প্রবন্ধে শান্তময় গোস্বামী

বিচ্ছিন্ন কিছু প্রলাপ
১)
বয়স যেখানে এলে কমলা লেবুতে পাক ধরে, দেহে গেরুয়া-লাল রঙের প্রলেপ নিয়ে গন্তব্যের স্বাদে মিষ্টি হয়ে ওঠে… একটি সবুজ কমলা সেখানে এসে দেখে… দোকান বন্ধ করে রঙমিস্ত্রি হারিয়ে গেছে। রঙের তৃষ্ণা নিয়ে দোকানের বাইরে সবুজ কমলাটি বুক পেতে বসে থাকে, দোকানদারের অপেক্ষাতে। বসে থাকতে থাকতে উত্তল হতে থাকে তার বুকের মাংস ও স্থুলতা, বাড়তে থাকে ক্যালেন্ডারের বয়স। বড় হতে হতে সবুজ কমলাটি ক্রমশ বাতাবী লেবু হয়ে ওঠে। তারপর কারো ডিশে কাঁচালঙ্কা-লবণে জারিত হয়ে ছটফট করতে থাকে আর নিজেকে ভাবতে থাকে ব্যর্থ কমলা।
এক বাতাবী লেবু নিজেকে ভাবতে থাকে অভিমানী কমলা, যে ছোট হওয়ার ঝুঁকি নেয় না।
২)
পৃথিবীর মন খারাপ হলে, কবিতাও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। উগড়ে দেয় যাবতীয় বদহজম। কবিতাদের এই উগড়ানো রোগে পৃথিবীর ছন্দ শূন্যতা ব্যাধি হয়… শুকিয়ে যায় সমস্ত প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা। নানান সাহিত্য সভার তুমুল তৃষ্ণায় আকাশে মেঘ ওড়ে না… দূরবীণ দিয়ে শুষে নেয় আসন্ন বইমেলার যাবতীয় বিজ্ঞাপন। পৃথিবীর সমস্ত আঙুরগাছে আপেল ধরে, জলপাইগাছে ফুল আসে মহুয়ার… কেবল কবিতা নিভে যায় তৃষ্ণাতে। গোপন জলাশয়ের তুমুল তৃষ্ণাতে পৃথিবী শুকিয়ে যায় কবিতা শূন্যতায়।
পৃথিবীকে প্রকৃত সাহিত্যরসের অনুপান খাওয়াতে হবে তাহলেই কবিতায় ভরে উঠবে আবার যাবতীয় বইমেলার টাটকা রসের দোকান!
৩)
ঘুমের নেশা পেয়ে বসেছে আমার এই দুর্দিনে। কবিতা আসছে না শত প্রচেষ্টাতেও। এই না লিখতে পারার যন্ত্রণায় দিনরাত টাল খেয়ে যাচ্ছি… উঠোনে মাঘের রোদে পোড়ে ভেজা গামছা… জানি জয়িতা অপেক্ষায় থাকবে আমার নতুন কবিতার শরীরে দামী নখ—পালিশের আঁচড় দেবে বলে। ভিজে যাবে বলে পাশে সুগন্ধি রুমাল রাখে সে।
শহর ঘুমাবে আজ প্রধান সিনেমায় আকর্ষণীয় দেবের গল্প শুনে। সন্ধ্যেগুলো শুনশান এতো বেশি যে দিশি কুকুরগুলো রমন জটলাতেও ভয় পায়। মাঝরাতে কেঁপে কেঁপে উঠি রাতের নানান গোঙানি তোলা লালবাতি দেখে! গতকাল পাশের ওই বোসেদের বন্ধ বাগানে মরেছে কেউ…কিংবা মরবে আজ, কাল বা পরশু কখনো। গন্ধটা এখনও বেশ কড়া আর উদগ্র। নাকে কাপড়চাপা দিয়েও স্বস্তি আসছে না।
এরকম ভীতিটানা খাতার পাতায় লেখাজোখা চলে। রোজকার বাতাসভর্তি শোকবার্তা ভীড় করে খাতায়। রোজ ভাবি সেরে যাবে পৃথিবীর রোগ। রোজ ভাবি ভয় কেটে যাবে সবকটা জানালার রঙিন পর্দায়… ঘুলঘুলির চাঁদমারিতে। কিন্তু ঘুমের ভেতর দিয়ে বয়ে চলে পবিত্র ফল্গু। হরির নামে নানান সুরের সম্মেলন। আমি আমার মৃত বাবার কথা ভাবি… মায়ের কথা মনে পড়ে। এইসব ভাবি আর চোখ ছলছলে জেগে থাকি। প্রেম আর পরকীয়া তখন পাশাপাশি হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকে ওই সর্ষেক্ষেতে… দোকা!
৪
প্রৌঢ়া সাধিকা ঈশ্বরের কথা বলছিলেন। তার গলায় রুদ্রাক্ষের অনেকগুলি মালা। সাধিকাজনিত শ্বেত পোশাক দেখলে শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রম জাগে। কিন্তু সঙ্গের ওই কম বয়সী তরুণীর মুখ? চোখের ভাষা? কেমন যেন সন্দেহ হয়। মনে হয় মুখটা যেন একজন খুনির। চোখদুটো যেন একজন উন্মাদের। অসাধারণ দেহসৌষ্ঠব। শরীরের উত্তল, অবতল, খাঁজ-খোঁজ একেবারে শতাংশের নিরিখে সঠিক। কামপ্রতুলতা সারা অঙ্গে… যেন সারা শরীর জড়িয়ে বেড় দিয়ে আছে এক ক্ষুধার্ত ময়াল। এই তরুণী আমাদের এই নতুন আশ্রমের এক নবাগত সাধিকা। অল্পদিনেই বিশ্বাস অর্জন করেছেন প্রধানার। শুনেছি নানান প্রক্রিয়া ও সাধনার স্তর তার অধিগত। তাই আগত ইচ্ছুক প্রার্থীদের দীক্ষাদানে অনুমতি পেয়েছেন।
প্রায় মাসখানেক হল এই আশ্রমে আমি এসেছি। অবশেষে এল সেই মুহূর্ত। আজ আমার দীক্ষা গ্রহণের অপেক্ষার অবসান হবে। ওষ্ঠে দোল দিয়ে তরুণী সাধিকা বললেন, আমাকে বিশ্বাস করো?
হ্যাঁ। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই আশ্রমে হয়তো আমি আমি আর থাকতে পারবো না।
কে তবে তোমায় দীক্ষা দেবে…? নতুন কোনও সাধিকা?
না, না… আমি আপনাকেই চাই।
সাধিকার মুখে এক অন্য হাসি ফুটে উঠল। কেন জানি, সেই হাসি আমার ভালো লাগল না। কেমন যেন এক ক্রূরতা আছে সেই হাসির মধ্যে।