সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শ্রীরাজ মিত্র (পর্ব – ১৩)

ছায়াপথ, গুঁড়ো ছাই
যারা অপেক্ষা ও উপেক্ষা সইতে পারেনা তারা কখনও প্রেমিক হতে পারেনা। প্রেমিক হতে গেলে ছায়া হতে হয়। আর তাইই বোধহয় প্রেমিক হয়ে ওঠা হয়নি তার। সে তো ছায়া নয়, পথ হতে চেয়েছিল সবসময়। এই ভেবে কি মনে করে, সিগারেটটায় টান দিল মাস্টার। কেমন যেন এক ফ্যাকাসে শূন্যতার অনুভূতি।
যেখানে যেখানে শোভনা গেছেন, পেছন পেছন গেছেন জীবনানন্দও। ১৯৩২। ডায়াশেসন কলেজের ছাত্রী শোভনা, কত-ই বা বয়স তখন তার? ১৮-র বেশি তো নয়। জীবনানন্দ ৩৩ বছরের বিবাহিত যুবক। কানা দারোয়ানের হাতে স্লিপ পাঠিয়ে নীচে বসে অপেক্ষা করতেন শোভনার জন্য! কখনও মর্জি হলে শোভনা দেখা করতেন, কখনও করতেন না।
১৯২৯। ডিব্রুগড়ে ক্লাস নাইনে পড়েন শোভনা তখন। বেকার জীবনানন্দ চাকরি খোঁজের বাহানায় সেখানে গিয়েও উপস্থিত। দরজা বন্ধ করে শোভনাকে কবিতা শোনাচ্ছেন।শোভনার মা, জীবনানন্দর কাকিমা, সরযূবালা দাস রাগ করছেন, তবুও।
একবার তো সবাই মিলে শিকারে যাওয়ার বন্দোবস্ত হল। শোভনার বাবা অতুলানন্দ ছিলেন পেশায় ফরেস্টার। আইএফএস। তাই আয়োজনে অসুবিধা হলনা। জীবনানন্দ লেখাপড়ার আছিলায় শিকারে গেলেন না, শোভনাও শরীর খারাপের বাহানায় থেকে গেলেন। সারা রাত।
ডিব্রু নদীর ধারে বলে শহরের নাম ডিব্রুগড়। এই শহরেই এক দিশাহীন ও অনির্দিষ্ট প্রেমে দুজনে জড়িয়ে পড়লেন। যা সারাজীবন ধরে জীবনানন্দর লিখনে প্রধান চালিকাশক্তির হিসেবে কাজ করেছে।
এই কবিতাটি যেন তারই প্রমাণ।আসলে কোনও আড়াল নেই জীবনানন্দর রচনায়। একমাত্র ভালোবাসার আড়াল ছাড়া। বিমূঢ় রক্তের উত্তেজনায় পাখি যেভাবে পাখিনীকে পায় জীবনানন্দ দাশও কি সেভাবেই তাঁর প্রেমিকাকে কামনা করেছিলেন?
‘এই তাে সে-দিন
ডিব্রু নদীর পাড়ে আমরা ঘুরছিলাম
মনে হয় যেন হাজার বছরের ও-পারে চলে গিয়েছ তুমি
শুধু অন্ধকারে বাবলাফুলের গন্ধ যখন পাই
কিংবা কখনও-কখনও গভীর রাতে ঘাস মাড়িয়ে
তারার আলােয় সেই ব্যথিত ঘাসের শব্দ যখন শুনি
রক্তের বিমূঢ় উত্তেজনায়
তখন তােমাকে আমি পাখির কাছে পাখিনীর মত পাই।’
শোভনা তখন শিলঙে।কোনও একটা স্কুল বা কলেজে পড়াচ্ছেন। জীবনানন্দ সেখানেও গিয়ে হাজির। ১৯৪৭/৪৮ অবধি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও গল্প উপন্যাসে যে জোয়ার মনে হয় অনেকটাই শোভনার জন্য।সরাসরি শোভনা গল্প উপন্যাস ও কবিতায় চরিত্র হয়ে উঠছেন।
ভাঙনটা শুরু হয়েছিল আগেই।১৯৫০-এর পর শোভনা যখন জীবনানন্দর ল্যান্সডাউনের ভাড়া বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন ঢোকা বেরোবার সময়টুকু যা একবার মিলুদা ( জীবনানন্দ) র ঘরে মুখটা বাড়িয়ে দেখছেন মাত্র। মূল কথাবার্তা বা আড্ডাটা হচ্ছে জীবনানন্দ পত্নী লাবণ্য বৌদির সাথে। শোভনা নিজে তা স্বীকার করেছেন। জীবনানন্দও ১৯৪৮ -এর পর আর তেমন করে লিখছেন কি!
