মার্গে অনন্য সম্মান শাশ্বতী মুন্সী (সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৬৪
বিষয় – বিসর্জন

মুক্ত-অহং

থালায় সাজানো সাদা ভাত, উচ্ছে আলু সেদ্ধ, ঢ্যাঁড়সের তরকারি, পাশে বাটিতে ঝোল-আলু সহ এক টুকরো রুই মাছ। ডাইনিং টেবিলে রাখা থালাটির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন শঙ্করবাবু। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আরেকটা থালায় ভাত বাড়তে বাড়তে লোপাদেবী বললেন,
-” হাত গুটিয়ে বসে আছো কেন? বেলা গড়াতে চলল, খাওয়া শুরু কর।
-” কী দিয়ে খাব শুনি?”
-” মানে তোমায় কি শুধু ভাত দিয়েছি!”
-” ভাতের সঙ্গে খাওয়ার জন্য তরকারি দরকার।
-” এক তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না।
-” ও মাছের ঝোল বুঝি কোনও তরকারি নয়!”
-” যে কোন সবজি সেদ্ধ, শাক ভাজা, যাইহোক তরকারি, সাথে মাছের ঝোল কিংবা ডিমের ডালনা। আর নিরামিষের দিন ডাল, পোস্ত। এইসব ই তো খাওয়াচ্ছ.., শঙ্করবাবুর গলায় বিরক্তির ভাব।
-“. এর চেয়ে অন্য কিছু রান্না করতে পারব না। ভাতের পাশে দু’রকম সবজি নিয়ে চেয়ারে বসে পড়েছেন তিনি।
-” এ তোমার কেমন কথা লোপা, আগে তো কত রকম পদ করতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। নিরামিষের বাড়ে মোচা, ডুমুর, চালকুমড়ো, অন্যান্য দিনে কখনও শুক্তো, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মুড়িঘন্ট, ওল.. এখন যেন সে রান্না ভুলেও করো না.. “
-” দুটো মানুষের জন্য অতো হ্যাপা আমার ভালো লাগে না। “
-” তা বাড়ি ভর্তি লোকজন থাকলে তখন করতে ভালো লাগত..? “
-“হ্যাঁ লাগত। বাড়ি আমার ভরা থাকার ই কথা ছিল, যদি না তুমি অমন জেদ ধরে থাকতে.. “
-” জেদ বলো আর যাই বলো। এটা আমার সংস্কার। আমাদের বংশের এতকাল যা হয়নি, তোমার ছেলের জন্য তা ভাঙব না। তাছাড়া ওর জেদ ই বা কম কিসের! বাবার কথা মান্য করা ই তো ছেলের উচিত। “
-” বাবার অন্ধ জেদকে মেনে নিয়ে ভালোবাসার মানুষকে দেওয়া কথা না রাখার শিক্ষা সঞ্জুকে দিই নি। তাই বাড়ি ছাড়তে হলেও নিজের কথার দাম যে রেখেছে, তাতে আমি খুশি।”

এরপর স্বামীর সঙ্গে আর বাক্যালাপ না করে খেতে লাগলেন লোপাদেবী। অগত্যা ওপর পক্ষও ভাত ভেঙে খাওয়ায় মন দিলেন।

চাকরি জীবন থেকে অবসর নিতে শঙ্করবাবুর এখনও বছর তিনেক বাকি। অফিসে চলে গেলে ফাঁকা বাড়িতে একটুও ভালো লাগে না লোপাদেবীর। ছেলে বৌমা নিয়ে কোথায় ভর-ভরন্ত সংসার হবে, তা নয় ভাড়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। বৌমার বয়স কম, রান্না বান্না তেমন পারে কিনা কে জানে… ভালো কিছু রান্না করে দিয়ে আসবেন তার উপায়ও নেই। কঁচু শাকের ঘন্ট, ইলিশ পাতুরি, খেতে ছেলেটা খুব ভালো বাসে। বাজারে রুপোলি শস্য দাম সাধ্যের মধ্যে আছে। উনি বলেছিলেন মাছ এনে দু দিন ধরে খাবেন। কিন্তু স্ত্রীর করতে না চাওয়ায় বাড়িতে এখন ইলিশ ঢোকে নি। এমনকি মরসুমের সবজি দিয়ে না না রকম পদও রান্না করেন না। ছেলে যখন খাচ্ছ না, তখন আর ছেলের পছন্দের পদ রান্না করে কি হবে..

