কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

এবারের পুরী ভ্রমণ ৫:
(এই পর্বে বেশিরভাগটাই ভগবানের কথা, ভগবৎ গীতার কথা।)
লাগেজ হোটেলের রিসেপশনে রেখে সি বীচে গেলাম। রুম খালি হতে এখনও দেড় ঘণ্টা। তারপর পরিষ্কার হবে তারপর আমাদেরকে দয়া করে ঢুকতে দেবে।
তাই চলে গেলাম সি বীচে। এক কাপ চা খেতে খেতে চারপাশটা দেখতে লাগলাম সূয্যিমামা তখন সবে ব্রেকফাস্টে বসেছে তাই তাঁর মেজাজ একেবারে গুলু গুলু। তাই আমরাও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি,,,, হালকা হাওয়া দিচ্ছে,, মার্চের ৮ তারিখ। দোল হয় নি একটু শীত শীত ভাব আছে। একটা জায়গায় দেখলাম দুটো বাচ্চা খেলনা বাটি নিয়ে সংসার সংসার খেলছে।
ছোটবেলায় কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমি খুবই খেলতাম। আমাদের সময় পড়াশুনোর অত চাপ ছিল না। তাই মনভরে একটু খেলতে পেরেছি। খুব খেলনা বাটি আর পুতুল নিয়ে খেলতাম। মা কাপড়ের পুতুল বানিয়ে দিত। বেলা ১১টা থেকে ১ টা ছিল আমার খেলার সময়। মাথায় একটা গামছা বেঁধে খোঁপা করতাম। আর মায়ের একখানা পুরোনো ছাপা শাড়ি জড়িয়ে নিজের মনে বকবক করতে করতে খেলা করতাম। ‘ওগো শুনছো বাজার আনতে হবে’,,,,,কাল আমার মেয়েকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে বাবা কত কাজ !,,,
এখন ভাবলে হাসি পায়। সত্যিকারের বউ হওয়ার পর কোনদিন আমার সিংহ কে এভাবে বাজার আনাতে বলার সুযোগই পেলাম না। সে যাক্ গে যাক্ সেসব কথা। যা বলছিলাম,,,,
সি বীচে একটু হাঁটাহাঁটি,, ছবি তোলার পরেই বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেল। ছুটির দিনে এই সময় ঘুমিয়ে থাকলে ক্ষিদেই পায় না। কিন্তু আজ একে খুব ভোরে ওঠা এবং পুরী শহর ক্ষিদে তো পাবেই।
স্বয়ং ভগবানেরই ভোরবেলায় খুব ক্ষিদে পায় বলে কচু ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খান। তবে পান্তা ভাতে একটু ঘি দেওয়া হয়। আগের দিনের রাতের ভাত বেঁচে যায় তাই সেই ভাত দিয়েই তিনি তাঁর প্রথম প্রাতঃরাশ সারেন। কাউকে কষ্ট দেন না। প্রভুর সেবায় কোন চাপ নেই। আমরা ভাবতে পারি ভোরে ঘুম থেকে উঠেই আগের দিনের বাসি ভাত আর কচু ভাজা খাওয়ার কথা?
প্রভু আমার এমনই। সাজুগুজু করে পেট ভরে ভাত খেয়ে এবার সব্বাই কে দর্শন দিতে বসেন। সব্বার সুখ দুঃখের কথা শোনেন মন দিয়ে। ভক্তদের দুঃখের কথা শুনে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ছলছল চোখে প্রভু বলে ওঠেন,,
আমার তো কোন হাত নেই। তুমি যা কর্ম করেছ তার ফল ভোগ তো তোমাকেই করতে হবে। আমি এখানে কিচ্ছু করতে পারব না। আমি তোমার কথা শুনে তোমার চোখের জল মোছাতে পারি। তোমার মন ভালো করতে পারি, তোমার মনের জোর আনতে পারি, শরীরেরও বল আনতে পারি। তোমার সুখ দুঃখের ভাগ নিতে পারি। কিন্তু কর্মফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে সেটা আমি কিছু করতে পারব না। গত জন্মের পাপের ফল একমাত্র তোমাকেই ভোগ করতে হবে।
তোমার কর্ম ফল ভোগের সময় আমি তোমার পাশেই থাকব। তোমার হাত ধরে থাকব কিন্তু শরীর মনের কষ্ট যন্ত্রণা সেটা নেব না। সেই ভোগ তোমার।
তোমার সুখ দুঃখের ভাগ নেওয়া মানে তুমি কর্মফল ভোগ থেকে মুক্তি পাবে তা নয়। সুখের সময়ে যেমন থাকব দুঃখের সময়েও আমি তোমার সঙ্গেই থাকব। কষ্ট ভোগের সময় তোমার চোখের জল দেখে আমারও চোখ ভিজে যাবে। তোমার জন্য দুঃখিত হব। তোমার চোখের জলও মুছিয়ে দেব। সাহস দেব জীবন যুদ্ধে লড়াই করার। আমি সর্বক্ষণ তোমার সাথেই থাকব তোমার মধ্যেই থাকব। তোমাকে কিন্তু আমার থাকাটাকে অনুভব করতে হবে। যেদিন তুমি অনুভব করবে আমার উপস্থিতি সেইদিন দেখবে সব দুঃখ শোক থেকে তুমি মুক্তি পেয়ে গেছ।
