গল্পে শুভময় মজুমদার

আটপৌরে

বৈকাল শেষ হইয়া আসিবার পূর্বেই গৃহে ফিরিয়া আসিব স্থির করিয়া বাহির হইয়াছিলাম । হঠাৎ কোথা হইতে কালো করিয়া মেঘ করিতেই দেখি কেমন আঁধার নামিয়া আসিল। আষাঢ় মাসে ইহা অস্বাভাবিক নহে ঠিকই কিন্তু লক্ষ করিলাম পথচারী কেমন কমিয়া আসিয়াছে।চারিদিকে কেমন এক নিঝুম পরিবেশ । ম্যাজিস্ট্রেট বাংলো হইতে যে পথটি সরু হইয়া গিয়া বহরমপুর সংশোধনাগারের উত্তর প্রান্তে চলিয়া গিয়াছে আমি সেই পথটি ধরিলাম ।

বাল্য কাল হইতেই জানিতাম এই পথটি ভারী নির্জন । সন্ধ্যায় অনেকেই এই পথ এড়াইয়া চলেন। তাহার এক পাড়ে সংশোধনাগারের বিশাল প্রাচীর উঠিয়া গিয়াছে, অপর পাড়ে ইংরেজ আমলের প্রাচীন পরিত্যক্ত কিছু গৃহ। তাহাদের অধিকাংশের কড়ি বর্গার ছাদ ধসিয়া পড়িয়াছে । জানালার শিক বাহিয়া উঠিয়াছে ঘন লতানো জংলা প্রজাতির উদ্ভিদ। সদর দুয়ার এর সম্মুখে এমন ভাবে বুনো ঝোঁপ বাড়িয়াছে প্রয়োজনেও সেথায় যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য বলিলেই হয় ।হয়তো হাজার সাপের আড্ডা ।

আমি বেশ ধীর পদক্ষেপেই ফিরিতেছিলেম। হাঁটিবার সময় বিনা কারণে দ্রুততার অভ্যাস বহুকাল হইল বর্জন করিয়াছি। তাহাতে , পথে আমি যা কিছু দেখি , নীরবে উপভোগ করি। কোথাও অপূর্ব কোনো জংলী হলুদ পুষ্প লোকচক্ষুর অন্তরালে কেমন আনন্দে ফুটিয়াছে। কোথাও বা বুনো প্রজাপতিদের ডানা মেলিয়া সেই খেলা…
কিন্তু ঠিক তখন , হটাৎই মেঘের গুরু গম্ভীর গর্জনের সহিত মুষলধারে বৃষ্টি নামিয়া গেলো । তখনও সম্মুখে অনেকটা পথ। কোনক্রমে আমি পথ পার্শ্বের এক বিশাল কাঁঠাল বৃক্ষের ঘন পত্রের অন্তরালে আশ্রয় লইলাম।আর ঠিক সেই মুহূর্তে পথের বাতি গুলি নিভিয়া গেল। এমন আঁধার বহুকাল দেখি নাই। বিদ্যুতের , নীল আলোতে কেমন মায়ার মতন এক অচেনা পৃথিবী যেন চক্ষের সম্মুখে ভাসিয়া ওঠে আবার আঁধারে মিলাইয়া যায়.. সেই অদ্ভুত আলোয় আমার চোখে পড়িল দূরে ম্যাজিস্ট্রেট বাংলোর দক্ষিণে প্রাচীরের এক অংশে । আর ঠিক তখনই, আমার শিশুকালে এক প্রবীণের নিকট শোনা এক অদ্ভুত কাহিনী মনে ভাসিয়া উঠিল।

সেই প্রবীণ ছিলেন ইংরেজ আমলের এক নির্ভীক ডাকসাইটে উকিল। তাহার হাঁক ডাকে জজ সাহেবও নাকি নড়িয়া বসিতেন।সে বহুকাল পূর্বের কথা। ১৯২২ -২৩ সন হইবে। বহরমপুর ব্যারাক স্কয়ার তখন গোড়া সৈন্যদের শিবির। জেলায় সেই সময় তাঁহার বেশ নামডাক হইয়াছে।লালবাগে এক নিমন্ত্রণ বাড়ি হইতে গভীর রাত্রে সাইকেল করিয়া ফিরিতেছেন। দূর হইতে লক্ষ করিলেন ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাচীরে কাহারা যেন বসিয়া আছে। গ্যাস বাতির আলোকে স্পষ্ট না হইলেও একটু নিকটে আসিতেই দেখেন সারি দিয়া গোড়া সৈন্য বসিয়া তাহাদের বুট পরিহিত পদ সকল দোলাইতেছে। “এত রাত্রে?” উনি অবাক হইয়া আর একটু নিকটে আসিতেই তাঁহার চক্ষু স্থির হইয়া গেলো । প্রথমবার ওনার পৃষ্টদেশ দিয়া যেন ঠান্ডা স্রোত নামিয়া গেল!
“একি!?” পদ সকল দুলিতেছে ঠিকই কিন্তু কোমরের উর্ধ্বে তো কাহারো কোনো দেহাংশই নাই!”

সে রাত্রে তিনি কি ভাবে গৃহে ফিরিয়েছিলেন সেই কথা আজ আর মনে নাই , কিন্তু একলা সেই কাঁঠাল বৃক্ষের তলে আমার কেমন এক অদ্ভুত অসস্তি বোধ হইতে লাগিল। আঁধারে আর মহূর্মুহু বিদ্যুতের আলোয় কিয়ৎক্ষণ এর জন্য যেন সময়, কাল সকল কিছু একাকার হইয়া গেল। আমি যেন… সেই রাত্রি পুনরায় অনুভব করিতে পারিলাম।
বৃষ্টি তখনও থামে নাই । আমি আর কাল বিলম্ব করিলাম না । কাকের ন্যায় ভিজিতে ভিজিতে বহুকাল পর অতি দ্রুত পদ চালনা করিয়া গৃহ অভিমুখে রওনা দিলেম…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *