ক্যাফে ধারাবাহিক গল্পে সুকুমার রুজ (পর্ব – ৪)

ম্যারিটাল প্লাস্টার
ওর মুখ দিয়ে এখন কথা বেরোচ্ছে — আচ্ছা দাদা! বলুন তো বিদেশিনি কি গালাগালি? আজকাল বিদেশি মাল, মানে ফরেন গুডস এরই তো কদর বেশি!
কী! আপনি আমাকে মাল বললেন! আপনি একটা মাল, আপনি… আপনি একটা পয়মাল। আপনি একটা হিপোপটেমাস।
এমন সময় নেপাল পর্দার ফাঁক দিয়ে মুণ্ডু বের করে — দু’নম্বরে আছেন গদাধর মাল, আসুন!
টাকমাথার রাগ আবার সপ্তমে উঠেছে। কিছু বলতে পারে না। ঘোঁতঘোঁত করতে করতে ডাক্তারের ঘরে ঢুকে যায়।
সবে গদাধর মাল ডাক্তারের পাশের টুলে বসেছে, এমন সময় গটগট করে রোগী-বসার ঘরে ঢোকে মুশকো চেহারার জনা পাঁচেক ছেলে। ওদের বাজখাই গলা — ব্যাটা ডাক্তারের ডাক্তারি আজ ছুটিয়ে দেবো। এই যে! ডাক্তার কোন্ ঘরে?
একজন ইশারায় ডাক্তারের ঘর দেখায়। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে নেপালের দিকে ডাক্তারের চোখের ইশারা। নেপাল বেরিয়ে আসে — কী হয়েছে? আপনারা অমন হাঁকড়াচ্ছেন কেন? নাম লিখিয়ে বসুন চুপচাপ!
আমরা নাম লেখাতে আসিনি। বাপের নাম ভোলাতে এসেছি। তুমি ডাক্তার?
না আমি এখনো ডাক্তার হইনি। ট্রেনিং চলছে। ডাক্তার হবো।
ও হবু ডাক্তার! তা তোমার গবু ডাক্তার কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে?
উনি এখন রোগী দেখছেন। আপনারা কি দেখাবেন?
হ্যাঁ দেখাবো। তবে অসুখ নয়, তোমার ওই গবু ডাক্তারকে ত্রিভুবন দেখাবো। ব্যাটা ডাক্তার নয়, খুনী। আমাদের পাড়ার ‘বৃদ্ধ কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি’ নিঞ্জু পালকে ভুলভাল ওষুধ দিয়ে মেরে ফেলেছে।
ও নিঞ্জু পাল, মানে সেই বুড়োটা! যাকে ভিরেট্রাম এলবাম…।
না না, ও সব বুজরুকি ছাড়ো! কে বলেছে ভিড়ের ট্রামে উঠে পটকে গিয়ে এলবামে জায়গা পেয়েছে। দু’মাস ধরে সে বিছানায় পড়ে। ওই একবারই যা তোমাদের গবু ডাক্তারের কাছে দেখাতে এসেছিল।
হ্যাঁ, তখনই তো ভিরেট্রাম এ্যালবাম হানড্রেড দেওয়া হয়েছিল।
ওই ওষুধ খাওয়ার পরই ফুটে গিয়ে ছবি হয়ে গেছে। ‘ট্রিটমেন্ট’ কাকে বলে দেখাচ্ছি, ডাকো শালাকে! দেখুন, আপনারা ভুল করছেন; ওনার বয়স হয়েছিল তাই…।
ও! আর আমাদের বয়স হয়নি? আমরা কচি খোকা! যা বোঝাবে তা ই বুঝবো?
