হৈচৈ ছোটদের গল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

রণ-কুনাল কথা
সূর্য সবে পশ্চিম দিগন্তে ডুব দিয়েছে।গোটা আকাশময় প্রশান্তি,সূর্যের বিশ্রামসুখ উপভোগ করতে করতে পাখিরাও ফিরছে নিজদের গন্তব্যে।কিচিরমিচির কাকলিকথায় প্রশান্তিপূর্ণ পরিবেশ রচিত হয়েছে।কনেদেখা আলোর গোধূলিতে নদীর বুকে একটি ছোট্ট নৌকা বেয়ে চলেছে সুজন মাঝি,সওয়ারী এক বছর বারোর কিশোর ও এক বছর দশেকের বালক।দুজনেরই পরনে ফতুয়া ও ছোট হাফপ্যান্ট।বালকের কন্ঠে এক প্রাচীন ভাটিয়ালি।কিশোরটির নাম রণবীর।গ্রামের দামাল ছেলে, কোন ভয়কেই পরোয়া করে না।সে জানে ভয় পায় কাপুরুষরা।রবিঠাকুরের দেশের ছেলেদের ভয় পেতে নেই।বিবেকানন্দের কথা শুনেছে ঠাকুমার মুখে।স্কুলের পাঠ্য বইতে ওনার দু-একটা গদ্যও পড়েছে।নিত্যানন্দ বলেন,বীর সন্ন্যাসী বিবেক,এতটাই সাহসী ছিলেন যে সাদা চামড়ার মানুষগুলোর রাজত্বে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আমেরিকার শিকাগো মহাধর্ম সম্মেলনে গিয়ে হিন্দু ধর্ম তথা রাষ্ট্রের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।কতই বা বয়স ছিল তখন তার!স্বামীজীর কথা শুনতে রণবীরের খুব ভালো লাগে।বালকটি তার সর্বক্ষণে ছায়াসঙ্গী।রণর নিজের কোন ভাইবোন নেই।কুনাল সে অভাব পূরণ করেছে।কুনালের মা গ্রামের বাড়ি বাড়ি কাজ করে, আর বাবা চাষবাস করে।বয়সে সে একটু ছোট হলেও রনদাদাকে সে ভালোবাসে।ওর বীরত্বকে শ্রদ্ধা করে।কুনাল অবশ্য অত সাহসী না,তবু সাহসী এই কিশোরের সান্নিধ্যে থাকতে সে পছন্দ করে।সুজন মাঝি ওদের থেকে অনেকটা বড়।তার বয়স ষোল হলেও মুগুরভাজা চেহারা।রণ ভাবে তার কবে অমন চেহারা হবে!সে রোজ সকালে উঠে মাঠে গিয়ে প্রায় ঘন্টা দুয়েক শরীর চর্চা করে,ব্যায়াম না করলে শরীরটা ম্যাজ-ম্যাজ করে।সুজনের সাথে রণবীরের অন্য ব্যাপারেও ভাব আছে।নিত্যানন্দ স্কুল মাস্টার, আর সুজন ছিল তার ছাত্র।আসলে নৌকাটা ওর বাবার,পরাণ মাঝির এখন বয়স হয়েছে।নৌকা বাইতে গেলে বুকে লাগে।তাই বছর দেড়েক হল সুজন নৌকা বাইছে।তাতেই ওর এমন সুঠাম চেহারা।রণবীরের কথা শুনতে তারও বেশ ভালো লাগে।একবার সুজনের নৌকায় একটা আহত সাপ উঠে গেছিল।তখন অবশ্য কুনাল ছিল না,রণ আর সুজন।সুজন বলল,গলাখান চেপে ধরো দিকিনি,তারপর তিন পাক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
-কেন?ফেলব কেন?
সাপটাকে দক্ষতার সঙ্গে ধরে রণ বলল, সুজনদাদা,শাঁখামুটি।
-বল কি!মারাত্মক বিষ যে!
রণ পরম যত্নে সাপটাকে শুশ্রূষা পরে তাকে স্বাধীন করে দিয়েছিল।এই ব্রহ্মাণ্ড যেমন মানুষের,তেমন তো জন্তু-জানোয়ারদেরও।আমাদের কি অধিকার আছে ওদের মারার!কিন্তু আত্মরক্ষার তাগিদেও কি মারা উচিত নয়!রণ বলে,ভয় দেখালে যদি কাজ হয়,তবে কেন শুধুমুধু মারা বাপু!ওরা এমনি এমনি মানুষকে আক্রমণ করে না,ভয় পেলে তবে করে।ওইটাই তাদের ধর্ম।কিন্তু ওরা তো আর জানে না মানুষের মস্তিষ্ক সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ।তবে কেন মানুষ বুদ্ধিহীনের মত অকারণে জীবকে হত্যা করবে?আহারের খোরাকটুকু মিটলেই তো হল।সুজন বলে,ধন্যি বাপু তোমার বুদ্ধি!
