কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

এবারের পুরী ভ্রমণ ৪
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে নানা জনের নানা উপদেশ মনটাকে আমার আরও যেন নাড়িয়ে দিতে লাগলো।
মেয়েরা বলল, তুমি তো প্রায়ই যাচ্ছ। পরের মাসে যাও। এবারের টিকিটটা ক্যানসেল করো।
আবার কখনও আমার কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না আসলে,,, পায়ের এই অবস্থা তো না গেলেই ভালো। দেখ ভেবে কি করবে। তোমার ব্যাপার। আসলে তোমার বাড়াবাড়ি হলে বাবার তো মুশকিল হবে তাইনা?
শাশুড়ি ননদ আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব বাড়ির সবাই কেমন যেন আমার কোর্টে বল রেখে নানা ভাবে খেলতে লাগলো,, বলকে কোর্ট থেকে তুলে কখনো ডিফেন্সে কখনো স্ট্রাইকারে তো কখনো আবার ফ্রি কিক দিতে শুরু করল।
সেই সময় যে আমার মনের অবস্থা কী,, কাউকে বোঝাতে পারবো না।
আমি জগুদাদার দিকে তাকিয়ে জয় জগন্নাথ বলে যাচ্ছি আর চোখ ভর্তি জল নিয়ে হাঁটুতে হাত বোলাচ্ছি। আমার বিশ্বাস জগন্নাথ নাম করে যেকোনো ব্যাথার উপর হাত রাখলেই সে ব্যাথা সারে।
ছোটবেলায় (ডাক্তারের বাড়ি ছাড়া) কারোর বাড়িতেই অত ওষুধ থাকত না। আমাদের বাড়িতেও থাকত না। রাত বিরেতে পেটে ব্যাথা কানে ব্যাথা হলেই মাকে দেখতাম জগন্নাথ জগন্নাথ কৃষ্ণ নারায়ণ মা কালি মা দুর্গা বলতে বলতে ব্যাথার জায়গায় হাত বোলাত। আর বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কেটে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করত আর বলত চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা কর। দেখবি ভালো হয়ে যাবি।
আমিও কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুর ডাকতাম। কানে ব্যাথা হলে মা হ্যারিকেনের উপর কাপড় রেখে গরম সেক আর পেটে ব্যাথা হলে একটু তেল জল নিয়ে পেটে মালিশ করত। কি আরাম হতো আর কী আশ্চর্য পেট ব্যাথাও কমে যেত কানে ব্যাথাও কমে যেত। কোন কোন সময় সাবান ঘষে মালিশ করত পেটে।
পরবর্তীতে হোস্টেলে থাকতে বন্ধুদের পেট মালিশ করে দিতাম তেল জল দিয়ে।
মেয়েদের পেটও ঐ ভাবে মালিশ করেছি।
তো যাইহোক যা বলছিলাম এ সবের মাঝে একদিন সিংহ মশাই আমাকে জিজ্ঞেস করল তাহলে কী করবে পুরীর টিকিট ক্যানসেল করব কি করব না। এখন যাবে নাকি এখন এই টিকিট ক্যানসেল করে পরের মাসে (এপ্রিল) যাওয়ার টিকিট কেটে নিই। ও জানত টিকিট কেটে রাখলে আমি এই টিকিটটা ক্যানসেল করলেও করতে পারি। টিকিট ক্যানসেলের কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল।
হা জগন্নাথ কী দোষ করলাম টিকিট কেটে ক্যানসেল করতে হবে! কী পাপ করলাম যে তুমি আমায় দর্শন দিতে চাও না? আমার কতবড় কাজ তুমি দাঁড়িয়ে থেকে সম্পন্ন করলে না হলে আমি এত সুষ্ঠু ভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম? আমি তো তোমাকে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছি। তোমাকে দর্শন করে তোমার পা দুটো চেপে ধরে বলতে চাইছি ঠাকুর তোমার অসীম দয়া। করুণাময় তোমার দয়া তোমার করুণা তোমার সাহায্য ছাড়া এতবড় কাজ আমি কিছুতেই করতে পারতাম না। আমি কত অসুস্থ ছিলাম সেইসময়! তাও ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক কাজ করার শক্তি পেয়েছি। সে তো তোমার দয়ায় ঠাকুর! এমন ভাবেই তোমার দয়ায় যেন চলে যায় আমার জীবন। আর কিছু চাই না। তুমি ভালো থেকো সব্বাই কে ভালো রেখো। সবার আশা এমনভাবেই পূরণ কোরো। এবারে আমার এইটুকুই চাওয়া । এটুকুও তোমার সামনে গিয়ে বলা হবে না আমার!
