ক্যাফে ধারাবাহিকে সুকুমার রুজ (পর্ব – ৩)

ম্যারিটাল প্লাস্টার

কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারছি না। এ্যালোপ্যাথি বলল, অপারেশন মাস্ট। করাইনি। প্রথমত অত টাকা নেই। দ্বিতীয়ত ভয় লাগে। তৃতীয়ত…।
বোঝা গেছে, বোঝা গেছে।
না, সবটা বোঝা যায়নি। শুনুন। কবিরাজিতে হাজারো নিয়মবিধি। মেনে চলতে পারিনি। আকুপাংচারে সূচের ব্যথায় হার্ট পাংচার হবার জোগাড়। একদিন গিয়ে আর যাইনি। আর নেচারোপ্যাথি…।
ওহ! এবার বোঝা গেছে। শুনুন! বলছি, কতদিন ধরে এমন হচ্ছে?
তা বছর দুয়েক। কখনো কমে কখনো বাড়ে। এখন তো একেবারে…। মনে হচ্ছে ভেতরে ঘা হয়ে গেছে।
হুঁ, দেখি বড় করে হাঁ করুন তো!
হাঁ করবো?
হ্যাঁ-হ্যাঁ, হাঁ বোঝেন না! মুখটা খুলে অ্যা… করুন।
ডাক্তারবাবু, আমার গলায় কিছু হয়নি। ওই মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে আর আপনি এই মুখ দিয়ে…!
ও আপনি বুঝবেন না। মাঝে-মাঝে সর্দি লাগে?
হ্যাঁ লাগে।
আচ্ছা! আপনার গরম ভালো লাগে না ঠাণ্ডা ভালো লাগে?
আজ্ঞে চা হলে গরম আর সরবৎ হলে ঠাণ্ডা।
ধুর মশাই! তা বলিনি। বলছি ওয়েদার, আবহাওয়া।
ও বুঝেছি। গরমকাল, শীতকাল কোনোটাই ভালো লাগে না। ওই বসন্তকালটাই যা…।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। এবার বলুন ফিনকি দিয়ে বেরোয় না ফোঁটা ফোঁটা?
কখনও ফিনকি, কখনও ফোঁটা। এ ক’দিন দেখছি, ফিনকি দিয়েই বেরোচ্ছে।
হুঁ। দেখি, জুতোজোড়া একটু খুলুন।
আরে মশাই! এখন কী পায়ে রক্ত লেগে রয়েছে নাকি, যে জুতো খুললে দেখতে পাবেন! ধুয়ে ফেলেছি।
রক্ত নয়, নখগুলো একটু দেখবো।
নখ একদম পরিষ্কার। আমি রোজ ঝামা দিয়ে ঘষি তো।
আরে, আপনি একটু কথা কম বলুন না। ভিজিট তো মাত্র কুড়িটাকা। তার সঙ্গে ওষুধ ফ্রি। এত কথা বললে…!
এমন সময় ডাক্তারবাবুর মোবাইল ফোন বেজে ওঠে৷ টেবিল থেকে ফোন তুলে নিয়ে দেখেন — বুবাই কলিং…।
ফোনটা রিসিভ করে বলেন — ঠিক আছে, আপনি বাইরে বসুন। আর পাকিস্তানের লোক-টোক বললাম বলে কিছু মনে করবেন না। একটু ইয়ারকি করলাম আর কি বুঝলেন তারাচাঁদবাবু!
ওদিকে ফোনে বুবাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে — কাকু, আমি তারাচাঁদ নই, আর পাকিস্তানের লোকও নই। আমি বুবাই। আমেরিকা থেকে আজই কলকাতায় পৌঁছেছি।
তারাচাঁদবাবু বলে চলেছেন — না না, মনে করব কেন! আমি তো পাকিস্তান থেকে আসিনি।
ডাক্তার সরখেল মোবাইলফোন কানে গলা চড়ান — ও, মার্কিন মুলুক থেকে সরাসরি? না ভায়া পাকিস্তান?
