হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল

কিশোরবেলার ‘স্মৃতি- আয়নার’ প্রতিবিম্ব

তারপর…
ষোলো
হরেনদাদু,হাটু মোড়ল,মন্মথদাদু,সেকেন্ড মাষ্টার, অম্বুজাক্ষবাবু ও আরও শ্রদ্ধেয় সকলে আমাদে ছোটবেলার দলটাকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁরা আমাদের সুশিক্ষিত করে তুলেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে।আমাদের দলের সকলে লেখাপড়ায় ভাল না হলেও মনের জগতে ছিল সুশিক্ষিত, সাহসি ও দয়ালু প্রকৃতির।এতকিছু ঘটনা সব এই গ্রামের আর আশেপাশের গ্রামের ঘটনা। হরেন ডাক্তার আমাদের পিছনে থাকতেন অভিভাবকের মত।একবার গ্রামে ভূতের উপদ্রব শুরু হল।আমি,বিশু,রমেন ও আরও সব বন্ধুরা হরেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম,আসলে ভূত বলে কি কিছু হয়? হরেনদাদু বললেন,শুনলাম সাতফুটের ভূত রাত বারোটার পর বেরোয়। যাকে সামনে পায় মেরে অজ্ঞান করে দেয়। আমাদের পরপর তিনরাত জেগে পাহারা দিতে হবে।বিশু বলল,নিশ্চয়,আমরা সকলে আপনার সঙ্গে আছি।হরেনবাবু বিশুকে রাতে ডেকে কাবারি আর বাঁশ দিয়ে সেট করে দিলেন ডিসপেনসারির কঙ্কালটা।বিশুর আর কঙ্কালের কোমরে, হাতে, পায়ে কাবারি বা বাঁশের টুকরো দিয়ে বেঁধে দিলেন হরেনবাবু। এবার বিশু যেভাবে নাচে কঙ্কালও সেই একইভাবে নাচে।বিশুকে কালো কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হল চোখ ও নাকের ফুটো বাদ দিয়ে।তারপর দুরাত পেরিয়ে গেল অপেক্ষায়। তিনরাতের রাতে সাতফুট ভূতের দেখা পেলাম আমরা লুকিয়ে। বিশু সাতফুটের ভূতের কাছে নাচতে নাচতে নাকিসুরে বলল,সঁকলকে ভয় দেঁখাস,এবার আমাকে দেখ।তারপর কঙ্কালের ভৌতিকনাচ দেখে সাতফুটের ভূত রণপা থেকে নেমে বলল,আমাকে ক্ষমা কর ভূতবাবা।আমি আর কোনদিন ভয় দেখাব না।
মন্মথদাদু বললেন,শিক্ষিত ছেলে হয়েও এইসব বেআইনি কাজ করো কেন? এবার থেকে খেটে খাবে, প্রতিজ্ঞা কর।
ছেলেটি বলল,আমি পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেলে খেটে খাবো।রণপার দল করে গান গেয়ে বেড়াব। তবু বেআইনি কাজ করব না কোনদিন।
হাটুমোড়ল বললেন,ধরা পরলে ওরকম সবাই বলে।দাও ব্যাটাকে আচ্ছা করে দু ঘা।
সেকেন্ড মাষ্টার বললেন,ছাড়া পেলে আমাদের এখানে একবার দেখা করো।কিছু একটা কাজের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে নিশ্চয়।
তারপর হরেনদাদু ও সকলের আদেশমত, আমরা সাতফুটের শিক্ষিত ভূতকে ধরে বেঁধে ফেললাম।হরেনবাবু বললেন কি উদ্দেশ্য তোদের বল? সাতফুটিয়া ছেলেটি বলল,এই রণপায়ে চেপে কালো কাপড় পরে আমি ভূত সাজি আমার সর্দারের হুকুমে।তারা গাঁজা,মদের কারবারি।যাতে মানুষ ভয়ে না বেরোয় সেজন্য আমি ভূতসেজে ভয় দেখাই।সেইসুযোগে ওরা মাদকদ্রব্য চালান করে পাড়ায় পাড়ায়।ওদের দল অনেক বড়।তবে সত্যি ভূত এই প্রথম দেখলাম।আর কোনোদিন আমরা এখানে উপদ্রব করব না
তারপর হরেনবাবু তার কথামত ছেলেটিকে মারধর না করে, থানার পুলিশ ডেকে লোকটাকে তাদের হাতে তুলে দিলেন।তারপর থেকে আমরা এই দাদুদের নিয়ে একটা ক্লাব আর লাইব্রেরি গঠন করি।এনাদের সঙ্গ আর ছাড়ি না।
সতের
স্যার বললেন তোর প্রিয় খেলা, সেটা হচ্ছে ক্রিকেট এবং এই ক্রিকেট খেলায় তুই যদি আমাদের স্কুলকে জেতাতে পারিস তাহলে তোকে একটা আমি পুরস্কার দেব।
পরের দিন, পুরো রেডি হয়ে লোকেশ মাঠে চলে গেল একঘন্টা আগে। মহাদেববাবু নিজে খেলার মাষ্টার। মাস্টারমশাই ভালো খেলেন এবং ভালো প্রশিক্ষক। লোকেশকে ওয়ার্ম আপ, করার জন্য বললেন।তিনি বললেন, খেলার আগে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। নানা রকম কসরত মহাদেববাবু দেখালেন স্কুলের টিমকে।
