শাড়ি সুন্দর পরিপাটি করে পরে, মাথা উঁচু করে যখন কলেজ যেতাম অনেকেই বলেছে দেখতে সুন্দর তো তাই এত অহংকার। এখনও আমার শ্বশুর বাড়ির পাড়ার কেউ কেউ আমাকে অহংকারী ভেবে মনের জ্বালা মেটায়। কারণ আমি ঘোমটা দিলেও মাথাটা উঁচুই রাখি। আর অতটা কারোর কাছেই সহজলভ্য হই না।
যাইহোক কে আমার সম্পর্কে কী বলল কী ভাবল কিচ্ছু যায় আসে নি কোনদিন,, এখন তো নয়ই।
##
অনিকেত দা আমার ভালোবাসা ছিল আগেই বলেছি। আমি অবসরে যাপন করতাম শুধু তার সঙ্গে। নিজেকে কোনদিন ওর থেকে আলাদা করতে পারি নি। এক এক সময় মনে হতো ওর সঙ্গে পালিয়ে যাই নির্জন কোন দ্বীপে। আদম ইভের জীবন কাটাই আনন্দে কোন সম্পর্কে না বেঁধে,,
তবে এই অনিকেতদা আমার বাস্তব জীবনকে কিন্তু খুবই সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল। এক ঝলক দেখে যাকেই একটু ভালো লাগত মনে হত এই কি সেই? যাকে নিয়ে এতগুলো বছর এত ভালোবাসাবাসি! কিন্তু হত না। মেলাতে গিয়ে হোঁচট খেতাম। ভালোলাগা কুঁড়ি হয়ে রয়ে যেত। ফুল হয়ে ফুটতে চাইলেও পারত না। এ সবই আমার মনের ভেতরে আর একটা মনের গোপন খবর যা কোনদিন কেউই জানতে পারে নি।
একটু শ্বাস নেওয়া বলতে ঐ কলেজের সময় টুকু। শ্যামলী ওর প্রেমের গল্প বলত। শান্তদার চিঠি পড়াত। আর আমি প্রেমের জাল বুনতাম। মনে হতো চিৎকার করে বলি,
একবার বাউণ্ডুলে হয়ে দেখোই না অনিকেতদা।
তোমায় নিয়ে কেমন দিগন্তরেখা ছুঁয়ে আসি।
কাশফুলে ঢাকা সবুজ মাঠে তোমার গা ঘেঁষে বসি।
গাঢ় চুম্বনে হারিয়ে যাই সবকিছু পিছনে ফেলে।
তোমার মরচে পড়া অলিন্দের খাঁজে হাত রাখি বিশ্বাসের,
শুকনো নদীটা বেঁচে উঠুক আবার আবার আবার,,,
ক্রমশ