কুনাল এই ঘটনা শুনে মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছিল।সে বিশ্বাস করে যতক্ষণ তার সাথে রণদাদা আছে,তার কোনও ভয় নেই।সে গাইতে ভালবাসে,আর রণ শুনতে।তাই প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় সুজন মাঝির নৌকাতে চেপে ওরা বেরিয়ে পড়ে।রণর অবশ্য আরও অনেক বন্ধু আছে, তরুণ, সুনির্মল, রাখাল, গোপাল, ভোলা, নিকু ইত্যাদী ইত্যাদী।ওদের সামনে আবার গান শোনা যায় না।এত চেঁচামেচি করে সব!তাই বিকেলবেলা সবার সাথে খেলাধুলো,তারপর একটু নৌকাভ্রমন;আর তারপর ঘরে গিয়ে পড়তে বসা।রণবীরের ঠাকুমা সত্যবতী সবসময় ধবধবে থান পরে,কপালে শ্বেত চন্দনের ফোঁটা।সেমিজ কাশ্মিন কালেও পরেনি বোধহয়।সারাদিন তার কাজ বলতে তেমন কিছুই নেই।তার পুত্রবধূ নির্মলা সাক্ষাৎ মহামায়া।একা হাতে গোটা সংসারটা সামলায়,গোয়াল ঘর নিকানো,আনাজ-পাতি কাটা,সত্যবতীর সাধের সবজি ও ফলের বাগান পরিচর্যা করা,রান্নাবান্না,ঘরদোর পরিষ্কার সবই নির্মলা একা হাতে করে।সে বলে,আপনি তো অনেক করেছেন মা,এবার একটু বিশ্রাম নিন।
সত্যবতীর স্বামী ছিল ব্রিটিশ ভারতের স্বদেশী গুপ্তচর।ইংরেজ সরকারের চাকরি ছেড়ে এসে মেদিনীপুরের এই অখ্যাত অঞ্চলে গরিব মানুষগুলোর সাথে থাকতে শুরু করে।ষাটের দশকের গোড়ার দিকে মারা যায় সত্যবতীর স্বামী অখিল গাঙ্গুলী।তার সে দয়ালু স্বভাবটি তার সন্তানরাও পেয়েছে।বড়মেয়ে কলকাতায় মেয়েদের একটি স্কুল চালায়,ছোটমেয়েও শিক্ষিকা।কাছাকাছি কয়েকটা গ্রাম পরেই তার বাড়ি।আর একমাত্র ছেলে নিত্যানন্দ গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই।সেও বাবার আদর্শকেই লালন করে।তবে তার ছেলেটি একেবারে অন্য গোত্রের।পড়াশোনায় একদম মন নেই।দিনরাত্রি এর তার উপকার করে বেড়াচ্ছে,কার বাড়ির বয়স্ক লোক অসুস্থ,তাকে সদরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, ছেলে সেখানে গিয়ে হাজির।আবার কে খেতে পাচ্ছে না,ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি মাধুকরী করে তার অন্নের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।সত্যিই ভারী অদ্ভুত সত্যবতীর নাতি।ওর উপর রাগ করা যায় না।ওর বদমাইশি অক্লেশে মাফ করে দেওয়া যায়।এই খামখেয়ালি ছেলেকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় ভোগে নিত্যানন্দ।সে যত দিন বেঁচে আছে ছেলের কোন কিছুর ত্রুটি থাকবে না।কিন্তু সে চোখ বুজলে যে কি হবে রণবীরের! সে কথা ভেবে রাতে ঘুম আসে না।নির্মলা বলে,অত চিন্তা করো না।জিভ যখন আছে,আহারও জুটে যাবে ঠিক।তাছাড়া বামুন ঘরের ছেলে আর কিছু না হোক পুজো-আচ্চা করে খেতে পারবে।সত্যবতী কিন্তু বোঝে এই ছেলে একদিন মস্ত বড় মনের মানুষ হবে।গোটা পৃথিবীর লোক তাকে এক নামে চিনবে।সে বসে বসে সেলাই করে।এছাড়াও এই বয়সও সে চশমা ছাড়া দিব্যি বই পড়ে,একখানা মোটা বই খুলে এখন সে বসেছে।রণ এসে বলল,ঠাম্মি মাকে বলো না,খানকতক রুটি আর একটু তরকারি পোটলা করে বেঁধে দিতে।
-কেন রে, খিদে পেয়েছে খুব?
-হুঁ…
-খিদে পেয়েছে যখন,ঘরে বসে খা,পোঁটলা নিয়ে কোথায় যাবি?
রণ লজ্জা পেয়ে বলে,থাক দিতে হবে না।আমি তোমার গাছের কটা ফল পেড়ে নিয়ে যাচ্ছি।
-ওই দেখো,ছেলের আবার রাগ হয়েছে!ও বউ,দে দিকিনি কখানা রুটি আর তরকারি পোঁটলায় বেঁধে।নির্মলা কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় একটা পোঁটলায় সব বেঁধে-ছেদে নিয়ে আসে।
-সব দিয়ে দিয়েছি,নাড়ু-মুরকি কখানা কাঁচা ডিমও আছে।সাবধানে নিয়ে যাস,কুনালদের বাড়ির রাস্তায় অনেক সাপ-খোপ আছে,টর্চ নিয়ে যা।
রণ পোটলাটা নিয়ে কোন মতে দৌড়ে পালায়।সত্যবতী বলে,বউ,কুনালের বাপ বুঝি ঘরে নেই?
-না মা,কাজের তরে সেই পরশুদিন বেরিয়েছিল,কলকাতায় গেছে।এখনও ফেরেনি।
-তুই জানলি কোত্থেকে?
