হৈচৈ ছোটদের গল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

সাধু হত্যা রহস্য
রণদার খ্যাতি এখন সর্বত্র। এত কমবয়সী একটা ছেলে কি করে এত কেস সামলায়, বুঝি না।ঘটনাটা বৈরাগীতলার। পরশু সকালে অংক করছি, ও পড়ছে, সুজনদাদা এসে খবরটা দিল। বৈরাগীতলার আমাদের এক প্রিয় সাধুবাবা খুন হয়েছে। বয়স ষাট। তাকে কেউ ছুরি মেরেছিল, পুলিশ এসেছে, তবুও রণদাকে একবার যেতেই হবে।
যখন গেলাম তখন আমাদের পঞ্চায়েত-প্রধান নবীনবাবু রণদার সাথে পুলিশ-অফিসারের আলাপ করালেন। রণদা গ্রামের যেরকম উন্নতি করেছে, সবাই ওকে এক নামে চেনে। তারপর কাপালিক-কাণ্ডে আমায় যেভাবে বাঁচিয়েছিল, তাতে ও পুলিশ মহলেও জনপ্রিয়। অফিসার বললেন, মার্ডার-কেস খোকাবাবু।
-প্রশ্ন করতে পারি?
– করবে কাকে? সাধুর কেউ নেই।
– খুনের কিনারা?
-কত খুন হয়, কিনারা আর কটা হয়?
-সেবাইতদের সাথে কথা বলতে চাই।
– সময় বেশি থাকলে, করো। তবে নিজ-দায়িত্বে।গুডবাই!
ভীষণ রাগ হলো, অফিসারটি ছোট বলে তোয়াক্কাই করল না রণদাকে। রণদা কিছু না বলে মন্দিরে গেল। আমরা কি করি, নদীর ধারে গেলাম, নবীনবাবুও। বললাম, কিছু বলবেন?
-রণবাবুর বড্ড সাহস। কি দরকার এসবে জড়ানো?
সুজনদাদা বলল, কেন?
-এসব ঘটনা দুদিন পর সবাই ভুলে যাবে। মৃত সাধুর স্বভাব ভালো না।ডাকাতি করত, শাক্তসাধক ছিল, পরে বৈষ্ণব, তাই শত্রুর অভাব নেই।
নদী-পাড়ে একটা জিনিস চোখে পড়ল আমাদের, পলিমাটি সরে একটা ছুরি উঁকি মারছে।কিন্তু এভাবে পলিমাটিতে কে ছুরি গেঁথে রাখল? খুনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি! প্রমাণ লোপাট! তবুও সুজনদাদা একটা পাতা দিয়ে ছুরিটা তুলে নিল।
রণদার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ। কি জিজ্ঞাসা, কাকে জিজ্ঞাসা, কিছুই জানি না। ছুরির কথাটা শুনে বলল, থানায় চল সবাই।
থানায় সেই অফিসারের দেখা পেলাম না।রণদা বলল, আজ সকালে যিনি গেছিলেন উনি কোথায়?
-কি ব্যাপার?
-কেস সলভ।
-একটা বাচ্চা ছেলে, সাধু খুনের কেস সমাধান করে ফেলল!
– আমি কেন, মাথা খাটালে আমার মাথামোটা ভাইটিও সলভ করত।
আমি রাগলাম না, ও কি বলছে এসব! কি করে এত তাড়াতাড়ি সব সলভ করল!
অফিসার বলল, আচ্ছা, কাল এসো, ততক্ষণে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়ে যাব।
-তার দরকার নেই। প্রমাণ আছে খুনিকে ধরার জন্য। আমি আপনাকে এখনই বলে দিলাম, খুন ছুরিকাঘাতে হয়নি, বিষক্রিয়ায় হয়েছে।
– আচ্ছা,এখন বাড়ি যাও।
রণদা যা বলেছে, রিপোর্ট-এ তাই মিলে গেছে। সবার সামনে রণদা বলতে শুরু করল,
সাধুর নাম অবনীকান্ত মুখোপাধ্যায়। একসময়ের নরপিশাচ। একবার ডাকাতি ও খুনের পর সেই বাড়ির ছোট ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে আসে। ডাকাতি ছেড়ে চাষবাস-দিনমজুরি করে ছেলেটাকে পড়াত। ছেলেটি কলকাতায় পড়াশোনা করতে যাওয়ার পর, সাধু আমাদের বীরপুর গ্রামের বৈরাগীতলায় এসে থাকতে শুরু করে। এসব আমরা গ্রামের সবাই সাধুরবাবার মুখেই শুনেছি। কদিন আগে সেই ছেলেটি এখানে আসে। অবশ্য তখন আমি জানতাম না যে, সে পুলিশ। মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ, চোখে চশমা। সাধুবাবা সবাইকেই বলত, নিবারণকে সবকিছু বলা না অবধি শান্তি নেই। সেবারই…
নিবারণবাবু গর্জে বলল, স্যার একটা বাচ্চার কথা শুনতে সরকার আমাদের রাখে না।…
বড়বাবু গম্ভীর।
রণদা বলল, এক ভক্ত মিষ্টি পাঠিয়েছিল। সাধুবাবা কাঁচাগোল্লা খেতে ভালোবাসত, কিন্তু বোঝেনি এটাই তার শেষ খাওয়া! ওই মিষ্টি যে দিয়েছিল তার সিসি-টিভিতে ছবি ধরা পরেছে, আমাদের নবীনবাবুর উদ্যোগে গতসপ্তাহে বৈরাগীতলায় সিসি-টিভি ক্যামেরা বসেছে। আবশ্য সে খবর নিবারণবাবু জানতেন না। জানলে এই খোকাবাবু ওকে ধরতে পারত না কিছুতেই। পরে রাতে এসে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুকে ছুরি মেরে সেটা নদীতে ফেলে প্রমান লোপাট করেছেন।
নিবারণবাবুর মুখ নিচু।
-দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে, লেন্স পরে সবাইকে বোকা বানানো যায়, রণবীর গাঙ্গুলিকে না। বড়বাবু, এবার আপনারা তদন্ত করুন। ইতিহাসে বোধহয় প্রথম, ডিউটি অফিসারই খুনি। নিজ-দায়িত্ব কি আপনি বোঝেন না নিবারণবাবু! গুডবাই!