কাজুর ঘরে দুপুরবেলা তিনজন মিলে তিনঘণ্টা ধরে যে গোপন রুদ্ধদ্বার বৈঠক হলো সে বিষয়ে বাড়ীর কেউ গুনাক্ষরেও জানতে পারলো না । বুন্দিকে সতর্ক করে দেওয়া হলো সে নিজে ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি যেনো এর কিচ্ছুটি না জানে ।
টপ সিক্রেট !
অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন । আজ রবিবার দুপুর তিনটের সময় দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ অর্থাৎ হাড়ভাঙ্গা ইউনাইটেড ও সুখসায়র নেতাজী স্পোর্টিং ক্লাব মুখোমুখি হতে চলেছে ভুবন ডাঙার মাঠে । ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি । ফুটবল গ্রাউন্ডের গ্যালারীর দর্শক আসন কানায় কানায় পূর্ণ । দু’পক্ষের সমর্থকদের চিৎকারে পাশে বসা লোকের কথাও শোনা যাচ্ছে না । মিয়াও চিয়াও আর হালুম হুলুম এর জিম্মায় বাড়ীর নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিয়ে সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে দুগ্গা বলে বসু পরিবারের সদস্যরা সবাই হাজির হয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে । এমনকি ভগীরথ মিশ্রও এসেছেন । আজ তাঁর আদরের ‘বুন্দি বেটির খ্যেলা দেখতে হোবে না ?’ বিউটিদেবীর আহ্বানে ছোটো বোন সুইটিদেবী চলে এসেছেন । না আজ আর কোনো দলাদলি নয় ভাগাভাগি নয় সবাই এক জায়গায় এক জোট হয়ে বসেছে । শাশুড়ি ও মাসি শাশুড়িকে দু’পাশে রেখে মাঝ মধ্যিখানে দামিনী বিরাজমান ।
পি ই ই ই ইপ ঐ রেফারির হুইসিল বেজে উঠলো , খেলা শুরু । টান টান উত্তেজনায় ভরা ম্যাচ উপহার পেলো সবাই । যেনো ইউরোপীয়ান সকার দেখছে চোখের সামনে । সার্থক নাম রেখেছে ক্লাব মেম্বাররা : লিটিল ম্যারাডোনা । একা বুন্দিকে সামলাতে হাড়ভাঙা টিমের প্লেয়ারদের সবার হাড় যেনো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল । পুঁচকি মেয়েটা নিজেদের বক্স থেকে বল তুলে বিপক্ষের সবাইকে বুদ্ধু বানিয়ে বারংবার জোরালো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের গোলে । ওকে আটকাতে সবাই নাজেহাল । কিন্তু অল্পের জন্য গোল হতে হতেও হচ্ছে না । নব্বুই মিনিটের খেলার পঁচাশি মিনিট অতিক্রান্ত , ফলাফল শূন্য : শূন্য । হর্ষবর্ধনবাবু নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছেন । তাহলে কি শেষ অব্দি ম্যাচ ট্রাই বেকার পর্যন্ত গড়াবে নাকি ? উফ্ এই টেনশন আর সহ্য করা যাচ্ছে না ।
হঠাৎ বুন্দির মনে হতে লাগলো সেই স্বপ্নে দেখা ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল ম্যাচের এ্যাকশন রিপ্লে হচ্ছে তার চোখের সামনে । হ্যাঁ অন্তিম মুহূর্তে
খেলার একমাত্র নির্নায়ক গোলটি এলো বুন্দির শট থেকেই । যেমনটা সে দেখেছিল ঠিক তেমনটাই ঘটল । কি আশ্চর্য তাই না ? কেউ জানে না , একমাত্র সে জানে সব এই জাদু চশমার কামাল ।
জেলা শাসক স্বয়ং বুন্দির গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে দিলেন । কোচ স্যার আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুন্দিকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করে দিয়েছেন । ন্যাংটেশ্বর ট্রফি এখন তাঁদের স্থায়ী সম্পদ । ফেরার আগে বিউটিদেবী গোটা ক্লাবকে আগামী রবিবার মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানিয়ে এলেন , মায় মালি থেকে কেয়ারটেকার পর্যন্ত সবাই ।
বাড়ীতে পা রেখেই যমজ ঠাকুমা সেলিব্রেশন শুরু করে দিলো । উচ্চস্বরে লাউড স্পিকারে হিন্দি সিনেমার লারেলাপ্পা গান বাজতে শুরু করেছে । সেই সঙ্গে চিনে পটকা আর বুড়িমার চকোলেট বোম ফাটছে দুমদাম । জলধরবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন
– আরে আরে মা মাসি তোমরা করো কি করো কি ! ডেসিবেলের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে যে ! শব্দ দূষণ হচ্ছে যে ! পাড়ার লোকে এখনি কমপ্লেন করবে যে ?
