• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২০)

বেনু মশলাঘর

এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আনমনে কিছুক্ষণ নিউজ পেপারে চোখ বুলাল টোটন। দেখল উল্টেপাল্টে। বিরক্ত হয়ে রেখে দিল শেষে। ঘড়ি দেখল। ফ্লাইট একঘণ্টা লেট। হাই তুলল শব্দ করে। পাশের সুন্দরী ইউরোপিয়ান যাত্রীটি চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকাল একপলক। টোটনের চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল মুহূর্তে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল টোটন। মেকি আর মাপা ভদ্রতায় এদের জুড়ি মেলা ভার, জানে সে। মেয়েটার মুখের ওপর চোখ রেখে মুখে হাসি এঁকে বলল, সরি ম‍্যাম!
মেয়েটা তাকাল আবার। টোটনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল একবার। মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বলল, ইটস ওকে ডিয়ার!
মেয়েটার সাথে খুচরো আলাপ জমাল কিছুক্ষণ। কথা বলল টুকটাক। উঠে পড়ল খানিক বাদে। মন বসছে না। ভেতরের অস্থিরতাটা কাটানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বহুবার এই এয়ারপোর্ট পেরিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি দিয়েছে সে। সাইক্লিং এর নেশা তাকে টেনে নিয়েছে দেশ থেকে দেশে। কিন্তু এবারের মতো এমন অস্থিরতা তাকে তাড়া করেনি কোনোবারই। নিজের ভেতরে এমন অদ্ভুত অনুভূতি টের পেয়ে নিজেই অবাক হল টোটন। বাড়ি থেকে ফেরার সময় মা খুব কাঁদছিল। বরাবরই কাঁদে। কিন্তু মার কান্না তার ভেতরে তেমন ঢেউ তোলে না, যেমনটা এবার তুলেছে।
মাকে ছেড়ে আসার সময় বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছিল তার। মাথার ভেতরে কী যেন একটা ছলকে উঠতে চেয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল আবার। চোখ ঝাপসা। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল মার সাথে দেখা হবে না আর। কে যেন মনের ভেতর থেকে বলে উঠেছিল, আর দেখা হবে না রে টোটন! মার সাথে দেখা হবে না আর!
চমকে উঠেছিল টোটন। মার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন এক শূন্যতা ছড়িয়ে যাচ্ছিল বুকের ভেতর। মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনে মনে কেবল একটা প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিল টোটন। মা কি মারা যাবে? তন্ন তন্ন করে মার মুখে কিছু একটা খুজেছিল সে। না। মার মুখে মৃত্যুর কোনো ছায়া ছিল না। তাহলে কেন তার মনের ভেতর বেজে উঠল অমন অমোঘ সানাই, আর দেখা হবে না রে টোটন! মার সাথে দেখা হবে না আর! উত্তরটা খুঁজে পেল না সে। তারপর থেকেই ভেতরটা ভীষণ অস্থির হয়ে আছে তার। ভীষণ অশান্ত। বেনুটাও অসুস্থ খুব। কে জানে ফিরে এসে তাকে আর দেখতে পাবে কিনা। এবার বেনুকে যতটা না শারীরিকভাবে অসুস্থ লাগছিল তারচে ঢের বেশি তাকে মানসিকভাবে দুর্বল লাগছিল। মনে হচ্ছিল বাঁচার ইচ্ছেটাই মরে গেছে তার। টোটন অনেক বুঝিয়েছে তাকে। কতটা সে বুঝেছে কে জানে! বেনুর সাথে তার এখনকার