ছেলেটি ভর্তি হল বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাই স্কুলে। যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, স্কুলের দেয়াল পত্রিকা ‘সপ্তমীকা’ পত্রিকার সম্পাদক। তার ওপর লেখা প্রকাশ করার দায়িত্বভার। ছেলেটি 1945 খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ওই স্কুল থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। ঠিক তার পরের বছর ধরা পড়ল তার শরীরের ক্ষয় রোগ। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। অক্ষম দেহ নিয়েও অক্লান্তভাবে তবু তার কবিতা লেখার বিরাম নেই। অল্প বয়সেই কৃষাণ -মজুর -শ্রমিকদের যন্ত্রণার শরিক। তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশের নানাপ্রান্তে কিশোর বাহিনী নামে কিশোর সংগঠন তৈরি হয়েছে। সেই সময়কার ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ‘কিশোর সভা’ বিভাগের সম্পাদনার দায়িত্বভার তার উপর ন্যস্ত।
কে এই ছেলেটি ? মার্কসবাদী চিন্তাধারায় ভাবিত । শ্রমিক – কৃষক – মজদুরের যন্ত্রণার শরিক । শরীরে ক্ষয় রােগ নিয়েও এই বিশ্বাসের ভূমি থেকে এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকেনি । এই কবি চোখে দেখে যেতে পারেননি স্বাধীনতার নবােদিত সূর্যকে । তখনও স্বাধীনতার কয়েক মাস বাকি । তিনি যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে একটি কক্ষে শয্যাশায়ী । মাত্র ২১ বছর বয়সে কবিকৃতির বিপুল সম্ভাবনার সূচনা পর্বে ১৩ই মে ১৯৪৭ খ্রিঃ তার জীবন দীপ নির্বাপিত হয়।
ছেলেটি সুকান্ত। তার তেরাে বছর বয়সে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। তিনি দেখেছেন বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন , ছেচল্লিশের নৌ বিদ্রোহ এবং হিন্দু – মুসলমান রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা।
সুকান্তর কাব্যগ্রন্থ — ছাড়পত্র , ঘুম নেই , পূর্বভাস , মিঠে – কড়া , অভিযান , হরতাল , গীতিগুচ্ছ প্রভৃতি । কবি সুকান্ত রাজনীতির এক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই সেই আদর্শের প্রতি ছিল তার নিষ্ঠা। সেজন্য কিছু মানুষ তার কবিতাকে বিদ্বেষবশত রাজনীতির স্লোগান বলে প্রচার করতে চান। তার উত্তরে অগ্রজ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় । বলেছেন— “ কবিতার জাত যাবার ভয়ে স্লোগানগুলােকে রেখে ঢেকে সে ব্যবহার করেনি। হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত – প্রতিধ্বনিত যে ভাষা হাজার হাজার মানুষের নানা আবেগের তরঙ্গ তুলেছে , তাকে কবিতায় সাদরে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলেই সুকান্ত সার্থক কবি।
সেই ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়— যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানব সভ্যতার আশীর্বাদ-অভিশাপ।একদিন আমাদের সবাইকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে কিন্তু ইতিহাস থেকে যাবে। আর সেই জন্য বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সুকান্তকে আমি ভালোবেসেছিলুম, যেমন করে প্রৌঢ় কবি তরুণ কবিকে ভালোবাসে।’ বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের ছন্দজ্ঞানেরও প্রশংসা করেছেন। মনে-মনে তিনি সুকান্তকে জায়গা দিয়েছিলেন জাত-কবিদের ক্লাসে। উঁচু পর্দায় আশাও দেখেছিলেন। কিন্তু এরপরই বলছেন, ‘কিন্তু আশা তো বিশ্বাসঘাতিকা!’ সুকান্তের রাজনৈতিক কাব্য-বিশ্বাস বুদ্ধদেব বাবুকে খুশি করতে পারেনি, বরং ছেলেটি তাঁর কবিতার মতামত চেয়ে অগ্রজ বুদ্ধদেব বসুর কাছে যখন একটি পোস্টকার্ড পাঠালেন, তিনি উত্তরে লিখলেন, ‘রাজনৈতিক পদ্য লিখে শক্তির অপচয় করছ তুমি; তোমার জন্য দুঃখ হয়।’ আমরা জানি না, এই নির্মম বাক্যটি সুকান্ত কীভাবে নিয়েছিলেন। তবে তাঁর বিশ্বাসকে টলাতে এ কথা পারেনি। কবি হওয়ার চাইতে কমিউনিস্ট হওয়ার বাসনা হয়তো অতিরিক্ত রোমান্টিকতার প্রকাশ হতে পারে, কিন্তু তা চিন্তাগতভাবে সুকান্তের রিক্ততার প্রকাশ নয়।
আজ সেই দিন যেদিন কবিকে কবিতা হারিয়েছিলো। ওনাকে স্মরণ করার অধিকার আমাদের মতো মেরুদণ্ডহীনদের নেই — এ আমার বিশ্বাস।