সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (অন্তিম পর্ব)

হারিয়ে যাওয়া একলব্য
একলব্যের শেষজীবন
শেষে নিষাদরাজ্যের রাজা হয়েছিলেন একলব্য।তাঁর রাজত্বকালে সত্য ও ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।কিন্তু মরণের আগে একলব্য আক্রমণ করলেন দ্বারকা। এদিকে দ্বারকারাজ তো স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। জগতের প্রতিপালক তিনি। বিধাতার যেন ইচ্ছে তাই,কৃষ্ণের হাতে একলব্যবধ । কর্ণ, একলব্যের মত ক্ষত্রিয় না হবার জন্য দ্রোণের কাছে অস্ত্র শিক্ষা পান নি। যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মামা কংসকে বধ করেন, তখন কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি চরমভাবে ক্রোধিত হন। মগধের এই সম্রাট কংস বধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সতের বার মথুরা আক্রমণ করেন এবং প্রত্যেক বারই গুরুতর ভাবে পরাজিত হন।
অপার পরাক্রমশালী কৃষ্ণ সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক।তিনি সব খবর রাখেন।একলব্য মনে করেন,যদি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হই, সে তো আমার পরম ভাগ্য।একলব্য জানতেন,যৌবনে মথুরায় প্রত্যাবর্তন করে কৃষ্ণ তার মামা কংসের অনুগামীদের দ্বারা সংঘটিত বহু হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে আত্মরক্ষা করে কংসকে বধ করেন। তিনি কংসের পিতা উগ্রসেনকে পুনরায় যাদবকুলের রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন এবং নিজে সেখানে অন্যতম যুবরাজ হিসেবে অবস্থান করেন।এই সময়ে তার সাথে অর্জুন সহ কুরু রাজ্যের অন্যান্য পাণ্ডব রাজপুত্রদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তিনি যাদবদের নিয়ে দ্বারকা নগরীতে চলে আসেন এবং সেখানেই তার রাজত্ব স্থাপন করেন।যখন যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তিনি সমস্ত মহান রাজাদের সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। যখন তিনি তাদের প্রত্যেককে একে একে সম্মান জ্ঞাপন করতে আরম্ভ করলেন তখন তিনি সর্বপ্রথম কৃষ্ণকে সম্মান জ্ঞাপন করলেন কারণ তিনি কৃষ্ণকেই সমস্ত রাজাদের মধ্যে মহান হিসেবে গণ্য করেছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল রাজারাই তাতে সম্মত হলেও কৃষ্ণের আত্মীয় শিশুপাল তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং কৃষ্ণের নিন্দা শুরু করেন। কৃষ্ণ শিশুপালের মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি শিশুপালের একশত অপরাধ ক্ষমা করবেন। তাই যখন শিশুপাল একশত অপরাধ অতিক্রম করলেন তখন তিনি তার বিরাট রূপ ধারণ করে সুদর্শন চক্রের দ্বারা শিশুপালকে বধ করলেন। সেইসময় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রও দিব্যদৃষ্টি লাভ করে কৃষ্ণের সেই রূপ দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুরাণ অনুসারে শিশুপাল এবং দন্তবক্র নামে অপর এক ব্যক্তি পূর্বজন্মে ছিলেন স্বর্গে দেবতা বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক জয় ও বিজয়। তারা অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং আবার বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের দ্বারাই স্বর্গে প্রত্যাগমন করেন।
মহাভারতের মহারণ কেবল কৃষ্ণাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, এমন মনে করা এক ধরনের সরলীকরণ। বরং বলা যেতে পারে, মহাভারত আসলে সেই ছাতা যেখানে স্বাধীন রাজ্যগুলো এসে জড়ো হচ্ছে একটি বৃহৎ শক্তির ছত্রছায়ায়। আপাতদৃষ্টিতে সেই বৃহৎ শক্তি পাণ্ডব ভ্রাতৃগণ, পারমার্থিক দৃষ্টিতে সেই মহান শক্তি বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ। তিনিই রাষ্ট্র, তিনিই মহাভারত। ভীষ্মপর্বে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, রাজাতেই মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ, তাই রাজা হলেন শ্রীভগবানের বিভূতিস্বরূপ। আবার তিনিই বলছেন, নরগণের মধ্যে আমিই নরাধিপ—নরাণাঞ্চ নরাধিপম্। নর বা মানুষ রাজা হলে তাঁর পূর্ণ বিকাশ ঘটে। সেই রাজাদের রাজা হলেন বাসুদেব। কী ভাবে?