-দুপুরে ঘাটে ঘোষবউ এসেছিল,বলল আজ সকাল থেকে হাড়ি চড়েনি।ছেলে-পিলেগুলো কলমি সেদ্ধ খেয়ে আছে।বলললাম পাঠিয়ে দাও,দিয়ে দিচ্ছি।বলে,না দিদি,অকর্মণ্য বাপের ছেলে-বউ অনাহারেই মরুক।
-তবে রণ গেল!ঘোষবউ নেবে ওসব?
-সে আপনি চিন্তা করবেন না।রণর মুখের ওপর কিছু বলতে পারবে না।
-কি সাংঘাতিক ছেলে,হ্যাঁ!একবারও মুখ ফুটে বলল না!সত্যি বললে কি আমরা খাবার পাঠাতুম না!
-আপনার নাতিকে চেনেনই তো মা!
-আমার সোনার গৌড়!আমার সাত রাজার ধন!সত্যবতীর চোখে জল।
কুনালের বাড়ি যেতেই যে এমন একটা কাণ্ড ঘটবে রণ কল্পনাও করেনি।গলির মুখে লোকারণ্য।রণ দেখল নিকু-গোপাল-রাখালরাও রয়েছে।রণকে দেখেই ওরা ছুটে এল।
-রণ, কুনালের মাকে সাপে কেটেছে।
– কি?
-তুই চল,সবাই ওঝা ডেকেছে,ডাক্তার না ডাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
রণ তৎক্ষণাৎ খাবারের থলিটা নিকুকে দিয়ে বলল,কুনাল আর ভাই-বোনদের নিয়ে আমার বাড়ি চলে যা।বল ওদের খাইয়ে দিতে।আমি দেখছি।
ভিড়ের মধ্যে কুনাল এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে,রণকে দেখেই ডুকরে উঠল, ওকে জড়িয়ে বলল,এখন আমাদের কি হবে?
-চুপ কর,যা ভাই-বোনদের নিয়ে আমার বাড়ি যা।
উঠোনে শোয়ানো হয়েছে ঘোষবউকে।ওঝা দুর্বোধ্য সব মন্ত্র আবৃত্তি করে লম্ফ-ঝম্প করছে।রণ বলল,থামাও এসব।রাখাল,গোপাল ধর।লাল্টু যেখান থেকে হোক একটা গাড়ির ব্যবস্থা কর।
রণর হুংকারে কেউ শব্দ করতে পারল না।পঞ্চায়েতপ্রধান নবীন সোম বলল,বাবা এত রাতে কোথায় নিয়ে যাবে?
-তাই বলে একটা মানুষ এভাবে মারা যাবে,আর আমরা রঙ্গ দেখব!সরে যান,নইলে সবার মুন্ডু গুড়িয়ে দেব!
ঘোষবউকে ধরাধরি করে একটা ভ্যান গাড়িতে তোলা হল।মুখে গ্যাঁজলা উঠছে।সুজন মাঝি বলল,আমি চালাচ্ছি।রণ নিজেই ভ্যান চালাতে শুরু করল।সদরে যাওয়া অসম্ভব,গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।অন্ধকারে পথও ভালো দেখা যাচ্ছে না।তবু রণর মধ্যে এক অপার্থিব শক্তি ভর করেছে।স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোন ডাক্তার নেই।এক স্বাস্থ্যকর্মী পরীক্ষা করে বলল,এ যে মরে কাঠ হয়ে গেছে গো!
রণ এত ভেঙে কখনও পড়েনি।সদরের লাশকাটা ঘর থেকে ভোর ছটায় দেহ ছাড়া হল।তারপর শ্মশানের কাজকর্ম মিটতে মিটতে বেলা পড়ে এল।ঘোষবউ-এর দুই দিদি এসেছে।তারা বলল,আমরা নয় কটাদিন ওদের রাখতে পারব,তাও একজনকে।তিনজনকে রাখা তো আমাদের পক্ষেও সম্ভব না।নিত্যানন্দ বলল,আপনারা ওদের নিয়ে যান।আমি ওদের মাসখরচ পাঠিয়ে দেব।
রণ বলল,কুনাল আমার কাছে থাকবে।
ঘোষবউয়ের দিদিরা নিশ্চিন্ত হল।তারা একজন কুনালের এক ভাই আর অন্যজন আরেক বোনকে নিয়ে বিদায় হল।কুনাল এখন সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী রণর।রণ ওকে পড়ায়,স্নান করায়,খাওয়ায়,ঘুরতে নিয়ে যায়।নির্মলাকে কুনাল মা ডাকে,আর নিত্যানন্দকে গুরুজি।
সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল কেউ যেন এখনও ঠাহর করতে পারছে না।কুনালের বাবা কিন্তু আর ফিরল না।কোথায় গেল!আদৌ ফিরবে কি না তাও এক রহস্যই রয়ে গেল।অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই গ্রামবাসী ভুলে গেল।রণ কিন্তু চুপ করে বসে রইল না।একটা চিঠি লিখে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সই সংগ্রহ করে পঞ্চায়েতপ্রধান নবীন সোমকে জমা দিল।ওর দাবি,গ্রামের আর কাউকে যেন এভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে না হয়।নবীন সোম আর কি করে,কার্বলিক এসিড নিয়মিত গ্রামে ছড়াতে লাগল,তাতে সাপের উপদ্রব কমলেও,রাস্তাঘাট কাঁচা থাকার দরুন বর্ষাকালে জলকাদায় যাতায়াত অতি দুষ্কর।এ সমস্যা অবশ্য গ্রামে প্রতিবছর একবার করে আসে।কত সাইকেল আরোহী,ভ্যানরিক্সা যে উল্টে যায় তার ইয়ত্তা নেই।সুজন মাঝি বলল,আচ্ছা রণভাই,যেমন সাপের উপদ্রব কমালে,সেরকম চিঠি লিখে রাস্তাঘাট পাকা করানো যায় না!