তারাচাঁদবাবু ঘুরে দাঁড়ান— আপনি কিন্তু ইয়ারকির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন মুলুক আমি কেন, আমার চোদ্দ পুরুষের কেউ যায়নি, কেউ আসেওনি৷
ডাক্তার হাত নাড়েন — আরে, আপনাকে নয়। আপনি মার্কিন মুলুক থেকেও আসেননি, আর পাকিস্তান থেকেও আসেননি।
ফোনে বুবাইয়ের গলায় উষ্মা — ও! এসেছি বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি আর টুকুন দু’জনেই এসেছি। একটু পরেই আপনার সঙ্গে দেখা করছি।
আরে বাবা, কথাটা তোমাকে বলিনি। আমার পেসেন্ট। তুমি এসো।
তারাচাঁদবাবু খাপ্পা — হ্যাঁ, আসব তো নিশ্চয়! তবে ওষুধ নিয়ে।
এবার ডাক্তারবাবু বিরক্ত — ওঃ! এ তো মহা জ্বালাতন! আপনি বাইরে বসুন না! আপনার ওষুধ বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখছেন তো ফোনে কথা বলছি।
ফোনে কি ওষুধ বানানোর কথা বলছেন? মার্কিন, পাকিস্তান নিয়ে পড়েছেন।
ডাক্তার সরখেল মোবাইলফোনটা দু’হাতের তালুতে রেখে জোর হাত করে বলেন — আপনি দয়া করে আসুন। কই হে নেপালচন্দ্র! কোথায় গেলে বাবা! এদিকে এসো।
ওদিকে বুবাই ফোনে গজগজ করে — যাচ্ছি। বাইরে বসব কি ঘরে বসব দেখা যাবে। গলা চিনেও না চেনার ভান করে। বুড়োমানুষগুলো না ..!
এর পর বুবাই ফোনের লাইন কেটে দেয়। এমন সময় নেপাল হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে — যত্তসব পাগল! তারাচাঁদবাবু…!
কী আমি পাগল!
না, আপনাকে বলিনি। আপনি ও-ঘরে গিয়ে বসুন। আমি আপনাকে ওষুধ দিয়ে আসছি।
তারাচাঁদবাবু বেরিয়ে আসে।
তারাচাঁদ ধ্বজাধারি যখন ডাক্তারের ঘরে ঢুকেছিল, তখন বসার ঘরে চারজন। তারমধ্যে একজন এমিলি দিদিমনি। স্বাভাবিক কারণেই তিনজোড়া চোখ হুমড়ি খেয়ে মেয়েটার শরীরে। এমিলি বেশ লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা। গোলাপি হয়ে ওঠা মুখটা ঘামে চকচক করছে। তিনজনেই মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার জন্য উশখুশ করছে। ওদের মধ্যে কমবয়েসি ছেলেটা প্যাঁকাটি মার্কা, গায়ে নীল পাঞ্জাবী। চোখ বসা, গাল ঢোকা। ও বসেছিল ফ্যানের নীচে। হঠাৎ ও উঠে দাঁড়িয়ে বলে — আপনি খুব ঘেমে গেছেন দেখছি। এখানে এসে ফ্যানের তলায় বসুন।
মেয়েটা মুচকি হেসে উঠে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসে। উঃ কী গরম’ — বলে গলা থেকে দোপাট্টা খুলে ফেলে। তিনজোড়া চোখের স্থান পরিবর্তিত হয়ে এক বিশেষ জায়গায় স্থির হয়। নীল পাঞ্জাবী ওকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। তাই ওর ভাবখানা এমন; ওর যেন মেয়েটার সাথে কথা বলার অধিকার জন্মে গেছে। ও বলে — যা বলেছেন; সত্যিই খুব গরম! আপনার চোখ-মুখ একদম লাল হয়ে গেছে।
লাল হাফশার্ট কথা বলার ছুতো খুঁজছিল। এই সুযোগে বলে ওঠে — লাল হবে না! উনি যা ফর্সা! মুখে রোদ পড়লেই একেবারে… হেঁ-হেঁ…!