এতটাই হতাশ জীবনানন্দ যে বারবার তাঁর ডায়েরিতে Y তথা বেবি তথা শোভনা-কে হেরোদিয়াসের কন্যা রূপে উল্লেখ করেছেন।
ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আমার frustration-এর কারণ এই Herodias’s Daughter’।
কে এই হেরোদিয়াসের কন্যা?
বাইবেলের চরিত্র রাজা হেরোদ ও রানী হেরোদিয়াসের মেয়ে সালোমে। সালোমে অবশ্য হেরোদিয়াসের প্রথম স্বামী ফিলিপের ঔরসজাত। ফিলিপের রোমে যাওয়ার সুযোগে হেরোদ ও হেরোদিয়াসের সম্পর্কের এই অনাচার মেনে নিতে পারেননি সন্ত জন দ্য ব্যাপটিস্ট। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় এই কথা প্রচার করলে জন দ্য ব্যাপটিস্টকে বন্দী করা হল। কিন্তু বন্দী করা হলেও জনের বাণী ও কথাবার্তার এমন আকর্ষণ যে লুকিয়ে রাজা হেরোদ সন্তর বাণী শুনতে কারাগারে যেতেন।এটা স্বৈরিণী রানী হেরোদিয়াস টের পেয়েছিলেন। তিনি পথের কাঁটা দূর করতে মেয়ে সালোমেকে নৃত্য পরিবেশন করে তার সৎ বাবা হেরোদকে তুষ্ট করতে বললেন।এবং সৎ মেয়ের নৃত্যে হেরোদ সন্তুষ্ট হলে হেরোদিয়াসের পরামর্শ মতো সালোমে জন দ্য ব্যাপটিস্টের কাটা মাথা উপহার চাইলেন।
গল্প এতটুকুই। যুগেযুগে অসংখ্য গল্প- কবিতা-চিত্র-সঙ্গীত-সিনেমা সালোমেকে নিয়ে রচিত হয়েছে।বিশেষত অসকার ওয়াইল্ডের ‘সালোমে’ নাটকটির কথা উল্লেখ করতেই হয় কারণ জীবনানন্দ দাশ নিশ্চয় নাটকটি পড়েছিলেন।তাছাড়া জীবনানন্দর বাইবেল প্রীতির কথা আমরা জানি।অসকার প্রীতিও জানি। দীর্ঘ লেখালেখি আছে তা নিয়ে ।
দুটো দিক আছে এই তুলনার। এই উপকথার আড়ালে জীবনানন্দের অভিপ্রায় বোঝা কষ্টকর নয়। তাঁর পারিবারিক জীবনে হেরোড, হেরোডিয়াস, সালোমে বলতে কাদের বুঝিয়েছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কর্তিত মুণ্ড জন দ্য ব্যাপটিস্টের জায়গায় জীবনানন্দ দাশ কল্পনা করেছেন পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতায় বলিদত্ত আপন সত্তাকে। আসলে Y- এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জেরে সৃষ্টি হওয়া টানাপোড়েনে Y -এর মা ও বাবাও এই উপকথায় জড়িয়ে গেছেন।
আরেকটা দিকও আছে। সেটা মানুষের অপূর্ণতার দিক। এই গল্প আমাদের শেখায় হেরোদ এখানে জনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রায় পূর্ণ হতে হতেও হলেন না।
জীবনানন্দ দাশ সারাজীবন এই তিক্ততার পথেই তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছেন। অন্তত জীবনের শেষ দিকে।
জীবনানন্দের প্রেম ধূসর, জটিল, পিপাসার্ত, রহস্যময় ও তীর্যক ! মাস্টার অন্তত এমনটা মনে করে।
●●
এলাকার সবাই এ ব্যাপারটা মানে যে, ইলিয়াস ইকবাল সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মুসলমান। ছেলে মেয়েদের মানুষও করছেন সম্পূর্ণ মুক্ত চিন্তাধারায়। আবাসনের বিজয়া সম্মিলনী তে, ইলিয়াস সাহেবের মেয়ে রেণুকা আফ্রিন আবৃত্তি করেছিল “পুরুষোত্তম” কবিতাটা। আহা!