-নির্ঘাৎ যায়।
-তোমরা এক কাজ করো,আজ সন্ধ্যায় তোমরা আমার বাড়িতে এসো।সরকারি রাস্তা পাকা করানোর জন্য একটা চিঠি লিখে দিতে বলব বাবাকে।তারপর রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।যারা অনেক রাতে কাজ থেকে বাড়ি ফেরে,তাদের সুবিধা হবে।
বছরখানেকের মধ্যে রাস্তাঘাট,আলো,পানীয় জল সবকিছুর ব্যবস্থা হল।নবীন সোম একদিন সকালে এসে বলল,রণবাবু,তোমার যা দরকার একবার বললেই আমি করে দেব।কিন্তু এভাবে বারবার চিঠি লিখে জমা দিও না।বুঝতেই তো পারছ আমাকে কৈফিয়ত দিতে হয়।
-তা দেবেন।আপনি তো ভালো কাজই করছেন।গ্রামবাসীও আপনাকে কত আশীর্বাদ করছে বলুন তো!
-রণবাবু,তুমি ছেলেমানুষ,তুমি বোঝ না।এসব অনেক ঝক্কির কাজ।সদর থেকে মহাকুমা,মহকুমা থেকে জেলা,এমনকি জেলা থেকে রাজ্য অবধি খবর পৌঁছে গেছে।মেদিনীপুরের এক বছর বারোর ছেলের বারবার অভিযোগে বীরপুর গ্রামের নবীন সোম নাজেহাল।
-তাই বুঝি!তা কাজ না করলে নাজেহাল তো হতেই হবে।
-বুঝেছি,আর কিছু করতে হলে বলো!
-গ্রামের স্কুলে নতুন মাস্টার লাগবে।কতদিন ধরে বলা হচ্ছে,বাবা তো বোধহয় শ’খানেক চিঠি পাঠিয়েছে।এ ব্যাপারটা দেখুন।
নবীন সোম খিকখিক করে হেসে বলল,সাধে বললাম ছেলেমানুষ!ও কাজ শিক্ষামন্ত্রক দেখবে।আমি ছাপোসা পঞ্চায়েতপ্রধান এতে কি করতে পারি?
-কিছুই পারেন না?
-না বাবা।
-বেশ তবে আমি কাল যাব কলকাতা।আপনি তো বললেন সেখানে অবধি নাকি আমার নাম পৌঁছে গেছে,ওখানে গিয়েই বলি আপনাকে ওরা কিছু করবার ক্ষমতা দেয়নি!
নবীনবাবু করুণ স্বরে বলল,ও নিত্যবাবু,আপনি কি কিছুই বলবেন না?
নিত্যানন্দ দাওয়ায় বসে বই পড়ছিল।সে বলল,ভুল কিছু বলেনি।গ্রামের মানুষের কষ্ট ও সহ্য করতে পারে না।ছেলেমানুষ তো!
-কে বলে ও ছেলেমানুষ?ছেলেমানুষ হলে মাত্র এক বছরে এ গ্রামের ভোল বদলে দেয়!বেশ আমি দেখছি।আপনারা যেন আবার ফস করে কলকাতা চলে যাবেন না।প্লিজ!আমি দেখছি।বাবা তোমার বন্ধুটি কোথায়?
-ঘরে আছে,কুনাল…
কুনাল এখন নিত্যানন্দ গাঙ্গুলীর ছোটছেলে বলেই গ্রামে পরিচিত।সে বেরিয়ে এল।রণ বলল,আপনার একটা ভুলের খেসারৎ দিতে গোটা গ্রামটা এখন কত সুন্দর করতে হল বলুন তো!এই ছেলেটার মা বিনা চিকিৎসায় না মরলে আপনি বেঁচে যেতেন।
বীরপুর গ্রামের নাম এখন লোকে রণবীরের গ্রাম বলে চেনে।দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসে রণর কাছে,তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে।রণ তাদের বলে এক হতে।এক হয়ে থাকলে সবাই ভয় পায়।হাতের পাঁচ আঙুল সমান নয়,কিন্তু এই পাঁচ আঙুল যখন এক হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হয়,আত্মরক্ষা আপনাআপনি হবে।তাই বিপদের সময় ভেঙে না পড়ে এক হয়ে লড়তে হবে।ধর্ম-বর্ণ-উঁচু-নিচ ভুলে এক হয়ে লড়তে হবে।সত্যবতী তার নাতির মধ্যে তার মৃত স্বামীর ছায়া দেখতে পায়।এভাবেই নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতেন তিনি।কুনাল একদিন ঠাম্মির পাশে শুয়ে মায়ের স্বপ্ন দেখল।মা যেন নৌকা বেয়ে কোথায় ভেসে যাচ্ছে।তারপর এক তীরে এসে নৌকা ভেড়ে।মা নেমে দাঁড়ায়,ইশারায় ডাকে কুনালকে।কুনাল দেখে সেও সুজন মাঝির নৌকা চেপে যায় সে ঘাট বেয়ে,ঘাট পেরিয়ে নৌকা এগিয়ে যায়।মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারে না কুনাল।মায়ের সেই অবয়ব ঘন জঙ্গলে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।ঘুম থেকে ধরপর করে উঠে পড়ে,ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে,সত্যবতী ছোটনাতিকে বুকে আগলে বলে,কি হল দাদু?ভয় পেয়েছিস?