তা নয়। ডাক্তারবাবু তো ভালোই চিকিৎসা করেন। তাই বলছিলাম…।
তাহলে তুমিই ব্যাটা হবু ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিলে কায়দা মেরে। তোমাকেই উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে…।
এই, না-না, আপনারা ভুল করছেন। আমি কমপাণ্ডারি করি।
পাণ্ডাগিরি কম আর কোথায় করছ, বেশি-পাণ্ডাগিরিই তো করছ। বেশি ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে এখানেই পিটিয়ে পরোটা বানাবো তোমাকে।
নেপাল আর ডিফেন্স করতে পারে না। বেগতিক বুঝে ও ঘরের ভেতরে সটকান্ দেয়। ষণ্ডামার্কাগুলোও ওকে তারা করে হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে।
ইতিমধ্যে ছেলেগুলোর গরমাগরম কথা ডাক্তারের কানে গেছে। ওই কথার ঝাঁঝেই ডাক্তারের মাথা ঝিমঝিম, তলপেট চিনচিন শুরু করেছে। ‘গদাধরবাবু! দু’মিনিট, বাথরুম থেকে আসছি’ — বলে ডাক্তার ভেতর ঘরে পিঠটান দিয়েছে। গদাধর মাল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল — ‘ডাক্তারবাবু! আমিও বাথরুম…’।
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ধড়াম করে ভেতর ঘরের দরজা বন্ধ হয়েছিল। নিরুপায় হয়ে গদাধর ভয়ে ডাক্তারের চেয়ারের আড়ালে লুকিয়েছে। এমন সময় নেপালকে তাড়া করে ছেলেগুলো ঘরে ঢোকে। গদাধরকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে একজন বলে ওঠে — ওই তো ডাক্তার! ঘাপটি মেরে বসে। ধর শালাকে।
সবাই গদাধরকে টেনে হিঁচড়ে বের করতে ছোটে। এই সুযোগে নেপাল একছুটে পগার পাড়। গদাধর চি-চিঁ করে ওঠে — আমাকে ছেড়ে দাও আমি ডাক্তার নই, গদাধর মাল। তুমি যে ‘মাল’ তা কী আর বুঝিনি। বেরোও ব্যাটা।
গদাধর ভয়ে বেরোয় না। এদের দু’জন টেবিলের তলা দিয়ে গদাধরকে ঘেটি ধরে টান মারে। গাবদা-গোবদা গদাধরের গুরুভার পাছা আটকে যায় চেয়ারের ফাঁকে। গদাধর কঁকিয়ে ওঠে — ছাড়ো ছাড়ো, লাগছে, আটকে গেছে।
ওরা দাবড়ানি দেয়— থাম ব্যাটা! তলায় মুণ্ডু গলাতে কে বলেছিল? এই পটলা, চেয়ারটা ধরে নাড়া তো! নাড়াতে নাড়াতে ঠিক বেরিয়ে যাবে।
দু’জন নাড়াতে থাকে প্রাণপণে। তবুও চেয়ারের পা দুটো আঁকড়ে ধরে আছে গদাধরের পাছা। নেতাগোছের ছেলেটা বলে — দাঁড়া, ওভাবে হবে না। তোরা চেয়ারটা শক্ত করে ধরে থাকিস! — এই ব’লে ও ছুটে এসে গদাধরের পাছায় মারে গদাম করে এক লাথি। গদাধর ‘আঁক’ করে ওঠে। কিন্তু চেয়ারের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। এখন সে ওদের কবলে। ওরা বলে — এবার তোমাকে পেঁদিয়ে হালুয়া বানাব। চল শালা।
এদিকে ডাক্তার গোবর্ধন সরখেল পাশের ঘরে সটকে পড়ে ফোন করে— হ্যাঁলো পুলিশ স্টেশন। আমি ডাক্তার জি ডি সরখেল। খুব বিপদে পড়েছি। পুলিশি হেল্প চাই।
আপনি মশাই হাসালেন। পুলিশি হেলপ কি ছেলের হাতে মোয়া, যে চাইলেই পাবেন? আপনি কী এমন তালেবর যে পুলিশি হেল্প চাইছেন!
আমি? আমি একজন ডাক্তার, আপনার এলাকার নাগরিক আমি…।
শুনুন শুনুন, অত উত্তেজিত হবেন না। আমার এলাকায় আট লক্ষ নাগরিক আছে। থানায় স্টাফ সাড়ে আঠারো। এই ম্যানপাওয়ার দিয়ে সবাইকে কি হেলপ করা সম্ভব? সম্ভব নয়। তাই আমাদের একটু বেছেবুছে ঠিক করতে হয় কাকে হেল্প করা যায়। আপনি যদি কোনো মন্ত্রী, এম এল এ নিদেনপক্ষে কাউন্সিলার হতেন, কিংবা স্মাগলার, রবার-গ্যাং লিডার, মাফিয়া কিংবা নিদেনপক্ষে তোলাবাজও হতেন তাহলে পুলিশি হেলপ পেতেন। সামান্য একজন ডাক্তার হয়ে পুলিশি-হেল্প চাইছেন।
আসলে আমার খুব বিপদ স্যার। একদল গুণ্ডা আমার চেম্বারে ঢুকে ভাঙচুর চালাচ্ছে তাই…। গুণ্ডা! ওরা কোন পার্টির লোক?
