গারো পাহাড়ের গদ্যে এস এম শাহনূর (পর্ব – ২)

মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই
➤জন্ম ও বংশ পরিচয়:
এই পুণ্যলোক মহাপুরুষ (জন্ম ১৮৫৮ – মৃত্যু ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪) ১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১৭ অগ্রহায়ণ বুধবার দিন তদানীন্তন ত্রিপুরা (কুমিল্লা) জিলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমার (অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার) নূরনগর পরগনার নবীনগর থানাধীন বিটঘর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহন করেন।তাঁর জন্মকালীন ১৭/১৮ দিন অনবরত বৃষ্টি বাদল হয়েছিল।এ জন্য সকলে তাঁকে বাদল বলে ডাকত। তার পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত (১৮২২-১৮৬৪) সুপণ্ডিত ছিলেন এবং মাতা রামমালা দেবী দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ণ সাধ্বী নারী ছিলেন।
➤পিতৃ- মাতৃ পরিচয়:
বহুদিন আগের কথা।যশোহর জেলার সারল গ্রাম।সেখানে সমবেদান্তগত কুথুম শাখীয় বাৎসল্য গোত্রীয় কেশব পঞ্চাননের সন্তান কার্ত্তিক চন্দ্র ভট্টাচার্য্যের জন্ম। পরবর্তী সময়ে জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকা জেলার পাইকারচর গ্রামে এসে বসবাস করেন।লোকনাথ দত্ত তদানীন্তন ত্রিপুরা কুমিল্লার চাঁদেরচর গ্রামে গিয়ে বসবাস করেন।লোকনাথ দত্ত হতে অধস্তন ৮ম পুরুষ মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের পিতা ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত।তবে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা সহ সকল গ্রন্থে পিতার নাম ঈশ্বর চন্দ্র ভট্টাচার্য্য পাওয়া যায়।দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের পিতৃদেব ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত শৈশবাস্থায় পিতৃহীন হলে বাল্যকালে তার পিতার মামারবাড়ি সুলতানপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড) হাবলা উচ্চ (হাবলুচ) গ্রামে গিয়ে বাস করেন।
তারপর তিনি তদানীন্তন ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত বিটঘর নিবাসী পাপড়াশী বংশীয় প্রাণকৃষ্ণ শিরোমনির একমাত্র কন্যা রামমালা দেবীকে(মহেশচন্দ্রের মা) বিয়ে করেন। প্রাণকৃষ্ণ শিরোমনির আর কোনো সন্তানাদি না থাকায় মেয়ের জামাইকে বিটঘরে ঘরজামাই করে রেখে দেন।এতে প্রমাণিত হয় বিটঘর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের জন্মভিটা ও মাতুলালয়। তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাঁদের চর গ্রাম।লোকনাথের বংশধর এখনো পাইকারচর এবং চাঁদের চরে আছে বলে জানা যায়।ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত ও রামমালাদেবীর ঘরে দুই ছেলে দুই মেয়ে। তারা হলেন,আনন্দ ভট্টাচার্য্য,মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যে,মোক্ষদাদেবী ও মুক্তিদেবী।
মহেশচন্দ্রের মাতৃদেবী রামমালা দেবী ও পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় প্রতিভাশালী পন্ডিত ছিলেন। ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত নিতান্তই এক দারিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বিটঘর গ্রামস্থ নিজ বাড়ীতে টোল খোলেন। টোলে আন্দাজ ৪৫ জন শিক্ষার্থী ছিলেন।তন্মধ্যে আনুমানিক ১৫ জনকে নিজ গৃহে রাখতেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা মোটেই সচ্ছল ছিলনা,টোলে পাঠদান শেষে বাড়ি ফিরে প্রায়ই দেখত ঘরে চাল ডাল লাকড়ি কিছুই নেই।প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে কিছু চেয়ে অথবা নিজে কাঠ কেটে ঐ দিনের সকল প্রয়োজন মিটাতেন। তথাপি তিনি বিদ্যার্থীকে অন্ন ও বিদ্যাদানের ব্রত হতে কখনও বিরত হননি।আগামীকালের চিন্তা কখনো করতেন না। তিনি সৎ ও কড়ালোক ছিলেন। তাঁর আন্তরিক আকাঙ্খা ছিল তিনি যেন অধ্যাপনায় সতত নিমগ্ন থাকেন।মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর লেখা ‘আত্মকথা’য় পিতার মুখে বলা উক্তি লেখেন, “আমি যেন আজীবন অধ্যাপনা করিয়া যাই,ইহাই আমার আকাঙ্খা। ” বাস্তবিকই তিনি ঘরে সকল পড়ুয়া রেখে ৪২ বৎসর বয়সে ৩দিনের জ্বরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন মহেশচন্দ্রের বয়স মাত্র ৬ বৎসর।
এ অকাল মৃত্যু মহেশচন্দ্রের পরিবারকে অথৈ দুঃখ
কষ্টে ফেলে দেয়। মাতা রামমালা দেবী লিখতে বা পড়তে জানতেন না, কিন্তু বহু সংস্কৃত শ্লোক ও বচন তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল।রামমালা দেবী অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির ছিলেন। তিনি বলতেন, ”আমি বাপের কোলে বসিয়া চন্ডালের সাক্ষ্য দিতে পারি।” (বাপের কোলে বসিয়া বাপের বিরুদ্ধে চন্ডালের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারেন)। মহেশ বাবু গৃহস্থালির কাজে মাকে সার্বিক সহযোগিতা করতেন।বিত্তশালী হওয়ার পরও তার মা পূর্বের মত পরিশ্রম করতেন।তিনি বলতেন,”কর্মই ধর্ম “। এতে মা আনন্দ পেতেন।মহেশচন্দ্রের ৩৫ বছর বয়সে তাঁর মাতা রামমালা দেবীও দেহত্যাগ করেন।তাঁর জীবন কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,পিতা-মাতার সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ তাঁর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে সবচেয়ে বেশি।