সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ১৪)

তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন

২৩
পিসেমশাই বললেন, তন্ত্র মন্ত্রে শুধু ভূত প্রেত তাড়ানো নয়, অনেক রোগও ভালো করা যায়। অনেকে এর সাহায্যে মানুষকে উচাটন মন্ত্রে ভিটেছাড়া করানো যায় এমনকি শারীরিক ক্ষতি করা যায়। একবার এক ফাঁসির আসামীর স্ত্রী এসে আমার পায়ে পড়ে বলে, যেমন করেই হোক আমার স্বামীকে বাঁচান। আমি প্রয়োজনে লক্ষ লক্ষ টাকা আপনাকে দেব। পিসেমশাই বললেন, এসব বলতে নেই। তোমার স্বামী দোষী হলে সাজা পাওয়া উচিত। তার স্ত্রী বললো আমার স্বামী কাউকে খুন করে নি। ওকে বাঁচান। পিসেমশাই বলেছিলেন, তাহলে সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করো। ন্যায্য বিচার যাতে হয় তার ব্যবস্থা আমি করতে পারি। স্ত্রী খুশি হয়ে চলে গেলো। কারণ ও জানত ফাঁসি রদ হবেই। হয়েছিলোও তাই। বিচারক আসামীকে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন। পরে জানা যায় ওর স্বামীর উপর কেউ শত্রুতা করে ঝুটা ইলজাম চাপিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু ও দলে ছিলো। ওর বারণ খুনিরা শোনে নি। এক প্রত্যক্ষদর্শী একথা বলে। পিসেমশাই বললেন, সত্যের জন্য তন্ত্র সঙ্গ দেয়। যেসব তান্ত্রিক অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেষজীবনে। পিসেমশাই আরও বললেন, তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ মা তারা কেউ বা শ্মশান কালীর ইষ্ট করেন। এছাড়া অন্যান্য দেবীরাও আরাধ্যা হয়ে থাকেন। উক্ত সব শক্তি দেবীর দীর্ঘ তালিকা নথিবদ্ধ আছে। এই সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয়। বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর লক্ষণ বিবৃত হয়েছে। তন্ত্র গুরুকে একধারে সত্যবাদী নির্ভীকহতে হয়। গুরুকে সর্বশাস্ত্র বিশারদ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্টভাষী, বিচক্ষণ, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে। আমি বললাম তাহলে শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণবিচার রয়েছে।শিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য আলাদা আলাদা হয়। এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গোপন। তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার জন্য বিভিন্ন শব্দ ও তার নতুন অর্থ তৈরি করেছেন, তাই নয় পিসেমশাই।
পিসেমশাই বললেন , হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। তবে এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ঈশারাও বলা যায়। যেমন বলে দিই মাকালী বীজমন্ত্র, ‘বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং। যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে ‘ক্রীং’। এইভাবে ‘ভুবনেশ্বরী বীজমন্ত্র’হ্রীং’, ‘লক্ষ্মীবীজ’ ‘শ্রীং’। যুগ্ম বীজও আছে, যেমন ‘তারাবীজ’ ‘হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট’ বা ‘দুর্গাবীজ’ ‘ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ’। এইটি অতি দীর্ঘ তালিকা ও এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
রতন বললো, তন্ত্রসাধনে ‘গ্রহণ’-এও সিদ্ধিলাভ সম্ভব। হিন্দু শাস্ত্রে ‘গ্রহণ’ নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত। এই গ্রহণ বলতে কি বুঝব। পিসেমশাই বললেন, তান্ত্রিক মতে, তান্ত্রিক সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের মন্ত্র সাধনা এবং গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছর ভর গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। গ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সাফল্য আসে।
আমি বললাম এবার জেনে নিই, কী সাফল্য পাওয়া যেতে পারে গ্রহণকাল থেকে,চাকরি বা ব্যবসায় উন্নতি চাইলে, কিভাবে পুজো সারতে হয়।
পিসেমশাই বললেন, গ্রহণের আগে স্নান সেরে পুজোর ঘরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে,তার সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে, গ্রহণ শুরু হওয়ার পর পুজো করতে হয়। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মন্ত্র জপ করতে থাকে তান্ত্রিক। ‘ওঁ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলে কমলালয়ে প্রসীদ প্রসীদ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলভ্যে নমঃ’। বাড়িতে আলাদা করে কোনও ঠাকুরঘর না থাকলে যে কোনও শান্ত, পবিত্র স্থানে ঘট প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে পারেন।মামলায় জয় লাভ করা সম্ভব যদি গ্রহণ শুরুর সময় বগলামুখী মন্ত্র এক লক্ষবার জপ করে গোটা হলুদ, হলুদ ফুল আর কেশর দিয়ে পুজো করার পর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় কেউ।
রতন বলে আপনি বলেছিলেন এর আগে একই সঙ্গে পুজোর পর একটি শিব রুদ্রাক্ষ শিবলিঙ্গের সামনে রাখতে হয়। গ্রহণ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ গোটা হলুদের মালা হাতে নিয়ে এই মন্ত্র জপ করতে হবে: ‘ওঁ হ্রীং বগলামুখী সর্বদুষ্টানাং বাচং মুখং পদং স্তংভয় জিহ্বা কীলয় বুদ্ধি বিনাশায় হ্রীং ওঁ স্বাহা’।তন্ত্রের ভুল ব্যবহার থেকে মুক্তি পেতে চাইলে গ্রহণের সময় একটি জবা, বড়ো, ডাব ও লঙ্কা নিয়ে নিজের শরীরের ওপর সাতবার বুলিয়ে বা ঘুরিয়ে দশটি লেবুটিকে টুকরো করে কেটে ফেলতে হয়। এবার সেই টুকরোগুলি চৌরাস্তার চার দিকে ফেলে দিয়ে আসতে হয়।ভূ-লোকে জয় লাভের জন্য একটি বেদি রচনা করতে হয়।
পিসেমশাই বললেন, শ্রীদূর্গা মহাগৌরী পার্বতী। তিনি বলেন, তাঁর যে ভক্ত তাঁকে স্মরণ করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে, সে এই সংসারে জীবন সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। ধন-ধান্য এবং সমৃদ্ধির অভাব হবে না। এটি একটি গোপন পদ্ধতি । এই গোপনমন্ত্র পাঠ করলে মারণ, উচাটন , বশীকরণ উদ্দেশের সিদ্ধি হয়।এই মন্ত্রটি হল– ওং এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে। ওম গ্লৌং হুং ক্লীং জুং সঃ জ্বালয় জ্ব। বারবার সহস্রবার এই দুর্গা-মন্ত্র জপে দূর হবে সব বিপত্তি, বিপদ এবং অতিমারি। মুস্কিল হচ্ছে আমরা অবিশ্বাসী চঞ্চল চরিত্রের লোক। এসবের জন্য একাগ্রতা প্রয়োজন।
রতন বললো, কেউ যদি দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়, তার থেকে মুক্তির মন্ত্র আছে ?বা পারিবারিক কলহ রাতের ঘুম কেড়েছে তার মুক্তির উপায় কি?
পিসেমশাই বললেন তারও উপায় আছে। তান্ত্রিক আগমবাগীশের বই পড়লে সব জানতে পারবে। আভি কফি খাইয়ে দাও। আউর মাটন চাপ ভি লানা…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।