ওরা স্যার এক পেশেন্ট-পার্টির লোক। পেশেন্টটা টেঁসে যেতে আমি ফেঁসে গেছি। ওরা বলছে আমি নাকি মেরে ফেলেছি। তাই এসে…।
ও! এ কেস অফ মার্ডার!
আপনি মার্ডার বলছেন কেন? আমি সিওর, পেশেন্টটা কিওর হওয়ার মতো ছিল না। তবে ট্রিটমেন্ট করতে গেলেন কেন?
আমি তো যাইনি। নিজেই এসেছিল রিক্সা করে।
ব্যস! অমনি দিলেন সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে!
সিরিঞ্জ নয়, দানা…।
সে কী মশাই! দানা ঢুকিয়ে দিলেন? তাহলে আপনি আমাদের হেল্প পাওয়ার লিস্টে তো চলেই এলেন। তা মেশিনটা লাইসেন্সের না বিনা লাইসেন্সের?
কী বলছেন যা তা! দানা ঢোকাতে যাবো কেন? দানা খাইয়েছিলাম। আমি হোমিওপ্যাথ।
ও! হোমো। তাহলে তো সিরিঞ্জ ঢোকানোর ব্যাপার নেই। শুধু দানা চুষতে দিয়েই খ্যাচাকলে ফেঁসে গেলেন?
ওষুধ তো দিয়েছি দু’মাস আগে। কিন্তু আজকে এসে…।
হোমোপ্যাথির অ্যাকশন একটু দেরিতেই হয়।
কিন্তু স্যার পুলিশি অ্যাকশন নিতে দেরি করলে আমাকে ওরা মাইকেল জ্যাকসনের নাচ নাচিয়ে ছাড়বে।
ঠিক আছে, আমরা ওদেরকেও বাঁদরনাচ নাচাবো। কিছু মালকড়ির ব্যবস্থা রাখুন, আমরা আসছি। ঠিকানাটা বলুন।
এদিকে নেপাল মওকা পেয়ে ছুটে পালানোর সময় ওদের পিছু-ধাওয়া ঠেকাতে, বাইরের দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ করে হ্যাজবোল্ট লাগিয়ে দিয়ে পালিয়েছে। তারাচাঁদ-লক্ষ্মীমনিরা পালাতে গিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ওরা চিৎকার শুরু করে দরজা খোলো — কে আছো দরজা খোলো। মেরে ফেলল। দরজা খোলো।
ছেলেগুলো গদাধর মালকে টেনে হিঁচড়ে বসার ঘরে নিয়ে এসেছে। গদাধরের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছে না। ও শুধু আঁ-আঁ করে যাচ্ছে।
অ্যাই! তোমরা চিল্লাচ্ছ কেন? থামো! কে মেরেছে তোমাদের?
ওদের দাবড়ানিতে লাল-জামা, নীল-পাঞ্জাবীরা চুপ! তারাচাঁদের সাহস লিক করে — বাইরে থেকে দরজা বন্ধ তাই…।
বন্ধ! নিশ্চয় ওই কমপাণ্ডার ব্যাটার কাজ। তাহলে এ ব্যাটাকে এখানেই পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখাবো— এই বলে গদাধরের গর্দানে এক রদ্দা মারে। গদাধর ‘ওঁক করে ওঠে। তারাচাঁদ প্রতিবাদ করে — তোমরা ওকে মারছ কেন?
তাতে তোমার মার্বেল টনটনাচ্ছে কেন?
না, মানে ও তো ডাক্তার নয়!
তা কি তোমার কাছে জানতে হবে? আমরা বুঝি না! ও ডাক্তার হলে কী নিঞ্জুকাকা মরতো? ব্যাটা ফলস ডিগ্রি লিখে ডাক্তারের দলে ভিড়েছে।
না না, ও তো ডাক্তারের দলে নয়, আমাদের দলে— মানে রুগির দলে।
পাঁচজনেই থমকায় — এ ব্যাটা তাহলে ডাক্তার নয়?
