সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ৩২)

আমার মেয়েবেলা

ফিরে দেখা (আমার ফরাক্কা ,,,আমাদের ফরাক্কা)

আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিছু কিছু মুহূর্ত,,এতটা স্মরণীয় হয়ে রয়ে যায় যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারা যায় না । রয়ে যায় অনেক কিছুই, মনের আনাচে কানাচে।

যে স্মৃতি আমাদের মনে সুখ এনে দেয়, যে স্মৃতি আমাদের নিয়ে যায় সেই কৈশোরের সারল্যে,, বা যৌবনের উদ্দামতায়,, সেই স্মৃতির তো কখনই মৃত্যু হয় না,, চলে যায় না বিস্মৃতির আড়ালে,, সে আজীবন আমাদের মণিকোঠায় বাস করে,,

বয়স যত বাড়তে থাকে,, সেই সুখ স্মৃতি যেন আমাদের নতুন করে ফেলা আসা জীবনে ফিরিয়ে দেয় আনন্দ, তৃপ্তি, ভালোবাসা। একটা যেন অসম্ভব ভালোলাগা ফিরিয়ে দেয় একটু একটু করে । জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সেই দিনটার কথা মনে করলে, মন যেন কেমন একটা ভালোলাগায় ভাসতে থাকে ।মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা ,,

শৈশবের দিন গুলো যে ভাবে কাটিয়েছি,, আর হয়তো কোনও দিন ই তেমন ভাবে কাটাতে পারব না ।
সেই আনন্দ,, সেই বাঁধন ছাড়া খুশি,, সেই উচ্ছ্বাস,, সেই পাগলামি আর হয়তো কোনও দিন ই ফিরে আসবে না এই জীবনে,
ফিরে আসবে না অনেক অনেক বছর পর সেই ভালোবাসার শৈশবের মাটিতে প্রথম পা রাখার অসাধারণ অনুভূতি!!
না। সেই অনুভূতি আর কখনও কোনও দিনও ফিরে পাব না ।

হয়তো আবার গেলাম সেই স্বপ্নের দেশে। শৈশব কে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে। একটু যেন নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে। ফেলে যাওয়া স্মৃতি গুলো নিয়ে নতুন করে ভাসতে। বার বার, হয়তো প্রতি বছরই গেলাম তাকে ছোঁয়ার আনন্দে।
কিন্তু দীর্ঘ ৩৫ বছর পর জীবনের শেষে এসে,, আবার নতুন করে প্রথম যে ছোঁয়ার অনুভূতি! সেই অনুভূতি কি আর ফিরে পাওয়া যায়?

কিংবা 41 বছর পর আমার সেই চেনা মাটির গন্ধ,,সেই গঙ্গার দাপিয়ে ছুটে চলা। তারই বুকের উপর ১০৯ টি গেট যুক্ত পৃথিবী বিখ্যাত বিশাল বাঁধ,,, ঝকঝকে পিচের পরিষ্কার রাস্তা,, নিরাপত্তারক্ষীর নজরদারি।

আবার শৈশব কে আর একটু কাছে পেতে ১১ টা গেটের হাতছানি,,জলচ্ছাসের গর্জন,,নির্জন শুনশান পিচঢালা রাস্তা,ভোরের কুয়াশার আদর,, সেই চেনা হাড় কাঁপানো শীত,,,,ঘুঘু পাখির ডাক,,গাছেদের ফিসফিসানি,, আকন্দ, ধুতুরার জঙ্গল। কোকিলের কুহু,,
বুনো ফুলের গন্ধ,,কাক,,, শালিকের ব্যস্ততা,চরা পড়া গঙ্গার বিশালতা,, দূরের ছোট্ট ঐ নৌকো টা,,

গঙ্গার ধারে ডান পাশে সেই ঝুরিপড়া বুড়ো বটগাছ টা! যে আমাদের সবার কত সুখ বা বেদনার মুহূর্তের সাক্ষী নিয়ে আজও তেমনি ভাবে,ঠায় দাঁড়িয়ে! স্কুলের মাঠে সারি সারি টিয়া ,বক!!!! কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি,, এই যে এত গুলো বছর পার করে,,,জীবনের অবসরে এসে যেভাবে তাকে প্রথম ছোঁয়া? এই অনুভূতি কি আর পাব কোনও দিন?

এত বছর পর আবার সেই জন্মভূমিতে। উদ্দেশ্য নিজের দেশের মাটি ছোঁয়া, একটু যেন মেখে নেওয়া।
এত বছরের সম্পর্কের হিসেব টা,, পুষিয়ে নেওয়া, প্রথম এই এই দেশের মাটিতে পা ফেলে?