সে যে বুকের ভেতর কী তোলপাড়! কী যেন অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন ফাঁকা জায়গায় চিৎকার করে কাঁদি।
সমস্তটা ঢোঁক গিলে আমি খুব শান্ত গলায় সিংহকে বললুম তুমি আমাকে গ্যারান্টি দিতে পার যে আমি পরের মাসে বাঁচবই। ও বলল সে কি কথা বাঁচবে না কেন? নিশ্চয়ই বাঁচবে। তবে গ্যারান্টি ভগবান ছাড়া কেউ দিতে পারে না।
আমি বললুম এক মিনিট পড়ে কি হবে জানা নেই কারোর। তুমি বলছ নিশ্চয়ই বাঁচব? ঠিক আছে যাব না কিন্তু যদি মরে যাই তাহলে জগন্নাথ দর্শনে বাধা দেওয়ার পাপ লাগবে তোমার। আমি মড়ার সময় তোমায় দোষী করে যাব।
সিংহ হঠাৎ কেবলে গিয়ে বলল ওরে বাবা চল চল আমি কোন গ্যারান্টি দিতে পারছি না। আর কত পাপ করেছি জীবনে অজান্তেই,, নতুন করে আর পাপ কামাতে চাই না।
আমি একটা বিজ্ঞের হাসি হেসে আমার জগু দাদার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে আর একটু হেসে বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে বাকি থেকে যাওয়া ওয়েব সিরিজে মন দিলাম আমি।
এই ঘটনা শোনার পর অনেকেই আমাকে ব্ল্যাকমেলার ভাবতেই পারে। কিন্তু আমি সেসব মনেও আনি না। কারণ আমার মহাপ্রভু দর্শনের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।
আমার যাওয়া ফাইনাল হলো। তবে এটা ঠিক তখন আমার পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। ভীষণই পায়ে ব্যাথা। হাঁটুর যন্ত্রণা, হাঁটতে কষ্ট। তার উপর ডাক্তার বাবু বলেছেন হাঁটুর মাঝের জেল সব বেড়িয়ে গিয়ে পায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হাঁটু শুকিয়ে যাচ্ছে তাই ঘষা লেগে ব্যাথা হচ্ছে। ইমিডিয়েট ডান পা কে রেস্টে রাখতে হবে। পা রেস্ট পেলেই ছেঁড়া কচকচি জোড়া লাগলেও লাগতে পারে । লাগবেই অবশ্য সেরকম কোন গ্যারান্টি দেন নি। কিন্তু ঐ যেভাবে হোক যেমন করেই হোক দর্শন আমায় করতেই হবে। এই পা নিয়েই।
যাইহোক ভগবানের দয়ায় কোথা থেকে যেন অসম্ভব মনে জোর পেয়েছিলাম। যাওয়ার আগের দিন আসার টিকিট কনফার্ম হওয়ার নোটিফিকেশন এল । যাওয়ার সময় দুজনেরই আপার বার্থ। একটু চিন্তায় আছি দুজনে।
লোয়ার বার্থ আমার ছোট মেয়ে পেয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার আমি বুড়ো মানুষ আমাকে কোথায় লোয়ার বার্থ দেবে তা না আপার বার্থ দিল। কি করব ভেবে পাচ্ছি না। ব্যাথা পায়ে ঐ উপরে ওঠা। তারপর ডাক্তার দেখিয়ে আমি কিছুটা হলেও মানসিক এবং শারীরিক ভাবে নড়বড়ে হয়ে গেছি। একটা হালকা চাপা টেনশন। যদিও জানি ভগবান যা ভালো বুঝবেন করবেন তবু,,,,,
সিংহ মশাই বলল এসি টু টায়ার খুব উঁচু না এটুকু উঠতে পারবে না? দুপুরে আমার মেয়ে জানালো ও যেতে পারবে না। ওর টিকিট টা ক্যানসেল করতেই আমাকে রেল লোয়ার বার্থ দিল।
কি মিরাকল ঘটনা! যে আর এ সি তে আছে সে তো পাবে কিন্তু আমি কিভাবে পেলাম বুঝতেই পারলাম না।
এবার বেশ নিশ্চিন্তে টুকিটাকি সামান্য কিছু একটা ব্যাগে ভরে, ওলা নিয়ে,, রাতের খাবার কিনে, সিংহ কে অফিস থেকে তুলে,, সোজা সাঁতরাগাছি থেকে রাত সারে নটার স্পেশাল ট্রেনে উঠে বসলুম।
মনে অসম্ভব জোর আর আনন্দ হচ্ছিল শেষ পর্যন্ত ট্রেনে উঠেছি কাল সকালে আমার প্রভুর দেশে প্রভুর কাছে পৌঁছে যাব। বিকেলে দর্শন হবে। বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। রাতে ভাবছিলাম শুয়ে শুয়ে এতবার যাই এত বার তাঁর দর্শন করি কিন্তু পুরোনো লাগে না কিছুই। প্রতিবারই মনে হয় এই প্রথম দর্শন করব। ঠিকঠাক দেখা পাব তো ঠাকুরের,, বেঁটে মানুষ অত ভীড়ে অত লম্বা লম্বা মানুষের পেছনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখতে পাব তো? তাহলে যে সময় একটু ফাঁকা হবে সেই সময় যেতে হবে। কত পরিকল্পনা বাপরে বাপ।
এতদিন দেখতে না পেলে সিংহ পেছন থেকে কোলে তুলে দেখাত আমার মহাপ্রভুকে। এখন ওর বয়স হচ্ছে আর আমি কত মোটাও হয়ে গেছি এত ভারী তোলা ঠিক না।
এত সব ভাবতে ভাবতে একসময় খুব ক্লান্ত আমি জগন্নাথ জগন্নাথ বলতে বলতে আর দর্শনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো। ট্রেন লেটে চলছে। ভোর সারে চারটের বদলে পৌনে ছয়টায় পৌঁছালাম। হোটেল পেতে আটটা বেজে গেল।
হোটেল বুকিং ছিল না। একদিনের জন্য ভিক্টোরিয়া ছাড়া কেউ দেয় না। ভিক্টোরিয়া ফুল ছিল। কপাল ঠুকে পার্কে চলে এলাম। আর পেয়েও গেলাম একটা ঘর। জয় জগন্নাথ ❤️
চলবে।