কাঁদতে থাকে কুনাল।সত্যবতী বলে,মাতৃশোক সহজে ভোলা যায়!ও রণ!
রণ উঠে বলে,বেশ কাল সুজনদাদার নৌকা চেপে যাব।
-কোথায়?
-যে জায়গাটা স্বপ্নে দেখলি,সেখানে।
-ধুর!তা হয় নাকি?আমি কোন জায়গা দেখেছি,মনে আছে?
-মনে নেই?আচ্ছা মনে পড়ে যাবে।নে শুয়ে পড়।
আজ রোববার,ছুটির দিন।রণ আজ মাছ ধরবে মনস্থ করেছে।মাছ ধরা নেশাটা সাংঘাতিক।তাই সেটাকে এড়িয়ে চলে রণ।এতে প্রচুর ধৈর্য অধ্যবসায় প্রয়োজন।বাসি ভাত পচিয়ে,পচা ছাতু,পিঁপড়ের ঢিপি দিয়ে তৈরি মিশ্রণকে বড় যত্ন করে মাখতে হয়।তারপর বড় বড় মন্ড তৈরি করে গোটা পুকুরে ছড়িয়ে চার দিতে হয়।সেও এক মুন্সিয়ানার কাজ।ঠিকমত চার না দিলে মাছ আসবে না।তারপর বঁড়শিতে পাউরুটি কিংবা আটার ছোট ছোট মণ্ড গেঁথে টোপ তৈরি করতে হয়,ফাতনা ধরে মাঝ-পুকুর বরাবর ছিপ ছুঁড়ে ফাতনা ভাসিয়ে চুপ করে বসে থাকা,কখন ফাতনা নড়ে,মাছ টোপ খেয়ে চলে গেলে হয়ে গেল!কিন্তু বঁড়শিতে মাছ গাঁথলেই ফাতনা নড়ে উঠবে।তখন ক্ষিপ্রতার সাথে ছিপ টেনে মাছকে কাবু করে ডাঙায় তুলতে হয়।বড়োসড় মাছ হলে একার দ্বারা তোলা সম্ভব নয়।তখন দোসরকে জলে নেমে মাছকে কায়দা করে ধরে বাগে আনতে হবে।আজ অবশ্য দোসর কুনাল আর সুজন মাঝি।কুনাল মাছ ধরতে পারে না।সে সবিস্ময়ে দেখে রণদার এই কান্ডগুলো।সুজন মাঝি অত্যন্ত পটু।ছিপ ফেলেই সে একটা বড় কাতলা ধরল।গ্রামের বড় পুকুরে ওরা মাছ ধরতে বসেছে।রণ এখনও ফাতনার দিকে চেয়ে এক মনে বসে।নিজের মাছকে একটা বালতিতে রেখে সুজন রণর কাছে এল।বলল,বুঝলে রণভাই,নৌকা বেয়ে আর খাওয়া যাবে না।পারাপারের দিন বুঝি শেষ হয়ে এল।
-কেন?
-আর বলো না।কাল রাতের বেলা একা ফিরছি,বকশীগঞ্জের থেকে।চড়দীঘির মোড়ে একটা ঘাটে দেখি,এক সাদা শাড়ি পরা মহিলা,বুঝলাম বুঝি বিপদে পড়েছে।গেলুম।বলে কিনা ওর ছেলে জলে পড়ে গেছে,একটু খুঁজে দিতে!তুমি তো জানো রাতে নৌকা বাইলে আমার নৌকায় কাটারি থাকে।কাটারি উঁচিয়ে বললুম,কোথায় পড়েছে?বললে বিশ্বাস করবে না।একবার মাত্র মাথা নিচু করে জলের দিকে তাকিয়েছি, মুহূর্তে দেখি সেই সাদা মূর্তি যেন কর্পূরের মত উবে গেল।
-বুঝলাম।
-ও, তোমার বুঝি বিশ্বাস হলো না?
-অবিশ্বাসের কথা বললে বিশ্বাস হবে কেমন করে বল তো?
-বেশ তুমি তবে চলো।
কুনাল বলল,সে মহিলা কি তোমার জন্য এখনও সেখানে বসে আছে সুজনদাদা?
সুজন বলে,তা অবশ্য ঠিক।তবে কি আমি ভুল দেখলুম?