তৃতীয়জন একটু মোটাসোটা, গাবদা-গোবদা। মাথায় মস্ত টাক। ও মরীয়া হয়ে ওঠে কথা বলার জন্য — হবে না কেন? ফর্সা হবে না কেন? ওঁরা তো ফর্সাই হন। একেবারে দুধে-আলতা গোলা রং। আচ্ছা এমিলি ম্যাডাম! আপনি প্যাটারনাল অ্যাংলো না ম্যাটারনাল অ্যাংলো?
মেয়েটা চমকে এদিকে ওদিকে তাকায়। ঘরে আর কোনো মহিলা নেই । ওর ভ্রু-তে জিজ্ঞাসা চিহ্ন — আপনি কি আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ, বলছি আপনার বাবা বিলিতি ছিলেন, না মা বিলিতি?
দেখুন, আমি এমিলি-টেমিলি নই। আমি লক্ষ্মীমনি। আর আমার বাবা-মা কেউই বিলিতি নয়। সবাই দিশি।
ও! তবে যে কম্পাউণ্ডার ছেলেটা আপনাকে আসতে দেখে বলল — এমিলি দিদিমনি আসছে। আর অমনি ভেবে নিলেন আমি অ্যাংলো, মানে হাইব্রিড!
না আমি মানে… আপনি হাইব্রিড না হয়ে পিওর ইংরেজ বা পিওর ফরাসিও হতে পারতেন! মানে শুধু নামে নয়, চোখে মুখেও কেমন একটা বিদেশিনি-বিদেশিনি ভাব!
আমি বিদেশিনি না স্বদেশিনি তা জেনে আপনার কী লাভ?
লাভ কিছু নেই।
তাহলে এত কৌতুহল কেন?
কৌতুহল থাকলে অনেক কিছু জানা যায়।
আপনি আমার সম্পর্কে জানবেন কেন?
না, মানে আপনি সুন্দরী তো…!
আচ্ছা! আপনি কি পাগল না বদমাইস?
দেখুন, আপনি হতে পারেন সুন্দরী। তাই বলে একজন ভদ্রলোককে পাগল, বদমাইস বলতে পারেন না।
ও! আপনি মা-বাপ তুলে কথা বলতে পারেন। বিদেশিনি বলে গালাগাল দিতে পারেন আর…! জানেন, আমার ঠাকুরদা’ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। একজন ইংরেজকে বঁটি দিয়ে কেটেছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের ‘সাপে-নেউলে’।
নীল পাঞ্জাবী মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে — শুনুন লক্ষ্মীমনি দেবী…!
থামুন! আপনাকে আর মধু-ঢালা গলায় ‘দেবী’ বলে ফোপড়দালালি করতে হবে না। আদেখলাপনা দেখে বাঁচি না। আমার এমনিই গরমে দম আটিকে আসছে, আর…!
নীল-পাঞ্জাবী থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। টাকমাথা কিন্তু থামেনি। ও বলে চলেছে — আদেখলাপনা আপনি করছেন। ফ্যানের হাওয়া বোধহয় বাড়িতে খান না! এখানে ফ্যান দেখে আপনার গরম বেশি লাগছে। এটা আদেলাপনা নয়তো কী?
কী এত বড় কথা! চলুন আমার বাড়ি, দেখে আসবেন ক’খানা ফ্যান আছে। আপনার মতো ভিখিরি নই আমরা!
কী আমি ভিখিরি?
ভিখিরি না হলেও টাকলু তো বটে!
আমি টাকলু তাতে আপনার কী? আপনার কাছে কি চুল চাইতে গেছি?
চাইবেন বলেই তো গায়ে পড়ে কথা বলতে এসেছেন। দেখুন আ-আ-আপনি…!