‘একটা সন্তান চাই রাবণের মত,
যে মায়ের চোখের জল
পারবে না সহ্য করতে।
একটা ভাই চাই রাবণের মত,
যে বোনের সম্মান রক্ষায়
ঝাঁপিয়ে পরবে মুহূর্তে।
একটা ভক্ত চাই রাবণের মত,
যে ভক্তি করবে মনপ্রাণ দিয়ে।
একটা শাসক চাই রাবণের মত,
যে দেশকে সাজাবে সোনা দিয়ে।
একটা স্বামী চাই রাবণের মত,
যে স্ত্রী বিবাহপূর্বে
অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে জেনেও
তাকে রাখবে পাটরানী করে।
একটা পিতা চাই রাবণের মত,
যে সন্তানদের ভালোবাসবে
পাগলপারা হয়ে।
একটা পুরুষ চাই রাবণের মত,
যে অপহরণকারী হয়েও
দাম দেবে আমার মতামতের।
যার কাছে আমার মনুষ্য সত্ত্বাই গুরুত্বপূর্ণ,
কিন্তু দাম নেই শরীরের।
সে আমায় অপহরণ করুক,
কিন্তু সম্মান হানি করবে না আমার।
আমায় সে রাখুক বন্দী করে,
কিন্তু মিথ্যে পুরুষত্বের অহংকার
সে চাপাবে না আমার ওপর।
তোমরা তোমাদের রামকে রাখো,
এমন পুরুষ চাই না আমার।
শো অফের ভালোবাসায় ব্যস্ত সে,
কিন্তু সংজ্ঞা জানে না ভালোবাসার।
স্ত্রীকে রক্ষা করতে না পেরে যে
স্ত্রীর কাছেই চায় অগ্নিপরীক্ষা।
সে পুরুষকে কি আদৌ ভালোবাসা যায়?
করা কি যায় তার অপেক্ষা?
যে পুরুষটি তার অন্তঃসত্ত্বাকে স্ত্রীকে
বিনা কারণে পাঠায় বনবাসে,
সেই পুরুষটির প্রতি ভালোবাসা দূরে থাক,
সম্মানটাও কি কভু আসে?
যে পুরুষটি নিজের সন্তানকে
সন্দেহের বশে করে পরিত্যাগ,
সে পিতা কি আদৌ
পিতা হতে পারে?
সন্তানের প্রতি দেখাতে পারে অনুরাগ?
যে পুরুষটির সন্দেহের কাছে হেরে
স্ত্রী ঠাঁই নেয় ধরণী মাতার ক্রোড়ে,
হায় রে সমাজ সেই পুরুষটিকেই
পুজো করে এসেছে যুগ যুগ ধরে।
সেই পুরুষটি চির দাহ্য যে,
নারীর ইজ্জতকে দিল সম্মান,
জানি না এ কোন নিয়ম,
যেখানে পদে পদে হয়
মনুষ্যত্বের অপমান।
তোমরা তাই রামকেই রেখো,
রামকেই বসিও দেবতার আসনে।
আমায় বরং রাবণ দিও,
আমি আমার শ্রদ্ধা জানাব তারই চরণে।
আমার পূজার ফুল
আমি তার পায়েই দেব,
যার নারীর প্রতি রয়েছে সংবেদনশীলতা।
যার কাছে নারী ভোগ্য নয় কোনোভাবেই,
যার ব্যবহারে প্রকাশিত রুচিশীলতা।
প্রতারণায় সে হেরে যায় নি,
উঠে দাঁড়িয়েছে দৃঢ় সাহস নিয়ে,
তোমাদের চোখে সে হয়ত অহংকারী,
আমার মাথা নত হয় তার পায়ে গিয়ে।
জানি না সে অসুর কেন?
অসুরের কি গুণ আছে তার?
অসুর হয়েও সে অসুর হল না,
দেবতা হয়েই আত্মপ্রকাশ হল তার।
মন্দিরে তার স্থান হল না, হল না তার স্থান কারো
পুজোর সিংহাসনে,
তবুও সে এমন এক সত্ত্বা,
যে গেঁথে গেল সবার চিন্তনে মননে।
যুদ্ধে তাকে মারা হল ঠিকই,
বলা হল তার অহংকার দমিত হয়েছে।
লক্ষ্য করল না কেউ কখনো
আসলে তার চরিত্র গৌরবান্বিতই হয়েছে।
তার অহংকার তার চরিত্রে বিরাজে,
তার অহংকার তার সত্ত্বায়,
তার হুংকারে অহংকার তার,
তীব্র অহংকারের বহিঃপ্রকাশ রুচিশীলতায়।
পুরুষোত্তমের মর্যাদা পেল না কেন সে
বিতর্ক থাক না হয় আজ,
আমার কাছে সেরা পুরুষ রাবণই,
তাই তার মাথাতেই তব পুরুষত্বের তাজ৷
খলনায়ক হয়েও নায়ক সে,
অসুর হয়েও দেবতা।
রাবণ দহন ব্যর্থ তাই,
তার দহনেই লুকিয়ে তার সফলতা।’
ষোড়শী রেণুকার মিষ্টি মেদুর ভাষ্যে সেদিন ম হয়ে গিয়েছিল সারা আবাসন। ক্ল্যাপ পড়েছিল প্রায় তিন মিনিটেরও বেশি।
ক্রমশ
(কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের জাত্যাভিমানে আঘাত বা আরোপ- এ লেখনীর বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো প্রকার সাযুজ্য আকস্মিক কিংবা দৃশ্যপট নির্মাণে সংবন্ধিত।)