-না ভুল কেন?হতেও তো পারে মহিলা কোনও মানুষ না,অশরীরী।
কুনালের এই কথায় রণ ভীষণ রেগে বলল,শোন অশরীরীরা শরীরের সাথে কক্ষনো লড়তে পারে না।নয় সুজনদাদা ভুল দেখেছে,নয়তো এ কোন দুষ্ট লোকের কাজ।
বলেই এক ঝটকায় ছিপে টান দিল রণ।বড় একখানা কাতলা উঠেছে।হাঁটুজলে নেমে সুজন মাছটাকে তুলল।রণ বলল,যথেষ্ট হয়েছে,আর লাগবে না।কুনাল চ,বাড়ি থেকে মশলাপাতি নিয়ে আসি।আর চড়ুইভাতি হবে।কুনাল বলে,তবে সেই মহিলা…
-দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ঘুম,তারপর বিকেলে যাব সুজন মাঝির ভুতের কাছে।
-রণভাই তুমি রসিকতা করছ,আমি কিন্তু মোটেই মিছেকথা বলছি না।আমি সত্যিই…
এমন সময় নিকু আর রাখাল ছুটে রণকে ডাকতে এল,রণ খবর পেয়েছিস?
-কিসের খবর?
-কাল রাতে তরুণ মাঝি আর গোপাল ভুবনঘাটে মাছ ধরতে গিয়েছিল।এখনও ফেরেনি।ওদিকে যে কান্নাকাটি পড়ে গেছে।সুজন মাঝি বলে,বল কি?
-কি হল?বলল রণ।
-চড়দীঘির মোড়েই তো ভুবনঘাট।ওরা সেখানেই যায়নি তো!
রণ কথা না বাড়িয়ে বলল,চলো এক্ষুনি যেতে হবে।
নিকু ও রাখাল বলে,কোথায়?
-সব কথা পরে হবে।তোরা কুনালকে নিয়ে ঘরে যা।আমি আসছি।চলো সুজনদাদা।
কুনাল বলে,না আমিও যাব।
-না এখন না,শোন দুপুরের আগে আমরা ওদের নিয়ে ফিরে আসব।তোরা মাছ দুটো ঘরে রেখে নবীনবাবুকে খবর কর।
অগত্যা কুনালের যাওয়া হল না।সুজন মাঝির নৌকা চেপে ওরা চলল ভুবনঘাটের পথে।সড়কপথে গেলে তাড়াতাড়ি হতো,কিন্তু তার জন্য আবার সাইকেল নয়তো ভ্যানরিক্সা চাই।অত সময় নেই।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছনো প্রয়োজন।ভীষণ ভয়ে সুজন মাঝি দাঁড় বাইতে বেগ পাচ্ছে না বলে রণ বৈঠা হাতে নিয়ে হ্যাঁচকা টান মারল।বেশিদূর যেতে হল না।ভুবনঘাট-এর অনেক আগেই শূন্য একখানা নৌকা দেখেই ওরা চিনল এটা তরুণ মাঝির নৌকা।মাছ ধরার ছিপ,কিছু চার,দু’চারটে মরা মাছ নৌকায় পড়ে আছে।সুজন এক লাফে নৌকায় চড়ে এদিক ওদিক দেখল।রণ বলল,ডাঙায় চড়ে দেখো,আমি নোঙর ফেলে এক্ষুনি আসছি।
কিছুদূর এগিয়েও ওরা কারুর খোঁজ না পেয়ে অগত্যা আবার নৌকায় চড়ে ভুবনঘাটে গেল।সুজন মাঝির কথা মতো এখানেই সে দেখেছিল সে মহিলাকে।ঘাটের থেকে বারো-চৌদ্দ হাত দূরে একটা ভাঙ্গা কাঁচা বাড়ি।সেখানে আগে হয়তো কেউ থাকত,এখন আগাছা জঙ্গল,আর সাপখোপের বাসা ছাড়া কিছুই নেই।সেখানেও পাওয়া গেল না দুই কিশোরকে।রণ বড় হতাশ হয়ে পড়েছে।পাগলের মতন দুজন সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে তরুণ মাঝি ও গোপালকে।এমনটা তো কখনও হয়নি।রাততারাতি কি উবে গেল ছেলে দুটো? আবার অনেক সময় এমন হয়,গ্রামের ছেলেরা মাছ ধরতে যাচ্ছি বলে,বা খেলতে যাচ্ছি বলে শহরে চলে যায়।অনেক বছর পর তাদের খোঁজ পাওয়া যায়।রণদের স্কুলেরই একটা ছেলে ছিল,রোহিত বলে সেই ছেলেটি যাত্রা দেখতে যাচ্ছি বলে সেই যে গেল,আর ফিরে এল না।শুধু কি ছেলে ছোকরা!কুনালের বাপটাও তো সেই যে শহরে গেল,দুটো বছর ঘুরতে লাগল এখনও তো ফিরল না।
হতাশ হয়ে দুই কিশোর ফিরে এল গ্রামে।নবীনবাবুর বাড়ির উঠোনে তখন শ’খানেক লোক।রণকে দেখে নবীনবাবু বলল,বল রণবাবু,কোন খোঁজ পেলে?
রণ হতাশ ভাবে মাথা দোলাল।বলল,পুলিশে খবর করুন একটা।
-সে তো করতেই হবে।তোমরা আরেকটা কাজ করতে পারবে?
