ঠিক তখনই চোখ খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেনো ধুলোর মতন বাতাসে মিলিয়ে গেলো । এখন সব কিছু ঝাপসা , যেনো জলীয় বাষ্পে ভেজা কাঁচের মধ্যে দিয়ে দুনিয়া দেখা । বেডের পাশে বেড সাইড টেবিল । তার ওপর আছে সেই মহার্ঘ বস্তুটি যেটি ছাড়া স্বপ্ন দেখা সম্ভব হলেও বস্তুজগৎ ঘোলাটেই থেকে যাবে । হ্যাঁ অনুমান নির্ভুল , অর্থাৎ চশমার কথা বলা হচ্ছে । বুন্দি এবং তার দু’চোখ ভরা স্বপ্নে গড়া ভবিষ্যতের মাঝ বরাবর মূর্তিমান বিভীষিকার মতন নাকের ডগায় ঝুলে আছে যে দুটি গোলাকার চাকতি । এবং সেটিও যেমন তেমন নয় । যারা হরিণ ঘাটার দুধের বোতল দেখেছে এবং তার তলদেশের পুরুত্ব ও ঘনত্ব স্মরণ করতে পারবে তারা সহজে বুঝবে সে চশমা দেখতে কেমন । বুন্দি যখন সেই চশমার ভেতর দিয়ে ড্যাবড্যাবে চোখে অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকে তখন মনে হয় যেন দুটো রয়েল সাইজের কালোজাম এই বুঝি ঠিকরে বেরিয়ে এলো ।
– আচ্ছা এই বুন্দি কে ?
– বোঝো ঠ্যালা ! কে আবার ! আমাদের ক্যাপ্টেন ইন্ডিয়া , মিস মার্ভেলাস বিদ্যুৎপর্ণা ।
– ওহ্ ডাক নাম বুঝি ?
– আজ্ঞে হ্যাঁ , সাত কান্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাবা !
– তা বেশ , কিন্তু ওমন বিদঘুটে নাম কেনো ?
– বলিহারি আক্কেল বটে ! বড় জোর আনকমন বলা যায় । তা নয় সরাসরি বিদঘুটে ?
– না মানে ইয়ে …
– ইয়ে টিয়ে ছাড়ুন , মানেটা ধরুন । বুন্দি হলো হিন্দি শব্দ , অর্থাৎ বাংলায় যাকে আমরা বোঁদে বলি । ছোট্ট গোলাকৃতি রসে টইটুম্বুর এবং সুমিষ্ট । বিদ্যুৎপর্ণার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো ঠিক তাই । সেই কারণেই ঠাকুমা বিউটিদেবী আহ্লাদ করে ঐ নাম রেখেছেন ।
– কি কি ! কি নাম বললেন ঠাকুমার ? বিউটিদেবী ?
– ঠিকই শুনেছেন । সমস্যাটা কি ?
– ওনার বয়েস কত ?
– অল্প কিছু দিন হলো বরিষ্ঠ নাগরিকের তকমা গায়ে সেঁটেছে । কেনো বলুন তো ?
– সাড়ে সব্বনাশ ! সে কালে এরকম নাম হতো ?
– এতো মহা মুশকিল হলো ! আধুনিক মানুষ সব যুগেই থেকে থাকে । তবে তারা সংখ্যায় কম হয় । ঠাকুমার এক জমজ বোনও আছে , বিউটি আর সুইটি । এঁদের রসবোধ চূড়ান্ত , আর সেটাই আমাদের গপ্পের জন্য খুব জরুরী উপাদান বুঝলেন ?