শঙ্করবাবু ও লোপাদেবীর একমাত্র ছেলে সঞ্জয় নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে রিমিতা দাসকে। জাত এবং আর্থিক অবস্থার দিক থেকে ওর পরিবার শঙ্কর ব্যানার্জীর সমগোত্রীয় না হওয়ায় এই বিয়েতে মত দেননি। উঁচু জাত ও উচ্চবিত্তের গরিমায় তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল। সঞ্জয় বাবাকে বুঝিয়ে ছিল। কিন্তু রাজি না হলে জীবনে প্রথম বাবার অবাধ্য হয়। মায়ের কষ্ট হবে বুঝে এলাকা ছাড়ে নি। বিয়ে হওয়া ইস্তক অন্যত্র ভাড়া বাড়িতে বাস করছে ন’মাস ধরে। যাতে রাস্তা ঘাটে দেখা হবার সুযোগ থাকে।

 মগড়ায় শঙ্করবাবুর মামারবাড়ি দুর্গাপুজো হয়। প্রতিবার দুটো দিন ওখানে ই কাটান সপরিবারে। মামাতো-মাসতুতো ভাইবোনেরা আসে। ছেলেকে ছাড়া প্রথম পুজো কাটাতে হচ্ছে লোপাদেবীকে। আর স্বামীর ওপর অভিমান হয়ে আছে -- দুই কারণে এবারে মামাশ্বশুরবাড়ির পুজোয় যাননি। তবে ঠাকুরের কোনও দোষ নেই। পাড়ার প্যান্ডেলে বসেই তিন/চারটে দিন কাটিয়ে দেবেন। শঙ্করবাবুও জোর করেন নি, একাই গেছেন।

যুগের বদলের সাথে সাথে একালের মেয়েরা পুজোর কাজে আগ্রহী নয়। মামাতো দাদা ভাইদের মেয়ে-বৌমা’রা দুর্গোৎসবে গ্রামের বাড়িতে আসে। কিন্তু পুজোর কাজে যেচে গিয়ে হাত লাগাচ্ছে না। তাই ছোট জাতের গ্রাম্য মেয়েরাই পুজোর কাজের যাবতীয় দিক সামলাতে দেখলেন শঙ্করবাবু।

পুজো শেষ। শঙ্করবাবুরা এদেশীয়। তবে প্রতিমা এনে, অন্ন ব্যঞ্জন, পায়েস, লুচি ভোগ দিয়ে ঘটা করেই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো করেন। ভেবেছিলেন এবছর বৌমাকে দিয়ে ভোগ রাঁধাবেন। কিন্তু সংসারে ই যে পুত্রবধূর ঠাঁই হল না… তাই পটের লক্ষ্মীকেই পুজো করবেন মনস্থির করেন।
একাদশীর দিন স্বামীর হাতে পুজোর ফর্দ ধরিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, কাল যেন এগুলো নিয়ে আসেন।
ফর্দে চোখ বুলিয়ে মুচকি হাসলেন তিনি।

দ্বাদশীর দিন ঠাকুর ঘর পরিষ্কার করে নিয়েছেন লোপাদেবী। গৃহস্থ বাড়িতে সন্ধ্যে পড়ে গেছে। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলতেই অবাক! দেখেন চৌকাঠের ওপারে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন শঙ্করবাবু। দুটো হাতের মুঠোতে ধরা আছে ছেলে বৌমার হাত।
-” তুমি মাটির প্রতিমা আনতে চাও নি, আমি তাই জীবন্ত লক্ষ্মী প্রতিমা নিয়ে এসেছি।”
অভাবিত আনন্দে চোখজোড়া সজল। শঙ্খ উলু ধ্বনি সহযোগে বরণডালা দিয়ে নতুন বৌমার গৃহপ্রবেশ হল।

বেনে দোকানের সামগ্রী ভর্তি ব্যাগটা বাবার হাতে বৌকে নিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে গেল সঞ্জয়। স্বামীর মনোভাব পরিবর্তনের কারণ জানতে উৎসুক লোপাদেবী। মৃদু হেসে জিজ্ঞাসু চাহনির উত্তর দিলেন।
বিজয়া দশমীর দিন জাতপাতের ঠুনকো অহমিকা বিসর্জন দিয়ে এসেছি। কুসংস্কার মুক্ত মনে তোমদের সাথে সংসার যাপন করব।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।