এবার খেলা শুরু হলে, দুই দলের ক্যাপ্টেন হাতে হাত মেলালো। লোকেশের টিম টসে হেরে গেল। কেতুগ্রামের স্কুল ব্যাটিং নেওয়া স্থির করল। প্রথম ওভারের খেলা শুরু হল। লোকেশের বন্ধু শ্যামল বল করছে। প্রথম বলে কোনরকমে ঠেকিয়ে দিল ব্যাটসম্যান। পরের বলে দুই রান নিল কেতুগ্রাম দলের স্কুলের ওপেনার।
খেলার মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে অসংখ্য দর্শক।। দর্শকরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠছে। খেলা খুব জমে গেল। কেতুগ্রাম স্কুল মোট 180 রান করে মাঠ ছাড়লো। কুড়ি ওভারের খেলা। এই কুড়ি ওভারের মধ্যে মহাদেববাবুর স্কুলের দলকে এই রানের বেশি করতে হবে,জিততে হলে।
লোকেশ বলল, স্যার আমরা সহজেই 180 রান তুলে নেব। তার থেকে বেশি তুলব। মহাদেববাবু বললেন, ওভার কনফিডেন্স খুব ভালো নয়। ওরাও ভালো খেলবে, ওদের বল ভাল হয়। তোদের জিততেই হবে। এই খেলাটায় তোর পরীক্ষা। এটা তুই যদি জিততে পারিস পরবর্তী খেলার জন্য আমি তোকে অনেক সাহায্য করবো। লোকেশের মন আনন্দে নেচে উঠলো।
এরপর টি-ব্রেক। মহাদেববাবু এই সুযোগে দলের সবাইকে বললেন, ঠিকমতো খেলতে হবে, পরপর আউট হয়ে গেল।লোকেশকে রীতিমতো সঙ্গ দিতে হবে।তাহলেই হবে।লোকেশের মনে স্যারের কথাগুলো গভীর দাগ কেটে দিলো। বজরংবলী কে স্মরণ করে লোকেশ হাত খুলে পেটাতে শুরু করল।
পরপর বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি মেরে লোকেশ নিজের দলের রান হুহু করে বাড়িয়ে দিল। মহাদেববাবু খুব খুশি হলেন। সকলে হাততালি দিতে লাগল। শেষে বিজয়ী দল হিসাবে লোকেশের দল পুরস্কার লাভ করল।
মহাদেববাবু লোকেশ কে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই প্রত্যেকদিন আমার কাছে চলে আসবি। আমাদের বাড়ির সামনে মাঠে গিয়ে তুই শুধু ক্রিকেট খেলা অভ্যাস করবি। তার সাথে শরীরচর্চার জন্য সাঁতার আর ব্যায়াম করবি। অন্য খেলা করবি না শুধু ক্রিকেট। ক্রিকেট তোর ধ্যান, জ্ঞান হবে। তোকে বড় হতেই হবে।
বাড়ি যাওয়ার পথে মাস্টারমশাই লোকেশ কে একটা বড় হাঁড়িতে রসগোল্লা কিনে দিয়েছিলেন উপহারস্বরূপ। লোকেশের বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। বস্তি পাড়ায় পুকুরটা জলের উৎস। এরা পুকুরের জলে সকলে কাপড় কাচা, বাসন মাজার কাজ করে। আর কলের জল পানীয় জল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
লোকেশ পুকুরে সাঁতার কাটে। তারপর জিম করতে যায় বিকেলে।তার প্রচুর খিদে পায় কিন্তু সে খেতে পায় না। কারণ সে গরীব ঘরের লোক। লোকেশের ঘরে খাবার যা থাকে তা যথেষ্ট নয়, এ কথা কাউকে বলতে পারে না। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে পান্তাভাত আর মুসুরির ডাল খেতে খেতে মাস্টারমশায় কথা ভাবে। স্যার বলেন, ভালো খেলোয়াড় হতে গেলে ভালো খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজন আছে।
বিকেলে খেলতে গিয়ে আজ লোকেশ ক্যাচ মিস করলো। মাস্টারমশাই বললেন তুই এই খেলাটা কে একদম মাটি করে দিলি। একটা ক্যাচ মিস করা মানে দলকে হারতে। সাহায্য করা ব্যাট করতে গিয়েও 10 রানে আউট হলো। স্যার বললেন, কি ব্যাপার বলতো তোরা।এতো গাছাড়া ভাব কেন তোর? আজ তোর বাড়ীতে বাবা মার সঙ্গে দেখা করে আসব।