সম্পর্কটাও ভারি অদ্ভুত আর খাপছাড়া। ভালোবাসা? নিজের মনের ভেতর হাতড়ে দেখল দেখল টোটন। বেনুকে এখনও ভালোবাসে সে? কিংবা বেনু তাকে? এই বয়সে এসে, এমন কঠিন সব বাস্তবতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেও ভালোবাসাটা কি থাকে আদৌ? থাকে কৈশোরের সেই মাতাল করা, বোধবুদ্ধি লোপ করে দেয়া সে ব‍্যাখ‍্যাতীত অনুভূতি! থাকে না সম্ভবত। নেই। তাহলে কেন এভাবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরের মত লুকিয়ে দেখা করা! প্রেমহীন, যৌনতাহীন এই সম্পর্কটাকে কী নাম দেবে সে? বন্ধুত্ব? বেনু কি শুধুই বন্ধু তার? গ্লোরির নাম শুনে কেন তাহলে ঈর্ষায় অমন জ্বলে ওঠে বেনু! টোটনই বা কেন হাজী বক্কর আলীর ছায়া পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে চায় সজ্ঞানে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে টোটন। বড্ড সিগারেটের তেষ্টা পায় তার। ইচ্ছেটা দমন করে অতি কষ্টে। গ্লোরির সমস্যা মোটামুটি সামাল দেয়া গেছে এবারের মতো। দেশ ছাড়ার আগে এটুকুই স্বস্তি।
ফেসবুকে কিছুক্ষণ ঢুঁ মারল টোটন। সময় কাটানোর জন‍্য এরচে উত্তম কিছু আপাতত তার হাতে নাই আর। পোস্ট দিল দেশ ত‍্যাগ উপলক্ষে। নিউজফিড স্ক্রল করল অভ‍্যাসবশত। অতঃপর নির্ধারিত ফ্লাইটের ঘোষণা এলে ধীরে সুস্থে গিয়ে বসল নিজের সিটে। প্লেনটা যখন উড়াল দিল ডানা মেলে ঠিক তখন মার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্তটা মনে পড়ল আবার। ভেসে উঠল চোখের সামনে। মুহূর্তে চোখের সামনে থেকে সরে গেল প্রিয় পরিচিত এয়ারপোর্টটা, চেনা দৃশ‍্যগুলো। ক্রমশ সেখানে জুড়ে বসল রাশি রাশি মেঘপুঞ্জ। সাদা শূন্যতা। হঠাৎ নিজের বুকের ভেতর থেকেও অমন কী একটা সরে গেল, টের পেল টোটন। কী যেন এক শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল সেখানটায়। কী যেন এক হাহাকার জুড়ে বসল তার বুকের নরম ভিটে। পাশে সিটে বসা ইউরোপিয়ান নারীটি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল টোটনের দিকে। টের পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হাসল টোটন। তাড়াতাড়ি টিস্যুতে চোখ মুছে অপ্রস্তুত, ধরা গলায় বলল, সরি ম‍্যাম!
হাসল মেয়েটি। সুন্দর, পবিত্র দেখাল তাকে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল টোটন। চোখে তখনও চিকচিকে জলবিন্দু। টোটনের চোখে চোখ রেখে মেয়েটা সরল গলায় বলল, এনি প্রবলেম ডিয়ার? ইজ এনিথিং রং?
ওহ নো ম‍্যাম! আই এ‍্যাম ফাইন! এভরিথিং ইজ ওকে!
মাথা দুলিয়ে টোটনকে সায় দিল মেয়েটা। এতবড় ধাড়ি ছেলের সামান্য কদিনের জন‍্য দেশত‍্যাগের মতো তুচ্ছ ঘটনায় এমন ভাবালুতা, ছেলে-মানুষী আচরণে খানিকটা অবাক, অন‍ভ‍্যস্থ দেখাল তাকে। সামনের স্ক্রিনে মন দিল সে। থ্রিলার মুভিতে ডুব দিল। আড়চোখে দেখল টোটন। সিটে গা এলিয়ে দিল সে। অস্হিরতা এড়াতে ডুব দিল নিজের ভেতর। পৃথিবীতে নিজের চে মহাসমুদ্র আর কিছু নাই, ভেবে, একচিলতে হাসল টোটন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।