ক্যাফে ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ১)

ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলো

সঞ্জীব ও আমি পার্শ্বশিক্ষক। আমরা দুজনেই কালনা প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিউটে ডি.এল. এড ট্রেনিং নিচ্ছি। কেতুগ্রাম থেকে কাটোয়া বাসে এসে কাটোয়া ব্যান্ডেল ট্রেনে কালনা আসি। আরও অনেক বন্ধু, ভাই আছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যাওয়া করেন। আমাদের ম্যাডাম যারা ট্রেনিং নিচ্ছেন সকলের সাথেই সকলের একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়ে গেছে। যে সব স্যার, ম্যাডাম আমাদের শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করছেন তাদের আদর, যত্ন আমাদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
ম্যাডাম বললেন,বিরাজুল,নুর,জয়ন্ত শোনো। সরকারের দেওয়া এই সুযোগ হাত ছাড়া কোরো না। তোমাদের জন্য আলো অপেক্ষা করছে।

আজ বুধবার। কালনা স্টেশনে বসে আছি। কলেজের ক্লাস হয়ে গেলে টোটো গাড়িতে আমরা স্টেশনে চলে আসি। তারপর একটু বসে সাসামান্য টিফিন করি। গল্প হয় নিজেদের মধ্যে। সেদিন ট্রেন লেট ছিলো। পাখার তলায় বসে ঘুমিয়ে পরেছি। আমার বয়স বেশি বলে কোনো বন্ধু ডিসটার্ব করে নি। তারা একটু দুরে বসেছিলো। সেটা অবশ্য ঘুম ভাঙার পরে জানতে পেরেছিলাম।

ঘুমিয়ে আমি দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। দেখছি আমি আর আমার বন্ধুদের আমাদের ইংরাজী ম্যাডাম আলোর পথে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। ঠিক তখনই আনন্দে আমরা পথে চলেছি। তারপর ম্যাডাম আরও অনেক ছাত্র ছাত্রীদের আলো দেখাতে চলে গেলেন। তিনি তো দেবদূত। একদলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না।

তারপর আমরা চৌরাস্তার।মোড়ে থমকে গেলাম। দেখলাম চারদিকের চারটি বড়ো বড়ো রাস্তায় বড়ো বড়ো গাড়ি হাইস্পিডে চলছে। আমরা কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা হারিয়ে গেছি। সঞ্জীব পরোপকারী পার্শ্বশিক্ষক, দিলীপ বাবুকে দেখতে পাচ্ছি। তারা অগ্রপথিক হয়ে আমাদের নিয়ে চলেছেন বড়ো রাস্তায়। প্রসেনজিৎ বললেন, ওই দেখুন এই রাস্তার শেষে সাগর। বিরাজুল বললেন, আর একটু এগোলেই জয়। মৃতুঞ্জয় বললেন, আপনাদের সামনের পথগুলো সুন্দর। সাবধানে এগোবেন। গানে ভুবন ভরানো তিন ম্যাডাম এবার এগিয়ে যাওয়ার গান গাইলেন। গানের স্যার, বাংলা স্যার,আরও সব স্যারদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। আর একটা পথে সকলে গেলাম,সেখানে নতুনএক আকাশ। শেষে সেক্রেটারি সাহেব এসে আমাদের কলেজে নিয়ে এলেন। তারপর বললেন, জীবনের ধর্ম স্বপ্ন দেখা। তিনি হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। এবার আপনাদের স্বপ্ন সত্যি হবে। মা কে ডাকুন। মা সাড়া দেবেন নিশ্চয়।

ট্রেনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বন্ধুরা ডাকছেন, উঠুন, উঠুন। এবার ট্রেনে বসে ঘুমান। ভালো ঘুম হবে। আলো আঁধারি স্বপ্নের আনন্দে আমার আর ঘুম এলো না। আমার পুরোনো দিনের কথা মনে করতে ভালো লাগে। তাই ট্রেনে বসেই আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে শুরু করলাম হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা…

আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।