– হরি বোল নারায়ণ , বলে যান শুনছি ।
– কথায় কথায় এরকম বিষম খেলে আর জিভ কামড়ালে কি গপ্পো এগোয় ? প্রশ্ন না করে চুপ করে মন দিয়ে শুনুন । যথা সম্ভব সংক্ষেপে পুরো বৃত্তান্ত গুছিয়ে বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করছি ।
– সেই ভালো , এই আমি মুখে কুলুপ এঁটে দিলাম । ব্যাস্ নিশ্চিন্দি ।
সুখসায়রের এই বসু পরিবারের গৃহকর্তা হলেন শ্রীযুক্ত শশধরবাবু মহাশয় । একদা পাটনা নিবাসী ভারতীয় রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মীর জীবনে সব চাইতে প্রিয়তম বস্তু হলো লাড্ডু । তা সে দরবেশ অর্থাৎ রসালো নরম ওপরে ক্ষীরের গুঁড়ো ছড়ানো বোঁদের লাড্ডু হোক কিংবা রূপালী তবকে মোড়া মিহিদানা দিয়ে তৈরী শুখা লাড্ডুই হোক । আরো আছে যেমন মুংকা লাড্ডু অর্থাৎ মুগের নাড়ু । এমন কি দলভুক্ত করা না গেলেও তিলের নাড়ু , বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানে ঘরে তৈরী আনন্দ নাড়ু এবং গুড় ও চিনি দিয়ে তৈরী দু’ধরনের নারকেল নাড়ু ওনার সংযমের বাঁধ ভেঙে দেয় । একবার দৃষ্টি গোচর হলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না । বলা বাহুল্য ওনার এই লাড্ডু প্রীতি দীর্ঘ প্রবাস জীবনের সাইড এফেক্ট । তাই পুত্রবধূর কোল আলো করে যখন তাঁর প্রথম বংশধর এলো তখন সদ্যজাতের মুখ দর্শন মাত্র নাম রাখলেন ‘লাড্ডু’ ।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ছাত্রী দামিনী নিজের ছেলের এহেন নাম শুনে আঁতকে উঠেছিল । কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ীর মুখের ওপর কিছু বলা সম্ভব নয় তাই ডাক নামটা বাধ্য হয়ে মেনে নিতেই হলো । ব্যাংককর্মী স্বামী জলধর হলেন ভোলা মহেশ্বর , সাত চড়ে রা কাড়েন না । সংসারের সব ব্যাপারেই তিনি উদাসীন । তাই দামিনীকে নিজের হাতে হাল ধরতে হয়েছে । ছেলের অন্নপ্রাশনের দিন নামকরণের সময় বাপ ঠাকুরদার নামের সঙ্গে মিল বজায় রেখে জটাধর কিম্বা গুণধর ইত্যাদি নাম যখন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল তখন তিনি সে সম্ভবনাকে সমূলে বিনাশ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন । রবীন্দ্রভক্ত ও সমাজ সচেতন একজন আধুনিক নারী তার পুত্র সন্তানের নাম রাখলেন নির্ঝর । কারণ দামিনী জানতেন অন্য যে সব নাম সাজেস্ট করা হচ্ছিল সেগুলি আজকের যুগে শুধুমাত্র যে অচল তাই নয় হাস্যকরও বটে । সে দিক থেকে দেখতে গেলে নির্ঝর একেবারে পারফেক্ট । ধরের সঙ্গে ঝর ছন্দ মিলও হলো আবার যুগপোযোগীও হলো । সাপও মরল লাঠিও ভাঙলো না ।
তবে লাড্ডু যে আক্ষরীক অর্থে লাড্ডু সেটা তাকে একবার দেখলেই বোঝা যায় । যেমন গোলগাল নাদুসনুদুস মার্কা চেহারা তেমনই তার স্বভাব । বয়েস তার দশ , কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হবে যেন তিন কুড়ি দশ । সে তার মায়ের ধাত পেয়েছে , সদা গম্ভীর ও শিল্প চর্চায় নিবেদিত প্রান । তার আদর্শ হলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর । হ্যাঁ ঠিক তাই , লাড্ডু ইতি মধ্যেই একজন উদিয়মান সেতার বাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে । দূরদর্শনের পর্দায় তার অনুষ্ঠান দেখা গেছে বেশ কয়েকবার । সর্ব প্রকার আউটডোর গেমের প্রতি তার প্রবল অনীহা । সে নিয়মিত তার বাবা ও ঠাকুরদার সঙ্গে দাবা খেলে । পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ে । নেট থেকে মূল্যবান সমস্ত টিউটোরিয়াল ডাউনলোড করে দেখে । এক কথায় লাড্ডু একটি আদ্যন্ত সিরিয়াস বালক । তাকে নিয়ে তার মায়ের আহ্লাদ আর ধরে না ।