লোকেশ মাষ্টারমশাইকে আজ বাড়িতে নিয়ে এসেছে। মাষ্টারমশাই অবাক হয়ে বললেন,তুই এই বস্তি পাড়ায় থাকিস? তোর ঘরের এই অবস্থা ঘরের চাল ফুটো। লোকেশ কে বকাঝকা করার জন্য মাস্টারমশাই খুব আফসোস হলো। তিনি মনে মনে লোকেশের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করলেন।তিনি ভাবলেন এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাকে নিতে হবে, তাছাড়া সে বড় হতে পারবে না ।
মাস্টারমশাই লোকেশের বাবা মায়ের পারমিশন নিয়ে লোকেশ কে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন এবং নিজের বাড়িতে একটা ঘর তার জন্য বরাদ্দ করলেন। তার জামা প্যান্ট প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র কিনে দিলেন। আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করলেন।
লোকেশের মা আর তার বোন আজ তিন দিন হল মামার বাড়ি গেছে। অনুপমা আর অসীমা বেড়াতে খুব ভালোবাসে। তারা স্কুলে ছুটি পরলে এদিক-ওদিক বেড়াতে যায়। কিন্তু স্যার লোকেশ কে যেতে দেন না। খেলার মধ্যে ব্যস্ত রাখেন।
লোকেশন মা বলেন আমরা তো আমাদের ছেলেকে ভালোমতো খেতে দিতে পারিনা তবু তো মাস্টার মশাই মাস্টার মশাই কাছে গেলে ভালো খেতে পাবে পড়তে পাবে শুতে পাবে আর আমাদের এখানে চাল ফুটো চাল আনতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই অভাবে বাজারেও খেলোয়ার হতে পারবে না বাবা।
লোক এসে বাবা মা মাষ্টারমশাইকে অনুরোধ করলেন আমাদের ছেলেটাকে আপনি লিখিয়ে পরিয়ে যেমন করে হোক মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলুন মাস্টারমশাই ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন।
প্রত্যেক দিনের মতো আজ রবিবার বিকাল বেলা মাস্টারমশায় ওয়াড়লক এসো আরো পাঁচজন ছেলে মাঠে নেট প্র্যাকটিস করছে লোকের ধরেছে আরতন বাল করছে রতন এই এলাকার ভাল পিস বলার তাই তাকে মাস্টারমশাই আসতে বলেন প্র্যাকটিসের সময় লোকের খেলছে ভালো তবে ক্রিকেটের একটা গ্রাম আছে সেই গ্রামের ক্রিকেট খেলা যায় না কখনো এক পা এগিয়ে কখনো দুই পা পিছিয়ে খেলতে হয় বলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হয় মাস্টারমশাই বলেন যখন তোর আই সেট হয়ে যাবে তখন ঐ ছোট বলগুলো একটা ফুটবলের মতো মনে হবে কোনমতেই তোকে কেউ আউট করতে পারবে না।।
মাষ্টারমশাই আরও বলেন,ক্রিকেটের অদ্ভুত নিয়মগুলির মধ্যে আরেকটি হল ফিল্ডিং টিম যদি ব্যাটসম্যানের আউটের জন্য আবেদন না করেন, তবে ব্যাটসম্যান আউট হলেও তাঁকে আউট দিতে পারেন না আম্পায়ার। এর মানে ব্যাটসম্যান লেগ বিফোর উইকেট অথবা রান আউট হলে আম্পায়ার তাঁকে ততক্ষণ আউট ঘোষণা করতে পারবেন না যতক্ষন না ফিল্ডিং টিমের কেউ ওই ব্যাটসম্যানের আউটের জন্য আবেদন করছেন। আধুনিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা খুব কমই দেখা যায় যেখানে কোনও ফিল্ডিং টিমের আবেদন না করার কারণে কোনও ব্যাটসম্যান আউটের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। যদিও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে ফিল্ডিং টিম আবেদন না করায় ব্যাটসম্যান আউট হয়নি।তাহলে আউটের আবেদন যেন জোরালো হয়,মনে রাখবে সবাই।
লোকেশের টিম জেলাস্তরে জিতে রাজ্যস্তরে চান্স পেল।তারপর ইন্ডিয়া টিম থেকে তার ডাক এল।গল্পের মত জীবন।আজ লোকেশ খুব খুশি।মাষ্টারমশাইকে প্রণাম করে লোকেশ বলে,আপনাদের মত ডুবুরিরা সংসার সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণিমাণিক্য খু্ঁজে বের করেন। আসল দেশের সম্পদ তো আপনারাই।
মাষ্টারমশাই বলেন,তোমার আরও অনেক পথ বাকি। সফল হওয়া সহজ কিন্তু সাফল্য ধরে রাখা ভীষণ কঠিন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *