ক্যাফে গল্পে সুবীর মজুমদার

অদ্ভুত সমিতি
“এরকম করলে চলবে কী করে! আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।”
বললাম আমি, মানে মনতোষ সরকার।
আমার কথায় সায় দিয়ে সমীর, বাচ্চু, কদলী, নারায়ণ, চঞ্চল, স্মৃতি সকলেই একসাথে বলে উঠল,
“দিতে হবে, দিতে হবে, আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।”
আমি অদ্ভুত সমিতির নেতা। গত দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এই সমিতির নেতা হয়েছি। নামের মতই আমাদের সমিতির সদস্যরাও অদ্ভুত। এখানে সবাই টেঁসে যাওয়ার পরেই সদস্য হতে পারে। সেই হিসেবে আমি ঠিক মনতোষ নই, তার ভূত। এখানে সবাই ভূত বা পেত্নী, কেউ গৃহস্থ, কেউ গেছো, কেউবা স্কন্ধকাটা, কেউ মামদো, কেউ শাকচুন্নি, কেউবা ব্রহ্মদত্যি – এই রকম আর কি! তাই আমাদের কথাগুলিও নাকিনাকি, মানে ঁ সহকারে পড়তে হবে।
দিনের বেলায় জঙ্গল, ভাঙা বাড়ি বা পোড়ো মন্দিরের মধ্যে কোনরকমে লুকিয়ে থেকে রাতের অন্ধকারে আমরা নিশ্চিন্তে বাইরে বের হতাম। এখন সে সুযোগও বন্ধ! গ্রামের রাস্তায়-রাস্তায় বিজলী বাতির আলোর ঠেলায় আমাদের অস্তিত্ব টেঁকানোই দায় হয়ে উঠেছে। গাছের ডালে, পাতার আড়ালে, ঘরের বাঙ্কে যাও বা লুকিয়ে থাকা যেত, তারও জো নেই এখন। গুনিন ডেকে ঝাঁড়ফুক করে সবাইকে খেদিয়ে দিচ্ছে। ভাঙা বাড়ি ও পোড়ো মন্দির সংস্কার করার ফলে এখন সেখানেও থাকা যাচ্ছে না। তাহলে এখন আমরা যাবো কোথায়, বলুন দেখি!
আমাদের গাঁয়ের নাম হঠাৎ গাঁ। হঠাৎ করে গড়ে উঠেছিল বলে এর ওরকম নাম হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে এসে সুন্দরবনের নদীর তীরে জঙ্গল সাফ করে আমরা বসতি স্থাপন করি। একসাথে কয়েকশো ঘর বাসা বানালে একটা গ্রামের মত তৈরী হয়। তখন তার কী নাম রাখা যায় ভাবতে-ভাবতে ঐ নামটাই দেওয়া হয়।
এতদিন ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা ছিল না। টেঁসে গেলেও রাতে তাই দিব্বি গ্রামের মধ্যেই থাকা যেত। কিন্তু বর্তমান সরকারই করলে সমস্যাটা। জায়গায়-জায়গায় ইলেক্ট্রিক বাতির ব্যবস্থা করে দিলে! ফলে আমাদের পক্ষে হয়ে গেল মুস্কিল। এখন আবার গুনিনরাও ঝাড়ফুঁক করে তাড়াচ্ছে। মানুষের মন থেকে ভয়টাই গেছে উবে।
তাই আজকের মিটিংয়ে সীদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল, যে করে হোক মানুষের মধ্যে ভয়টা ফিরিয়ে আনতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, আমরা মারা গেলেও শক্তিহীন মোটেও নই। আমাদেরও আছে গ্রামে থাকার অধিকার। প্রত্যেকে যে যেমন করে পারে গ্রামের লোকেদের ভয় দেবে। সাতদিন বাদে আবার মিটিং ডাকা হবে। তাতে সাফল্য বা ব্যর্থতার পরিমাণ দেখে আবার পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সাতদিন বাদে আবার সবাই একজোট হলাম। দেখা গেল, মিশ্র সাফল্য ও ব্যর্থতা অর্জিত হয়েছে। একদিকে আমি, বাচ্চু, কদলি এরকম জনা পঞ্চাশেক ভূত মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকাতে সক্ষম হয়েছি। আবার সমীর, চঞ্চল, স্মৃতির মত জনা পঞ্চাশেক ভূত হাসির খোরাক হয়ে ফিরেছে। নারায়ণের মত নরম মনের ভূতকে দেখে মানুষ তো কথায় ভুলিয়ে ফাইফরমাশ পর্যন্ত খাটিয়ে নিয়েছে!
বাচ্চু, কদলিরা তাদের সাফল্যে দারুণ উচ্ছ্বসিত।
বাচ্চু জাতে মামদো, সে বলল, “যাঁ ভঁয় দিঁয়েছি নাঁ ব্যাঁটা স্কুঁল মাঁস্টারকেঁ, টিঁউশন পঁড়িয়ে রাঁত কঁরে বাঁড়ি ফেঁরা ওঁনার জঁন্মের মঁত ঘুঁচিয়ে দিঁয়েছি, দাঁদা। গাঁছের আঁড়ালে ছিঁলাম। আঁমার দিঁকে টঁর্চের আঁলো ফেঁলে উঁনি তোঁ রীঁতিমত অঁজ্ঞান!” সে হাসতে লাগল।
কদলি হ’ল শাকচুন্নি, ও বলল, “আঁমি তোঁ গাঁছের উঁপরে ছিঁলাম। ব্যাঁটা পাঁহারাদাঁর যেঁই গাঁছের নিঁচে এঁসেছে, ওঁমনি তাঁর সাঁমনে হাঁজির হঁয়ে বঁললাম, আঁমায় বিঁয়ে কঁরবি তোঁ বঁল। ব্যাঁটা দিঁকবিঁদিকশুঁন্য হঁয়ে দৌঁড়ে পাঁলালো। আঁর জীঁবনে কোঁনও দিঁন পাঁহারা দিঁতে আঁসবে নাঁ।”
সমীর, চঞ্চল, স্মৃতিদের মুখ গোমড়া। সমীরকে রাতে দেখে মানুষ চোর ভেবে এলাকা ছাড়া করেছে। চঞ্চলকে একটা বাচ্চা ছেলে দেখে হেসেই খুন হয়েছে। বাচ্চাটা বলে কি-না, “এমা, কাকা ল্যাংটা!”
স্মৃতি তো এক ব্যাটা মাতালকে ভয় দেখাতে গিয়ে বিশ্রী অবস্থা থেকে নিজেকে কোন মতে বাঁচিয়ে ফিরেছে। মাতালটা রাতের বেলায় একা একটা মেয়েকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে প্রায় কুকর্ম করে আর কি! স্মৃতি তাকে এক থাপ্পড় কশিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেছে।
এবার আমি আমার কথাটা পাড়লাম।
“বন্ধুগণ, আমি তো একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটিয়েই ফেলেছি! ব্যাটা মোড়লকে মেরেই ফেলেছি। জানি না, এবার কী হবে!”
আমার কথা শুনে সবাই হায়-হায় করে উঠল।
“সেঁকি! দাঁদা, এঁটা কীঁ কঁরেছেঁন! এঁবার যঁদি সেঁই রাঁগে সঁবাইকেঁ গ্রাঁমছাঁড়া কঁরে ছাঁড়ে তঁখন কীঁ হঁবে?!”
আমি জিভ কেটে, নিজের কান মলে বললাম, “সঁত্যিই ভুঁল হঁয়ে গেঁছে আঁমার। আঁরও ধৈঁর্য্য ধঁরা উঁচিত ছিঁল। ব্যাঁটা মোঁড়ল আঁমাকে দেঁখে বঁন্দুক বাঁগাতেঁই আঁর নিঁজেকে কঁন্ট্রোল কঁরতে পাঁরি নিঁ; ওঁনার ঘাঁড়টাঁই মঁটকে দিঁয়েছি।”
যাই হোক, এখন কী করা যায় – এটাই হ’ল আলোচ্য বিষয়। মোড়লের মৃত্যু কি আমাদের পক্ষে সর্বনাশ ডেকে আনবে, না মানুষ ভয় পেয়ে আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দেবে?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য রফা হ’ল। মোড়লেরই ছেলে গোপনে আমাকে ডেকে পাঠালে। দু’জনে সলা-পরামর্শের পর ঠিক হ’ল, গ্রামে ভূতেদের জন্যে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। যদি তারা রাতে সেখানে থাকতে রাজি হয় তো থাকতে পারে। ঐ বাড়ি ও তার আশপাশ থেকে সমস্ত রকম লাইট সরিয়ে নেওয়া হবে। সে আন্তরিকভাবে অনুরোধ করল যেন আমি বুঝিয়ে-শুনিয়ে সব ভূতেদের রাজি করাই।
আমি তার প্রস্তাবে প্রথমে সম্মত ছিলাম না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে সম্মতি দিলাম। আমাদের আলোচনার মাঝে মোড়লের একমাত্র মেয়ে দু’জনের জন্যে চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি এর আগে কোনও দিন তাকে দেখি নি। এত সুন্দর একটা মেয়ে যে আমাদের গাঁয়ে থাকতে পারে, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। মেয়েটির নাম রূপসা। আহা, কি অপরূপা!
ওর প্রতি আমার আগ্রহ দেখে মোড়লের ছেলেই প্রস্তাবটা দিলে, অবশ্য ওর বোন ঘর থেকে যাওয়ার পর।
“কি হে, চলবে নাকি? আমার কাজটা করে দিলে একে তোমার জন্যে ব্যবস্থা করে দেব।”
আমি বললাম, “কিঁন্তু ওঁ যঁদি রাঁজি নাঁ হঁয়, বিঁশেষ কঁরে আঁমি যেঁহেতু ভূঁত!”
আমার কথায় মোড়লের ছেলে দরজার বাইরে কারো উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কিরে, পছন্দ তো?”
কোন জবাব এল না, শুধু একটু হালকা হাসির শব্দ ছাড়া।
মোড়লের ছেলে বললে, “হ্যাঁ, ও রাজি।”
এরপর আমি সব ভূত-পেত্নীকে মোড়লের ছেলের প্রস্তাবে রাজি করালাম। প্রথমে আপত্তি করলেও ধীরে-ধীরে সবাই প্রস্তাব মেনে নিল। আমার জয়জয়কার করতে লাগল। যদিও ওরা আসল ব্যাপারটা বুঝল না।
আমার তো পোয়া বারো! গাছেরও খাচ্ছি, আবার তলারও কুড়াচ্ছি। ইতোমধ্যে গোপনে রূপসার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। একটি সন্তানও হয়েছে আমাদের। জানতে চাচ্ছেন, কী করে হ’ল? সেটা না হয় গোপনই থাক।