মহাভারতের আদিপর্বের স্বয়ম্বর পর্বাধ্যায়ে প্রথম কৃষ্ণের দর্শন পাওয়া যায়। বারণাবতের জতুগৃহ থেকে পালিয়ে তপস্বীর বেশে কুন্তী-সহ পাণ্ডবরা পাঞ্চাল ও কীচক দেশের ভিতর দিয়ে একচক্রা পৌঁছে সেখানকার অধিপতি বক নামক রাক্ষসকে হত্যা করলেন। তার পর সোমাশ্রয়ণে গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করে পাণ্ডবরা গেলেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে। পাঞ্চালীকে জয় করে যখন কুম্ভকারের কর্মশালায় কুন্তীর কাছে নিয়ে এলেন, তখন কৃষ্ণ ও বলরাম দুই ভাই সেখানে পৌঁছলেন। তাঁরা পিসি কুন্তীকে প্রণাম করে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা আমাদের চিনলে কী প্রকারে? কৃষ্ণ হেসে জবাব দিলেন, স্বয়ম্বর সভায় দেখেই চিনেছি; অগ্নি গুপ্ত থাকলেও প্রকাশ পায়, পাণ্ডব ভিন্ন কার এত বিক্রম যে অত শক্তিশালী রাজাদের পরাজিত করে দ্রৌপদী নামক ধন আহরণ করে! পাণ্ডবরা অগ্নি, তাঁরা আপাতত গোপনে থাকুন, এতে সমৃদ্ধি হবে। এই কথা বলে কৃষ্ণ-বলরাম বিদায় নিলেন।
জরাসন্ধ জানতে পারেন যে, তার রাজ্যে একলব্যের মত একজন মহান ধনুর্ধর আছেন, তখন তিনি একলব্য কে তার সেনাপতি নিযুক্ত করেন। সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ায় পর একলব্য যুদ্ধক্ষেত্রে যাদব সেনাবাহিনীর একটি বড়ো অংশ ধ্বংস করে দেন। মাত্র চারটি আঙুলে অস্ত্রধরে তার এই বীরত্ব সকলকে মুগ্ধ করে দেয়।
তার এই ভীষণ পরাক্রম দেখে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে বীরগতি প্রদান করেন। এইভাবে আকাশবাণী সত্য হয় এবং একলব্যের জীবনের সমাপ্তি ঘটে।আরেক মত অনুযায়ী, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে রাজা জড়াসন্ধ খুন হন, যেখানে কৃষ্ণের হাত ছিল। এতে ক্রোধান্বিত একলব্য কৃষ্ণ আর দ্বারকার সব যাদবকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করেন। এই আক্রমণের সময়ই তিনি নিহত হন। আরেক মত অনুযায়ী, কুরুরাজ্যের রাজপুত্র দুর্যোধন একলব্যকে হস্তিনাপুরের সমস্ত বনের রাজা ঘোষণা করেন। পরে একসময় দুর্যোধনের কথায় কৃষ্ণের ছেলে শাম্বকে হত্যা করতে গেলে একলব্য কৃষ্ণ-যাদবের হাতে খুন হন। আর এভাবেই শেষ হয় মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক তীরন্দাজের জীবন ।
সমাপ্ত