প্রথম তো প্রথম ই হয়,তার সঙ্গে কি কোনও কিছুর তুলনা চলে?
প্রথম হাঁটতে শেখা,,
প্রথম বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম ফার্স্ট হওয়া,প্রথম ভালোলাগা,প্রথম স্টেজে গান গাওয়া,,
কিংবা প্রথম বাজারের পয়সা
(20/50 পয়সা) পকেটে পুরে, বন্ধু দের সঙ্গে সেই প্রথম একটা সিগারেট,,

কোনও এক শীতের সন্ধ্যায়, কোচিং থেকে ফেরার সময় নির্জন রাস্তায়, প্রথম চুম্বন!!
জীবনের প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ,,অথবা প্রথম কাউকে লাজুক গলায় চোখ বন্ধ করে এক নিমেষে বলে ফেলা,, “আমি তোমায় ভালোবাসি”

কিংবা কারোর জন্য প্রথম বুকের মধ্যে মোচড়ানো যন্ত্রণা,,,
প্রথম বড়ো হওয়া? দম বন্ধ করে আগে স্কুলে গিয়ে চোখে মুখে সর্বজয়ের সবজান্তা ভাব দেখিয়ে অহংকার চোখে বন্ধু দের জানানো?????
পরিস্থিতির চাপে প্রথম ভালোবাসা কে , প্রথম বার ঢোঁক গিলে বুকের মধ্যে সারাজীবন আটকে রাখা,,,
কিংবা প্রথম মা/ বাবা হওয়ার অনুভূতি? প্রথম মা ডাক!

না। প্রথম একমাত্র প্রথম ই হয়।। প্রথমের সঙ্গে কখনও কারোর তুলনা হয় না।
এর অনুভূতি আর কখনও কোনও দিন ও আসবে না আমাদের জীবনে।।

এ সবকিছুর প্রথম ই তো ঘটে গিয়েছে এই ছোট্ট শহরে। তাকে তো কিছু তেই ভোলা যায় না। আমাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ই তো ঐ জায়গার আনাচে কানাচে । যেদিকে ই তাকাই শুধু ফ্ল্যাশব্যাকে যেন নিজেকে ই দেখা,, নিজেকেই খোঁজা।

35 বছর পর গৌর এক্সপ্রেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত যেন দ্রুতগামী হয়েছিল,
সেই গৌর এক্সপ্রেস!
যে নামটা শুনলে বুকে যেন একটা খোঁচা লাগে,,, কিসের খোঁচা ,তা বলতে পারব না,,
একটা যেন ভালোলাগা,কেমন যেন অসম্ভব ভালোবাসার খোঁচা,একটা যেন হাহাকার , বুকের মধ্যে যেন রক্ত ঝড়ার যন্ত্রণা ,,একটা কেমন যেন মায়া মায়া টান।।

এত জায়গা দেখলাম, থাকলাম, কিন্তু ঐ ছোট্ট শহর টার মতো তো, আর কোথাও এমন ভালোলাগা জন্মালো না? কেন ভালোবাসতে পারলাম না আর কোনও শহর কে? যে শহরে আমি এতগুলো বছর কাটালাম,, সেই শহর টাকেও তো আপন করতে পারলাম না, অথচ ঐ ছোট্ট শহরে আমি থেকেছি মাত্র কয়েক বছর। কেন এমন হয়?

কেন গৌর এক্সপ্রেস নাম টা শুনলেই সেই ছোট্ট শহর টাকে মনে করিয়ে দেয়? যেন ঐ ছোট্ট শহর টার জন্য ই তৈরি হয়েছিল,,এই গৌর এক্সপ্রেস!

মাঝে কত স্টেশন আসে ,, যায়,, কিন্তু কোনও দিন ই সেভাবে গুরুত্ব দিই নি। শুধু মনে থাকে সেই “ফরাক্কা স্টেশন”,, যেখানে আমি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ বোধ করি।

হ্যাঁ । সেই ফরাক্কা,, যেখানের মাটির গন্ধ আমার চেনা,, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি,,বৃষ্টি হবে,,
যেখানের ফুলের গন্ধে, এখনও মন মাতোয়ারা হয়, প্রথম ভালোবাসার কথা মনে পড়ে যায়,,

গঙ্গার ধারের কুয়াশায় ঢাকা,, এবং দুপাশে নুইয়ে পড়া গাছের ছায়ায়,,আধো অন্ধকার পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তা দেখলে,,,,,
মনে হয় এতো কোনও বিখ্যাত পাহাড়ি রাস্তা থেকে কম কিছু নয়?

বড়ো সখ করে আমার এক বান্ধবী কে একদিন বলেছিলাম,, ” লন্ডনে র টেমস এর ধারে বসে আমার সেই কবিতাটা তোকে শোনাব। যেটা আমি লিখে ছিলাম আমার প্রথম ভালোবাসার কথা ভেবে।”

“ভালোবাস বলেই না আছি? ঠিক এমন ভাবে?
যেভাবে সূর্যের প্রথম আলো ছুটোছুটি করে, পাহাড়ের চূড়ায় ।
অশান্ত ঢেউ সমুদ্রের বুকে দাপিয়ে বেড়ায়?
চাইলেও শান্ত করা যায় না!
আমি তেমন ই এক ঘূর্ণি ঝড়।
তোমার সব কিছু ওলটপালট করে দি মুহূর্তের মধ্যে ।
ভালোবাস বলেই তো?”

এখন মনে হয় আমাদের গঙ্গার ধারটাই বা কম কিসের? যেখানের জল, হাওয়া, মাটি সাক্ষী দেয় আমার বড়ো হওয়া!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।