কিন্তু এক ধমকে সব ঠাণ্ডা
– তুই থাম তো । এক আধ দিন এমন অল্প একটু বেআইনি কাজ করতে হয় । তা না হলে আইনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ জাগে বুঝলি । পাড়ার লোক সব জানে । কেউ কিছু বলবে না । আজ বাজী ফাটাবো না তো কবে ফাটাবো শুনি ?
বোঝো ঠ্যালা ! এরপর আর কি বলা যায় ? শালিখ চড়ুয়ের বুন্দির গোল্ড মেডেল নিয়ে আহ্লাদ শেষ হবার নয় । দেখে দেখে ওদের যেনো সাধ মেটে না । সব থেকে অবাক করা কান্ড হলো লাড্ডুর মুখে বোল ফুটেছে ! সে গম্ভীর গলায় ছোট বোন কে প্রশ্ন করলো
– হ্যাঁরে তোদের ক্লাবে কি শুধু ফুটবল ট্রেনিং দেয় ?
– কেনো রে দাদা ?
– না ভাবছিলাম এবার থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করলে কেমন হয় ? ওতে তো আর খুব বেশি দৌড়তে হয় না তাই ।
– কে বলল হয় না ? তুই টিভিতে খেলা দেখিস নি ? বোলিং , ফিল্ডিং , ব্যাটিং সবেতেই রানিং মাস্ট ।
– তুই বুঝছিস না বুন্দি আমি তো ফাস্ট বোলার হবো না । হলে স্পিনার হবো নয়তো উইকেট কিপিং করবো । আর ব্যাটিংয়ের সময় অল্প একটু ছুটতে হবে ঠিকই তবে সে তো কন্টিনিউয়াসলি নয় , গ্যাপ আছে ।
– ও কে আমি কোচ স্যারকে জিজ্ঞাসা করবো ।
অভাবনীয় অকল্পনীয় পরিবর্তন ! দামিনী বিস্মিত হন যত খুশী হন তার দ্বিগুণ । এদিকে মারুতি পিসি সকাল থেকে খেটেখুটে অপূর্ব সুস্বাদু পুডিং বানিয়েছে । সবাই মিলে চেটেপুটে এখন তাই খাওয়া চলছে । এক টুকরো পুডিং মেঝেতে পড়েছে , লাড্ডু তুলতে যাবে বলে নিচু হতেই তার মা ঝাঁঝিয়ে উঠল
– খবর্দার , হাজার বার মানা করেছি না ? মাটি থেকে কুড়িয়ে খাবার মুখে দেবে না । কতো রকমের রোগের জীবাণু থাকে তার কি কিছু ঠিক আছে ?
লাড্ডু গোমড়া মুখে বলল
– আহা ম্যাচ শেষ হবার পর হেলা বটতলার পাশে দাঁড়িয়ে কাজুপিসি আর চাঁদুমামা একটাই কাঠি থেকে রঙিন মিষ্টি বরফের গোলা চুষে চুষে খাচ্ছিল যে , তার বেলা ?
ডাইনিং হলে যেনো বাজ পড়লো ! যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের চক্ষু ছানাবড়া ! উফ্ কি বিচ্ছু পাজি ছেলেরে বাবা ! কোন ফাঁকে ঠিক লক্ষ্য করেছে ! সুইটিদেবী চিৎকার করে বলে উঠলেন
– ওরে দিদি শোন শোন , তোকে আর জামাই খুঁজতে মোমবাতি হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে না । তোর দুশ্চিন্তা এবার দূর হলো । এতো দেখি ‘বগল মে ছোরা ঔর শেহের মে ঢিনঢোরা’ ।
ওরা দু’জন পালাবার পথ খুঁজে পায় না । চোখের পলক ফেলার আগে কপ্পুরের মতন উবে গেল ! এ এক বিশেষ ধরনের জীবাণু সংক্রমণ । সবাইকে ব্যাখ্যা করে বলা চলে না । দামিনী বুঝল নিজের ছোটো ভাইকে ননদাই আর নিজের ছোটো ননদকে ভাজ হিসাবে ভাবা প্র্যাকটিস করার দিন এসে গেছে ।
দুটো নাম না জানা ছোট্ট পাখি হঠাৎ ঘরে ঢুকে কিচির মিচির শব্দ করে ও খুব খানিকটা ঝটাপটি করে আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে পালিয়ে গেলো । অসময়ে বসন্তের আগমন বার্তায় পুলক অনুভব হয় বৈকি !
এ সবই সম্ভব হলো বুন্দির ফুটবল ও তার অলৌকিক চশমার দৌলতে ।