আজ আবার শালিখ দুটো ঝগড়া জুড়েছে। গলা ফুলিয়ে যখন কিচির মিচির চিৎকার করে ,খয়েরীর ওপর গায়ের হলদে ছিটেগুলো চকচক করতে থাকে। এরা দুটো ঠিক পাশের বাড়ির বর বৌটার মতো। পাড়া কাঁপিয়ে ঝগড়াও করে, আবার বিকেলে একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে বেড়াতেও যায়। ক্ষণে ভাব, ক্ষণে বিবাদ। আমি কিছুক্ষণ পড়া ফাঁকি দিয়ে মন দিই ওদের দিকে। যা ভেবেছি তাই, কথা কাটাকাটির পালা শেষ। পিঠে ঠোঁট ঘষে পালক পরিষ্কার করছে একজন, অন্যজন আরামে চোখ বুজে আছে। এবার ডানা ছুঁয়ে দুজনে উড়বে এক চক্কর। যাক গে, আমিও উঠে পড়ি চেয়ার ছেড়ে। আজ পরীক্ষা আছে, ক্লাস নাইন তো, ঘন ঘন পরীক্ষা থাকে।
পরীক্ষা মানেই স্কুল, আর স্কুল অবধারিত মনে করাবেই তার কথা। সবাই বলে আমি নাকি বড্ড ভাবুক, ভাবের ঘরে বসত করি। কি করব বলো, ভাবনাকে বড় ভালোবাসি আমি। সুখের ভাবনার রঙ বড় একঘেয়ে, চড়া। আমার ভাবনার নক্সীকাঁথা দুঃখের সুতোয় বোনা, মনকেমনের আবছা কমলা সুতোর সঙ্গে চোখের জলের স্বচ্ছ মুক্তোদানা গেঁথে গেঁথে। মনের ঘরে সেই নক্সাদার কাঁথার ওম গায়ে মেখে ভালোবাসার হলুদ গোলাপ আঁকা চাদর পেতে ঘুমিয়ে থাকি আমি। আমার তিনতলা বাড়ির আটটা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একান্নবর্তী পরিবারের কুড়ি জন সদস্যের কেউ তার হদিস পায় না।
আমাদের বাড়িতে সবাই খুব আমুদে, হৈ চৈ করতে পেলে আর কিছু চায় না। তিন পুরুষের ব্যবসা, সবাই বলে আমরা খুব ধনী। পাড়ার লোকের ঈর্ষা আর সম্মান – অনায়াস দক্ষতায় দুটোই সামলান বড়রা। আমাদের পরিবার সবকিছু নিয়ম মেনে মেপে করে থাকে। তাই আমি ছোটো থেকেই জানি, কলেজে হয়তো আমি পা রাখব ঠিকই, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। গ্রাজুয়েট কোনমতে হতে পারলেই হোল,মোটা মাইনের চাকরি করা কোনো বনেদী ঘরের পাত্রের হাতে আমাকে সম্প্রদান করে স্বস্তির নিশ্বা
ফেলবে সবাই। আমার জেঠু কাকুর মেয়েদেরও একই ভবিতব্য। তাই ভালো রেজাল্ট করার তাগিদও পাই না, কি হবে কতগুলো নম্বর জমা করে? তাই আমি ভাবনা বুনি, স্বপ্ন দেখি, রোজ একটু একটু করে পালাই খুব চেনা এগিয়ে আসা ভবিষ্যতের থেকে দূরে, আরো দূরে ভুবনডাঙার মাঠে।
এই স্কুল থেকে ফেরার পথেই দেখতাম তাকে, পাড়ার মোড়ে গুলঞ্চ গাছটার নীচে জটলা করে যে ছেলেগুলো, তাদের দলে থেকেও কেমন যেন দলছুট। মায়াবী দুটো চোখ লাজুক হাসি মেখে দেখত আমাকে। আমাদের বাড়ির বড়দের সমঝে চলে সবাই, তাই কোনোদিন কোনো চটুল মন্তব্য উড়ে এসে আঘাত করে না, আমি শুধু স্কুলের বাকি পথটুকু ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাই, আর অন্য একজনের দৃষ্টির ভালোলাগা পাপড়ির মতো ঝরে পড়ে। সেই সুগন্ধ আমাকে ঘিরে থাকে দিনভর।
আমাদের বাড়ির সামনে একটা সাইকেল সারানোর দোকান আছে। ইদানীং ছেলেটাকে ওখানে দেখতে পাই কাকুর কথায় জেনেছি, দোকানটা ওর বাবার, ছেলেটা পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছে। এখন আমি রোজ বিকেল হলেই খুড়তুতো বোনকে নিয়ে ছাদে যাই, এতে কেউ বারণ করে না। বোন খেলা করে, আবোলতাবোল কত গল্প করে, আমি আলসের ধারে দাঁড়াই মাঝে মাঝে। কোনো কথা না বলা বিকেলগুলো ভরে ওঠে কত গানে, চেনা -অচেনা শব্দরা সঙ্গত করে তাতে। শেষবিকেলের নিভে আসা আলো গোধূলির আলোয় রঙিন হয়ে ওঠে। আমার একলা বিকেল বিনা ভাষায় মুখর হয়, অস্তরবির আলোয় আকাশ ভরে ওঠে তার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় আমাকে, আপন মনে নিজেকে নিয়ে খুশি থাকি আমি।
কদিন আগে ছোটপিসি ফিরে এসেছে, চিরকালের মতো, সব রঙ মুছে। ওর বরের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, সব কাজ মিটে গেলে বাবা নিয়ে এসেছে পিসিকে। ওকে দেখে বুঝি আঁচলে করে সব অন্ধকার জমা করে এনেছে। এমন হয় বুঝি! কাউকে হারিয়ে ফেললে। আমি ঠিক করি এমনটা হতে দেব না আমার সঙ্গে ।তাই সাহস করে সেদিন চিঠিতে লিখেছিলাম মনের কথা, ভেবেছিলাম স্কুল যাওয়ার সময় লুকিয়ে দিয়ে যাব। কিন্তু দোকানে সেদিন দেখতে পেলাম না তাকে, তারপরও আর কোনোদিন।
এখন জেনে গেছি, চাকরি পেয়ে অনেক দূরে চলে গেছে সে। সংসারের দায়িত্ব রয়েছে যে। আনন্দ ভাগ করে নিতে ওর বাবা মিষ্টির বাক্স হাতে দেখা করে গেছেন জেঠুর সঙ্গে, আমাদের জমিতেই ওদের দোকান যে!
সবই চলছে আবার আগের মতো। শুধু আমার সারা দিন যেন একটা নিমেষে স্থির হয়ে রয়েছে। যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, অপেক্ষার চিঠি হাতে। আমার শিউলি কুড়ানো ভোর, ঘামে ভেজা ক্লান্ত দুপুর, আশ্লেষ ঘেরা রাত – সব হয়তো দিয়ে দিতে হবে, কারো না কারো হাতে। শুধু একজনের আলোয় রাঙানো আমার এই বিষণ্ণ একলা বিকেল – প্যান্ডোরার বাক্সে বন্ধ থাকবে আজীবন – হৃদয়ের কুঠুরিতে।