খুব উত্তেজিত হয়ে গেলে মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না— টাকমাথার এটাই রোগ। ওর কথা আটকে গেছে। তবুও ও কিছু বলার চেষ্টা করায় শুধু আঁ-আঁ শব্দ বেরোচ্ছে।
লাল হাফশার্ট বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে — আরে থামুন না মশাই! আপ নাকে আর আঁ-আঁ করতে হবে না। মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করতে লজ্জা করে না?
ঠিক তখনই বাইরে গোলমাল শুনে নেপাল বেরিয়ে এসে বলেছিল — কী হয়েছে? চেঁচামেচি কিসের? এটা কি পাচুন্দির হাট পেয়েছেন নাকি!
সবাই এক মুহূর্ত চুপ। লক্ষ্মীমনি বলে ওঠে — উঃ যা গরম! জামাকাপড় খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে!
নেপাল তড়বড়িয়ে ওঠে — না না, এমিলি দিদিমনি ও কাজ করবেন না!
লক্ষ্মীমনি খেপে ওঠে — কে এমিলি? যাকে তাকে যা তা! তোমার জন্যই এই টাকলুটা…!
মানে আপনাকে যে ওষুধটা…। এমন সময় তারাচাঁদকে দেখা হয়ে গেলে ডাক্তার হাঁক পেড়েছিলেন, ‘কই হে নেপালচন্দ্র…!’
নেপাল তো ভেতরে ঢুকে গেছে। ডাক্তার বলেন — কী ন্যাপলা, সিম্পটম দেখে-শুনে কী বুঝলি?
পেছন দিয়ে রক্ত দু’বছর ধরে। খিটখিটে মেজাজ, মাঝে মাঝে সর্দি।
হ্যাঁ, সেই সঙ্গে গলায় শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি স্ফীত, মলদ্বার হেজে গিয়ে ঘা মতন হয়েছে। খুব ঠাণ্ডা খুব গরম সহ্য হয় না। কী দিতে হবে বল দেখি!
নাক্স ও সালফার।
না, ওতে ঠিক জমবে না। তাহলে ওই ইস্কুলে হিপিকেষ্ট।
সে আবার কী?
ওষুধের নাম। জবরজং। মনে থাকে না। আমি ওভাবেই মনে রাখি।
ও ইস্কিউলার হিপ্পোক্যাস্টেনাম। কারেকট! একদম ঠিক বলেছিস! তবে তার আগে কলিনসোনিয়া চার্জ করতে হবে। পরে তোর ওই ইস্কুলের হিপিকেষ্ট। যা বানিয়ে ফেল দুটোই থার্টি। আর পরের জনকে ডেকে দে।
তা হলে কালোসোনা আর হিপিকেষ্ট থার্টি, থার্টি।
ওদিকে বাইরে টাকমাথাটা লক্ষ্মীর কথা শুনে আবার আঁ-আঁ শুরু করেছে! তখনই তাঁরাচাঁদ ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ওর গম্ভীর গলা— কী ব্যাপার! এত রাগারাগি কিসের? নিশ্চয় ওই কম্পাউন্ডার আপনাকে পাকিস্তানি বলেছে! ডাক্তার পাকিস্তানি বললে, কম্পাউন্ডার পাকিস্তানি না বলুক, নিদেনপক্ষে বাংলাদেশি তো বলবেই!
লক্ষ্মীমনির তিরিক্ষি গলা — না ও নয়, ওই যে ওই টাকলুটা বলেছে, পাকিস্তানি নয় বিদেশিনি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে উনি বললেই তো আর আপনি বিদেশিনি হয়ে যাচ্ছেন না! সোনিয়া গান্ধীকেও অনেকে বিদেশিনি বলেছিলেন। উনি কি বিদেশিনি হয়ে গেছেন? উনিই তো একসময় দেশের …।
টাকমাথা কিছুক্ষণ চুপ থাকায় কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *