T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় স্বপন পাল
by
·
Published
· Updated
ঠাকুরের গান
জনা ধাঙ্গড় হাত জোড় করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। মুখে বেশ একটা ভক্তি ভক্তি ভাব। অবাক হলাম, তবে ততোটা হলাম না। কাল রাতে কতটা দেশী গিলেছে কে জানে। হাসপাতালের ঠিকা কর্মী। ড্রেন, শৌচাগার এসব পরিষ্কার রাখতে এখন সরকারি হাসপাতালে স্থায়ী কর্মী রাখেনা, বদলে ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ চালানো হয়। হয়তো তাতে সুবিধে হয়, ঝামেলা কমে। জনার্দন রাম কবে কোন কালে তার বাপ কাকার হাত ধরে এ রাজ্যে এসে পরিবারের সাথে নোংরা পরিষ্কারের কাজে হাত লাগিয়েছে সে বোধহয় নিজেও মনে করতে পারবে না। এ শহরে এই সরকারি হাসপাতালের উল্টোদিকের রাস্তাটার একদম শেষপ্রান্তে একটা ডোম ধাঙ্গড়দের বস্তি আছে, ঘন বসতির বাইরে। সেখানে ওরা শুয়োর পোষে, রাতে মদ খায়, নিজের নিজের সংসার করে, কেউ বৌ পেটায় আবার কেউ পেটায় তার স্বামীকে। তবে দিনের বেলা যে যার কাজ কর্ম ঠিকই করে চলে, না হলে ওদের যেমন পেট চলবে না তেমনি হাসপাতাল, মর্গ সব অচল হয়ে যাবে। জনা ধাঙ্গড় মাথা নীচু হাত জোড় দাঁড়িয়ে, সামনে অনেকটা দূরে পতাকা উড়ছে, জাতীয় পতাকা, মাইকে বাজছে জন-গণ-মন অধিনায়ক জয় হে। আজ ছাব্বিশ জানুয়ারি, দেশের প্রজাতন্ত্র দিবস। একটা বেদীর মতো যায়গায় প্যান্ডাল করা হয়েছে, বেদীতে কিছু চাদর মোড়া চেয়ার আর মাইক। হাসপাতালের সুপার সঙ্গে আরো অনেক বড় বড় মানুষ বসে সেখানে। এসডিও সাহেব এসেছেন। অনেক বক্তৃতা দেবেন ওঁরা। সব কথা জনা বোঝেনা ঠিক তবে এটা বোঝে যে আজকের দিনটা পূজোর দিনের মতোই খুব ভালো দিন। আজ সবাই কেমন ভালো জামা কাপড় পরে এসেছে সাহেবদের কথা শুনবে। এরপর ছোট ছোট প্যাকেট দেওয়া হবে, তাতে কেক, মিষ্টি, চানাচুর ভরা থাকবে। কে যেন বলছিল লস্যি খাওয়াবে এবার। তারপর হাসপাতালের এই মাঠে দৌড়াদৌড়ি হবে, লাফ-ঝাঁপ হবে। শেষে দুপুরে খিচুড়ি, বেগুনি, বাঁধাকপির তরকারি আর টমেটোর চাটনি। শেষে গোলাপজামও থাকবে একটা করে। আহা, এমন দিন পূজোর দিন না হয়ে যায় ? গতকালই তো ওরা সবাই মিলে হাসপাতালের মাঠটায় চুন দিয়ে দাগ কেটেছে, আজ বাবুরা সেখানেই দৌড়-ঝাঁপ করবে। চেয়ার থেকে উঠেছিলাম একটা ফোন আসছিল বারবার সেটাই ধরে ফিরছি, দেখি এসডিও সাহেব পতাকা তুলে দিয়েছেন, পতাকায় বাঁধা গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয়েছে। সবাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমিও দাঁড়ালাম জনার ঠিক পাশটায়। জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয়ে যাওয়ায় আর হেঁটে চেয়ারের কাছে ফেরা হলো না। দেখলাম জনাকে দুই হাত জোড় করা, পরম ভক্তিতে মাথা নীচু।
একসময় শেষ হলো জাতীয় সঙ্গীত। এবার একে একে বক্তৃতা শুরু হবে। আমি জনার দিকে তাকালাম। পাশে আমাকে ও আশা করেনি। ব্লাডব্যাঙ্ক সামলাই বলে কেউ কেউ একটু বেশী সমীহ করে। জনাকে প্রায়ই আমার ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে কাজে বা অকাজে দেখতে পাই। বললাম, কি জনার্দন তুমি গানটা শুনে অত ভক্তিভরে প্রণাম করছিলে, তা গানটা কার লেখা জানো ? বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো জনার্দন আমার দিকে, বললো, ঠাকুরের গান লেখা যায় বেলাড বাবু ? হ্যাঁ গো লেখা যায়, এ গান হলো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, মানে এই যে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, এই দেশের জাতীয় গান এটা। এটা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার একবার কপালে জোড়হাত ছোঁয়ালো জনার্দন। বেশ বলেছেন বেলাড বাবু ঠাকুরের গান ঠাকুর লিখেছে, মানুষ কি তা লিখতে পারে ? ওহো, এবার বুঝলাম জনার্দন রবীন্দ্রনাথের পদবীতেও তার ঠাকুর পেয়ে গেছে। হেসে বললাম, না গো, রবীন্দ্রনাথের পদবী ঠাকুর, এই যেমন তোমার পদবী রাম। শুনেই কানে হাত দিলো জনা ধাঙ্গড়। ছিঃ, বেলাড বাবু কোথায় ঠাকুর আর কোথায় আমি। আবার বললাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন খুব বড় কবি, লোকে ওঁকে কবিগুরু বলে। ইংরেজির মে মাসে ওঁর জন্মদিন হয়। খুব ধূমধাম হয়, দেখোনি পাড়ায় পাড়ায় ? সবাই ওঁর লেখা গান গায়। আমাদের পাড়ায় এবার যখন হবে তোমাকে বলবো, এসো তখন। খেয়াল করিনি কখন জনার খোঁজে ওর বারো তেরো বছরের নাতনী এসে দাঁড়িয়েছে। কচি মেয়েলি গলা শুনে ঘুরতেই সে বললো, জানি তো, রবীন্দ্র জয়ন্তী, আমি দেখেছি। দাদু অতো জানে নাকি ? দাদু তো রোজ সন্ধ্যেবেলায়…, ওই কথাটুকু বলে হাত দিয়ে যে ইশারা করলো তাতে মদ খাওয়া বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। লজ্জা লজ্জা মুখ করে নাতনীর হাত ধরলো জনার্দন রাম। পদবীতেও যার এক অবতার উপস্থিত থাকেন, যিনি পূজাও পান বহুজনের মধ্যে, উচ্চকোটির মানুষের মধ্যে। অথচ সেই পদবী নিয়েও সমাজে অসম্মানিত জনার্দন রাম জনা ধাঙ্গড় হয়েই থেকে গেছে, রবীন্দ্রনাথ সহস্রবার তাদের মুক্তির কথা উচ্চারণ করলেও জন-গণ-মন আজও তা মেনে নিলো কই ? ততক্ষণে জনার্দন তার নাতনীর হাতে কেক-মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিতে সবার ছোঁয়া এড়িয়ে ভিড় থেকে একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।