ও রুগি! তবে ডাক্তার কোথায় গেল?
ঘরেই তো ছিল। তাহলে হয়তো ভেতর দরজা দিয়ে কেটে পড়েছে।
কেটে পড়েছে? বলে ওরা আবার রুগি দেখার ঘরে ঢোকে। ভেতরের দরজা ঠেলে। দরজা বন্ধ দেখে ওরা চেয়ার, টেবিল ভেঙে তছনছ করে দেয়। তুলকালাম কাণ্ড করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
এরা পাঁচজন তো ভয়ে তটস্থ। তারাচাঁদ ভয়ে ভয়ে বলে — আমাদের ছেড়ে দাও বাবা!
দাঁড়াও দাঁড়াও, সব ব্যবস্থা হচ্ছে। ছাড়লে যাবেই বা কোনদিকে? দরজা তো বন্ধ। তোমরা বাওয়াল করো না। বোসো। দেখছি কী করা যায়।
গদাধর মাল এক নাগাড়ে আঁ-আঁ করেই চলেছে। ওকে একজন দাবড়ানি দেয় — থামো, তোমাকে এমন কিছু প্যাঁদানো হয়নি।
এইসব গোলমালের মধ্যে এতক্ষণ লক্ষ্মীর দিকে কারও চোখ পড়েনি। এর মধ্যে লক্ষ্মীমনি টেনশনে ও গরমে গায়ের পোশাক খুলে ফেলেছে। হঠাৎ ওকে দেখতে পেয়ে, পাঁচজনের একজন বলে ওঠে — ওরেত্তারা! এ যে দেখি মেয়েছেলেও আছে। বেশ কেলো হল তো! কেউ খাবলেছে নাকি, গা উদলা হয়ে আছে?
ওদের মধ্যে লিডার গোছের ছেলেটা বলে — এই যে বেবি! সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা কোরো না। চুপচাপ শুয়ে থাকো বেঞ্চিতে। নকশা করলে, সব বিলা করে দেব।
লক্ষ্মীমনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে লিডার বলে— পটলা! কেস জণ্ডিস! কিচাইন হয়ে যেতে পারে। চল কাটি।
আরে! কাটব কোন দিকে? এ যে সেই মহাভারত সিরিয়ালের চক্করব্যুহ গুরু! দাঁড়া ব্যবস্থা করছি।
লিডার জানলার কাছে এগোয়— এই যে তোমরা দাঁত বের করে রগড় দেখছ, আর উঁকি দিয়ে মস্তি লুটছ, দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, খুলে দতে পারছ না।
কিছুক্ষণ পর কোনও একজনের সুমতি হয়। এসে বাইরের দরজার হ্যাজবোল্টটা খুলে দেয়। পাঁচ মস্তান ঝটকা মেরে বাইরে। ডাইনে বাঁয়ে, দেখে নেয় একবার। অনেক লোক জমে গেছে। দেখেশুনে ওরা, ‘যা ঝাড়কে’ বলে পাইপাই করে ছুট লাগায়। কয়েকজন কিছু না জেনে বুঝেই, ‘ধর-ধর পালাল’ বলে চিৎকার করতে করতে তাড়া করে। ওদের পেছনে পাড়ার নেড়িকুত্তাটাও ভৌ-ভৌ করতে করতে কিছুটা ছুটে যায়।
তারাচাঁদ ধ্বজাধারি, লাল জামা, নীল পাঞ্জাবী এবং গদাধর মাল ঘরের ভেতর নিজেদেরকে আর নিরাপদ মনে করে না লক্ষ্মীমনির ওই অবস্থা দেখে। ওরা ঝটপট বেরিয়ে আসে। ওদেরকে ঘিরে ধরে সবাই — দাদা কী কেস? কাউকে ফিনিশ করেছে নাকি? নিশ্চয় মেয়েছেলে কেস?
চারজনকে চল্লিশজনে ঘিরে ধরে, ঘটনা জানার মিনিট পাঁচেক পরে, বড় রাস্তার মোড়ে, তর্কে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পাড়ার ভ্যাবলা আর হরে।