আমাদের জীবনটা একটা খাতার মতো। যেখানে আমাদের সব কিছুই লেখা আছে। ভগবান বার বার বলছেন সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত। আমার জন্ম থেকে আমার মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছু। কিন্তু,,, কিন্তু,, সেই খাতায় কিছু পাতা কিন্তু খালি থাকে যেখানে কিচ্ছু লেখা থাকে না। ভগবান তোমাকে বোধ বুদ্ধি বিবেক দিয়েছেন একটা উন্নত মস্তিষ্ক দিয়েছেন একটা বড়ো হৃদয় দিয়েছেন যে হৃদয় দিয়ে মস্তিষ্কের চালনায় তুমি ঠিক ভুলের তফাৎ করতে পারবে। ভগবান তোমাকে এই জগতের শ্রেষ্ঠ জীব বানিয়েছেন। তুমি পাপ পূণ্যের তফাৎ জান। তুমি ভালো কর্ম খারাপ কর্মও জান। বুঝতে পার। তোমাকে ছোট থেকেই সেটা শেখানো হয়। এর পর কর্মের দ্বারা জীবনের এই খালি পাতায় তুমি কি লিখবে সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। ভগবান তোমাকে এই খালি পাতায় তোমার মতো করে যা খুশি লেখার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবার তোমার কাজ হবে সেই খালি পাতা ভর্তি করার।
তুমি ভাবতেই পার ভগবানই সব করান আর ভগবানই যদি সব করান তাহলে আমাকে দিয়ে পাপটাও তিনিই করাচ্ছেন। তাহলে আমার কোন কর্মের জন্য আমি কেন দায়ী থাকব? ভগবানই দায়ী হবেন কারণ তিনি যা করাচ্ছেন আমি তাই করছি। কিন্তু এটা তো ঠিক কথা নয় তাহলে,,,,,
এসব নিয়ে আমি খুব ভেবেছি। ভগবৎ গীতা পড়তে পড়তে কনফিউসড্ হয়ে গেছি। এই যে এত রেপ এত মার্ডার এত নৃশংসতা চলছে সব ভগবান করাচ্ছেন? না না কখনোই নয় এসব হতে পারে না।
এবার আসি আসল কথায়,,,
ভগবান বলছেন আমি জন্ম মৃত্যু নির্ধারণ করি কর্মও নির্ধারণ করি। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছে। তুমি কি করবে সেটা আমি তোমার উপরই ছেড়ে দিলাম। সেখানে আমার কিছু করণীয় নেই।
এই যেমন লেখা আছে তোমার চাকরি হবে কিন্তু তুমি পড়াশুনো করলে না চেষ্টা করলে না ঠিকঠাক। ও আমার কপালে আছে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে বাড়িতে বসে রইলে তাহলে কি তোমার চাকরি হবে? তোমাকে তোমার কর্মটা তো করতেই হবে।
ভগবান তোমাকে উন্নত জীব করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন বোধ বুদ্ধি বিবেক সহ একজন মানুষ।
সে কিনা মানুষ খুন করল রেপ করল। এই অন্যায়ের শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। খাতার ফাঁকা পাতায় তোমার ইচ্ছে মতো তুমি লিখবে। কি লিখবে কী লেখা উচিত সেটা তোমার ব্যাপার। কারণ তুমি বোধবুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ তুমি জানোয়ার নও।
সেই ফাঁকা পাতায় তোমার লেখা,, বলতে পার তোমার কর্মের গুণগত মান তার হিসাব কিতাব লিখবে তুমি নিজে। এ জায়গায় ভগবানের কিচ্ছু করার নেই। তিনি খুব দুঃখ পাবেন এই ভেবে যে এত সুন্দর করে এত যত্ন করে এই মানুষটি কে তৈরি করলাম সে এই কাজ করল!
বাবা মা যেমন তিল তিল করে আমাদের বড়ো করেন মানুষের মতো মানুষ তৈরি করতে পরিশ্রম করে দিনরাত এক করেন সেই আমি যদি তাদের মুখ কালো করে উল্টো পাল্টা কাজ করি তাঁরা দুঃখ পাবেন না? আমার সাফল্যে আমার বাবা মা যেমন আনন্দিত হন আমার বিফলতায় তাঁরা তো দুঃখও পান ঠিক সেইরকম।
আমি কোন জ্ঞান দিচ্ছি না এ সবই ভগবৎ গীতায় বলা আছে। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে একটু একটু করে নিয়ে একটা সারতত্ত্ব বানিয়েছি। এই যেমন সাংখ্যযোগের ৬২ নম্বর শ্লোকে ভগবান বলছেন,,,,,
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামায় ক্রোধোহভিজায়তে।। ৬২
ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কাম থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়।
আবার ৬৩ নম্বর শ্লোকে বলছেন :–
ক্রোধাদ্ ভবতি সন্মোহঃ সন্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।৬৩
ক্রোধ থেকে সম্মোহের উদয় হয়, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম হয়,, আবার স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ হয় এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়ে। অর্থাৎ মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।
সমস্ত টাই মহাপ্রভু বলে দিয়েছেন কিভাবে চলব কিভাবে ভাবব কেমন করে জীবনযাপন করব কী করব কী করব না কোনটা ভুল কোনটা ঠিক কোনটা পাপ কোনটা পুন্য কি করলে কি হবে,, তারপর কী হবে সেটা হলে কী হবে সমস্ত টাই তো বলে দিয়েছেন। এরপর আমরা যদি না শুনি তাঁর কথা আর না মানি তাঁকে,, তাহলে আমার কর্মফলের দায় তিনি কেন নেবেন? আমার সর্বনাশ তো হবেই।
একটু ভেবে দেখব না আমরা? জয় জগন্নাথ ❤️
চলবে