-সড়ক পথে আরেকবার যাব।
-হ্যাঁ,একবার দেখো।আমি স্টেশনেও লোক পাঠিয়েছি।বাস স্টপেও তোমরা একবার দেখো।
-আপনি চিন্তা করবেন না,আমি দেখছি।
কুনাল এবার আর পিছু ছাড়ল না।রণদার সাইকেলের ব্যাক-কেরিয়ারে চেপে সে গেল।রণ স্পষ্ট মনে থাকবে ভুবনঘাটে পৌঁছানোর মুহূর্তের ঘটনাটা।সুজন মাঝির সাইকেল আগে ছিল,সে হঠাৎ প্রচন্ড ব্রেক কষে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তায়।রণ ব্যাপারটা বুঝে সাইকেল থেকে নেমে সুজনদাদার কাছে গিয়ে ওকে তুলে জিজ্ঞাসা করতে যাবে কি হয়েছে!ওরা দেখল সাদা শাড়ি পরিহিত সেই মহিলাকে।মাথার চুল কোমর ছাড়ানো।চোখ দুটি বিকট রকমের উজ্জ্বল,কপাল ভর্তি লাল সিঁদুর।সেই মূর্তি পথের এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেল অত্যন্ত স্লথ গতিতে।পরে সুজন মাঝি বলেছিল,অনেকক্ষণ আগেই দেখেছিল সে মহিলাকে।তবে চমক সবে শুরু।কুনালের অনুপস্থিতি যখন টের পেল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।না,আর দেরি করা চলে না।এখন স্নায়ুকে দুর্বল করতে দিলেও চলবে না।তন্ন তন্ন করে ওরা এলাকা চষে বেড়াচ্ছে।আর কুনালের নাম ধরে অনবরত ডেকে চলেছে।মিনিট পনের পর এক জায়গায় সুজন মাঝি থমকে দাঁড়াল।ঘাসের ওপর টাটকা রক্ত।‘রণভাই এদিকে!’ রণ এসে রক্ত দেখে বুঝল,কুনালের বিপদ।রক্তের ছাপ ওদের সাহায্য করলই বলা চলে।কিন্তু কতদূর আর?দশ বারো পা পরেই ছাপ মিলিয়ে গেছে।সামনেই সেই পরিত্যক্ত ঘর।আরও সামনে ভুবনঘাট ফেলে রেখে এগিয়ে চলেছে নদী।রণ একখানা মোটা লাঠি জোগাড় করে ঘরটায় ঢুকল।সাপ থাকলে লাঠিতে কাজ হবে কি!সুজন ভয় পেল না।কুনালের এই আচমকা নিরুদ্দেশ হওয়াতে যেন মাথা কাজ করছে না ওর।যা বলবে তাই করবে সুজন।সকালে ওরা মাছ ধরছিল,সেই সদ্য জল থেকে তোলা মাছগুলো যেমন খাবি খাচ্ছিল,জলে আবার যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল,এখন ঠিক তেমনই অবস্থা রণর।কুনালকে না পেলে সে আর ফিরবেই না এমনই প্রতিজ্ঞা ওর।গোটা ঘরটাই লাঠি দিয়ে ঠুকেঠুকে রণ কি যেন পরীক্ষা করছে।কি পরীক্ষা করছে জানে না সুজন।একবার মাটিতে শুয়ে কান পেতে কি যেন করল।কয়েক মিনিট পরেই তরাক করে উঠে এক লাফে ঘরের ভেঙে পড়া একটা জানলা দিয়ে বাইরের দিকের নিমগাছটায় চলে এল।গাছের গোড়ার চটের বস্তাগুলো এক ঝটকায় সরিয়ে চোরাঘরের সন্ধান পেয়ে গেল।সুজনের মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরোচ্ছে না।সে শুধু ভয়ে ভয়ে একবার বলল,পুলিশে খবর…
রণ মুখে হাত দিয়ে চুপ থাকতে বলল,তারপর সে সংকীর্ণ পথ দিয়ে আসতে আসতে নামতে শুরু করল।সুজনও আসতে শুরু করায় তাকে থামিয়ে রণ ফিসফিস করে বলল,এক ঘণ্টার মধ্যে যদি না ফিরি,পুলিশে খবর দিও।আর একটা কাজ কর,যেভাবেই হোক তরুণ মাঝির নৌকাটা এই ঘাটে নিয়ে এসো।বেশি দূর নয়,সাঁতরে দশ মিনিট।
বলেই রণ নেমে গেল নিচে।সুজন নৌকা আনবে কি করে?এখন তো ওর পকেটে ফোন,মানিপার্স সব রয়েছে।টাকা পয়সা নয় ঘাটে রেখে যাবে,কিন্তু ফোন…ফোন।হ্যাঁ এক্ষুনি একটা ফোন করার দরকার নবীনবাবুকে।
নিশ্চিদ্র অন্ধকার।রণর ফোন নেই যে টর্চ জ্বালবে।একদম নিচের ধাপে পৌঁছে সে দেখল এক ষন্ডা মার্কা পালোয়ান তার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে।আর মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ আসছে।কোথা থেকে আসছে এখনও বোঝা যাচ্ছে না।ধুপ-ধুনোর গন্ধও যেন পেল।তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ওর।গায়ের জামাটা খুলে হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে পালোয়ানের দিকে এগোল।হঠাৎ পায়ে একটা কি ঠেকে বিকট আওয়াজ।সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ বন্ধ।সেই কন্ঠ এবার হাঁক দিল,মেধো,এই মেধো!
রণ বুঝল না,লোকটা সাড়া দিচ্ছে না কেন।সাহস করে লোকটার পাশে গিয়ে দেখল,লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই।কিন্তু চোখ বোজা।মাথায় রক্তের ছোপ,মানে যে রক্ত ওরা দেখেছিল,তা এই লোকটারই।হয়তো কুনালকে নিয়ে আসার সময়, ধস্তাধস্তিতে মাথায় আঘাত পেয়েছে লোকটা।রণ তার জামাটা দিয়ে ঘুমন্ত লোকটার মুখ বেঁধে ফেলল।আর লোকটার কোমরে একটা গামছা দেখতে পেয়ে,সেটা দিয়ে লোকটার হাত পিছমোড়া করে বাঁধল।ওদিকে আবার মন্ত্র উচ্চারণ শুরু হয়েছে।লোকটা কিন্তু এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন।রণ যে কি করে এত সব করছে সে নিজেও জানে না।লোকটার একপাশে একটা একটা প্রকাণ্ড খাড়া।এত বড় খাড়া আগে কখনও দেখেনি রণ।সে চেষ্টা করল খাড়াটা তোলার।অত্যন্ত ভারী!তবু যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে ওর উপর।খাড়াটা কাঁধে নিয়ে এগোতে থাকল সেই মন্ত্র উচ্চারণের ধ্বনির দিকে।বেশিটা যেতে হল না।একটা ছোট্ট গলিপথের পাশেই একটা ছোট ঘর।সেখানে এক উগ্র মূর্তির সামনে বসে এক প্রকাণ্ড জটাধারী কাপালিক দুর্বোধ্য সব মন্ত্র আওড়ে পুজো করছে।একটু দূরে,সেই মহিলা একটা বড় কলসি থেকে জল নিয়ে স্নান করাচ্ছে তিন কিশোরকে।কুনাল গোপাল ও তরুণ মাঝি।তিনজনই ঘুমে আচ্ছন্ন।তবে কুনালের মুখ বাঁধা।ওদের তিনজনেরই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা।রণ ভালো করে লক্ষ্য করল,মহিলা গোপালকে তুলে একটা হাড়িকাঠের রাখল,কাপালিক এবার উঠে দাঁড়িয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্র উচ্চারণ করছে।মহিলা এবার ডাকল,মেধো, তাড়াতাড়ি আয় বাপ,বলি সেরে আবার ছিলিম টানিস।এদিকে যে আমাদের গলা শুকিয়ে এল!এই মেধো!
এবার এমন একটা কাণ্ড ঘটল যে মুহূর্তে কাপালিক ও মহিলা যেন পাথর হয়ে গেল।ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘরে ঢুকে এসেছে রণ।চোখ লাল,শরীরের সমস্ত পেশী ফুলে উঠেছে।সুজন মাঝির থেকেও সুঠাম হয়ে গেছে এই বছর চোদ্দর কিশোরের শরীর।কাপালিক কিছু বলবার আগেই খাড়াটা মাথার উপর তুলে ছুটে এসে রণ সেই উগ্র মূর্তিটা দুটুকরো করে দিল।কাপালিক যেন কোন অজ্ঞাত কারণে মুহূর্তেই সংজ্ঞা হারাল।ওদিকে মহিলা ছুটে পালিয়েছে।এবার নিজেও চোখে অন্ধকার দেখছে রণ।পালিয়ে আর যাবে কোথায়? সুরঙ্গ থেকে বেরোতেই পুলিশ গ্রেফতার করে ফেলেছে রাক্ষসী সেই মহিলাকে।কাপালিক বাহিনীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।সেই সঙ্গে সেই চোরাকুঠুরি থেকে চার অচৈতন্য কিশোরকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।কুনালের সুস্থ হতে এখনও সময় লাগবে।এই কাপালিক বাহিনীর কাজের প্রসার অনেক।জাল ওষুধ তৈরীর একটা মস্ত আস্তানা তৈরি হয়েছিল।লক্ষাধিক টাকার ওষুধ উদ্ধার হয়েছে।সেই সঙ্গে ধর্মের নামে এক কুসংস্কারের আখড়া তৈরি হয়েছিল এখানে।প্রায় পঞ্চাশেরও বেশি নরকঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে কুঠুরি থেকে।রণবীর গাঙ্গুলির এই অসামান্য কীর্তি ও সাহসিকতার জন্য এই নাশলীলা শেষ হল।তবে সমাজে ঘুরতে থাকা অন্ধকারের বিনাশ করাটা নিজের মানবিক কর্তব্য বলে মনে করে ও।সত্যবতীর কোলে শুয়ে আছে দুই নাতি।তার দুই নয়নের মণি।সাত দুগুনে চোদ্দ রাজার ধন।
-হ্যাঁ রে দাদু,তোর ভয় লাগেনি?
-একটুও না।জানো ঠাম্মি আমার একটা কথাই তখন মনে হচ্ছিল,কুনালকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে!আর গোপাল ও তরুণদাদার জীবন আমি নিজের প্রাণ দিয়েও বাঁচাব।
কুনাল বলল,রণদা তুমি সত্যিই আমার হিরো!
নির্মলা ও নিত্যানন্দ কাছেই ছিল।নিত্যানন্দ বলল,বুঝলে গিন্নি!ছেলেটা আমাদের যতই ডানপিটে হোক না কেন,যতই পড়াশোনাতে খারাপ হোক।ওর মনটা সমুদ্রের চেয়েও বড়।
নির্মলা বলে,বালাইষাট!আর নজর দিও না!সোনা আমার,বুক জুড়ে থাক।