টালিগঞ্জ আগে জঙ্গল ছিলো। কলকাতা মানে কলেজ স্ট্রিট, সিমলে পাড়া, হাতি বাগান, হেদোর জলে ছেলেদের সাঁতার শেখা, অবশ্যই হিন্দু স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, হেয়ার বেথুন স্কটিশ চার্চ। রমরম করে চলছে কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, বৌবাজারের গয়না, বিয়ের কার্ড আরও সারি সারি দোকানের লাইন। আহা পুঁটিরাম, প্যারামাউন্ট, পাশের পানের দোকান যেখানে দু চারশ টাকাও দাম হতে পারে একখানা পানের, কালিকার চপ, বসন্ত কেবিন, ওহো।
এদিকে নরেন দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দর বাড়ি, দু পা হাঁটলে জি সি, কিনা গিরীশ ঘোষ মশাইয়ের ভিটে, পাশেই বাগবাজারে বলরাম বাবুর বাড়িতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ মশাইয়ের আড্ডাখানা, সবই হাঁটা পথের মধ্যে।
ভীম নাগের দোকানের বিলিতি মস্ত ঘড়িখানার সামনে দাঁড়িয়ে এই সব ভাবতে থাকলে গায়ে কাঁটা দেয়। পাশেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ।
এই সবই নতুন বউ তার বাপের চোখ দিয়ে দ্যাখে।
বাবা সারাক্ষণ গল্প করেন যে। ঐটা তাঁর ছোট বেলার পাড়া। ওখানেই ইস্কুল। হেদোয় দাপিয়ে সাঁতার কাটা। সামনের বাড়িতে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় থাকতেন। নজরুল আসতেন সে বাড়িতে। তাঁর গান শুনতেন ছোট্ট বাবা নিজেদের বারান্দায় ঝুঁকে
থেকে। বাবার বড়দাদা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার। খুউব ভালো ছাত্র। কলেজে পড়তে পড়তেই তাঁর বিয়ে হয়েছে বাগবাজারের মেয়ের সঙ্গে। বড় বৌদিদি যখন এসেছেন তখন বাবার বয়েস পাঁচের কাছে।
পাশ করে নতুন ডাক্তার পসার জমানোর জন্য বৃহত্তর কলকাতার খোঁজ করছিলেন। টালিগঞ্জ রেলব্রিজের পাশে দ্বারিকের মিষ্টির দোকানের উল্টো দিকে কবিশেখর কালিদাস রায় বাড়ি করে থাকছিলেন। তার পাশেই একটি চেম্বার ভাড়া নিলেন নতুন ডাক্তার।
সেই সময় বাবামশাইয়ের বয়েস পনেরোর কাছে।
রেলব্রিজের একেবারে পাশের গলি, চারু এভিনিউতে ভাড়া নেয়া হয়েছিল বাড়ি। খুব মন খারাপ নিয়ে কলকাতা থেকে গ্রামে থাকতে এসেছিল এই পরিবার।
আনওয়ারশাহ রোড আর তার সামনের মসজিদ এবং তার চারপাশের জমি জায়গায় এককালে ক্লাইভের আটকে রাখা দুই রাজপুত্রই ত রাজত্ব করেছেন।
আনওয়ার, গুলাম মহম্মদ, এরা সবই মহীশুরের নবাব টিপু সুলতানের বংশধর। নবাবকে যুদ্ধে হারিয়ে ইংরেজ শত্রু রবার্ট ক্লাইভ যুদ্ধবন্দী হিসেবে তুলে নিয়ে এসেছিল তার দুই শিশু পুত্রকে। তার বিবেক বাধেনি।
সারা জীবন এই বাংলাতেই কাটিয়ে গেল তারা। কোনদিন আর ফিরে যেতে পারল না নিজেদের দেশ, পরিবারের কাছে।
সেই নবাব বংশের খানদানি এন্টিক পালঙ্ক, তিন পাটের ভেনেশিয়ান আয়না লাগানো ড্রেসিং টেবিল বউকে কিনে দিয়েছিলেন দাদু।
দিদাদের ঘরে সাজের পরে একবার আয়নায় দেখে নেওয়ার আরামই আলাদা।
দাদুর ঘরের টেবিলে মস্ত পুরোনো সাদা কালো টেলিভিশন। অন্য ঘরে নতুন রঙিন টিভি আসছে। দাদু নিজেরটাই দেখেন।
গায়ত্রীদির ও টিভির নেশা। এটা ওটা কাজের ফাঁকে রান্নাঘর থেকে এক দৌড়ে দরজা দিয়ে ঢুকে টিভি দেখতে দাঁড়িয়ে পরে। ওদিক থেকে কেউ, গায়ত্রী চা কি হল ? বা কইরে রুটি দিবি বললি? বলে হাঁক পাড়লেই, জিভ কেটে, হইজ্যা একে বারে মনে ছিলনি, বলে এক দৌড়ে পালায় আবার।