T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যা সৌম্য ঘোষ

অনন্য শঙ্খ-ধ্বনি
” আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা
লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে—
গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে শরীরে, তার
সবটুকুতেই শস্য যেন ফলে।”
( ‘কবর’/ “দিনগুলি রাতগুলি”)
আমাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের জীবনানন্দ, মাঝখানে যেখানে আমরা দাঁড়াই — সেখানেই অপেক্ষা করেন শঙ্খ ঘোষ!
ক্ষতবিক্ষত এই সময়ের সাক্ষী থাকা মানে নিজেকে সমানভাবে ক্ষতবিক্ষত করে তোলা। চারপাশ জুড়ে দুর্বিষহ সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। বাস্তবতার নাগপাশে পরাজয় স্বীকার করতে করতে মানুষ যেন পুনরায় পরাধীনতায় বন্দী হয়ে যায়। এই মুহূর্তে। অস্থির এই মুহূর্ত যেন প্রতিটি যাপনকে যন্ত্রণাদগ্ধ করে।
শঙ্খ ঘোষের কবিতায় একদিকে যেমন পাওয়া যায়, সমাজ বৈষম্যের দুঃখ ও যন্ত্রণার প্রতিলিপি। অন্যদিকে মানুষের লড়াইয়ের তীব্র আত্মশক্তি। শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবিদের প্রতিনিধি, যাদের কাব্য-অভিপ্রায় এবং কাব্য-অভিমুখ এক। কাব্যব্যক্তিত্ব এবং কাব্যবীক্ষা এক।
বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা, দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু সমস্যা আর তারই মধ্যে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। এই স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন স্বপ্ন নির্মাণ যন্ত্রণার মধ্যেই আবির্ভাব শঙ্খ ঘোষের ( ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২)। পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার নতুন পথ চলা শুরু হয়। শুরু হয় আত্মনির্ভর আধুনিকতার। নিজস্ব পথ নির্মাণ করে শঙ্খ ঘোষ বাংলা কবিতায় অর্জন করেন একটি স্বতন্ত্র স্থান। আত্মস্থ করেছেন বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে। ‘ঐতিহ্য’ কেবল অতীত নিয়ে গড়ে ওঠে না, ঐতিহ্য সাম্প্রতিক কালখন্ডের সঙ্গেও যুক্ত। এও এক ঐতিহাসিকবোধ। যে বোধ শুধু অতীতের অতীতত্ব অনুভূত নয়, তার উপস্থিতির অনুভব। এই বোধ সঞ্চারিত হলেই একজন কবি বা লেখকের তাঁর সমসময়ের চেতনা নিয়েই শুধু লেখেন তাই নয়; তিনি লেখেন তাঁর ভাষা-সাহিত্যের অস্তিত্বের অনুভব দিয়ে ‘মানব সময়ের’ বোধ। আর এখান থেকেই কবির অন্তঃস্থ আত্ম-পরিচয়ের পূর্ণতা পাওয়া যায়। তিনি ঐতিহ্যকে তাঁর সৃজনশীলতায় অঙ্গীভূত করে নেন।
প্রতিক্রিয়া এবং কবিতার মধ্যে যে পার্থক্য, তা কবিতার ভিতরে মানুষ ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারেন না।
অথচ এখানেই কাজ করে একজন কবির মহত্ব ও অন্যজনের অ-কবিত্ব।
সমসময় এবং পারিপার্শ্বিকতার আর্থ সামাজিক বাস্তব পরিস্থিতি থেকে কখনোই মুখ ফিরিয়ে থাকেননি কবি শঙ্খ ঘোষ। তিনি নিজে যেমন গর্জে উঠেছেন, তেমন তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে এক একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। সেইসব কবিতায় আগুন আছে, চিৎকার নেই।
#
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার শুরু হয়েছিল ত্রিশের দশকে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণুদে, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন প্রমুখের কাব্য প্রয়াসে। শেষ জীবনের সৃষ্টিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আলোড়িত হয়েছিলেন প্রবল আত্মবিরোধে। এই আত্মবিরোধ ছিল তাঁর কবি জীবনের সূচনা থেকে লালন করে আসা আস্তিক্যবোধ, রোমান্টিকতার সঙ্গে বোদলেয়ার, এলিয়ট, পাউন্ডদের আধুনিক জগতের। তাই দেখি, শঙ্খ ঘোষের কবিতায় একদিকে যেমন পাওয়া যায় চেতনার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে, আবার পাশাপাশি পাওয়া যায় ত্রিশের দশকের কবিদের। চল্লিশের দশকের রাজনীতি সচেতন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা তাঁর কবিতা ভাবনা এবং মননবিকাশকে প্রভাবিত করেছিল। শঙ্খ ঘোষ গদ্যেও অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কাব্যভাবনা, শব্দভাবনা, ছন্দচেতনা নিয়ে লেখা গদ্য গ্রন্থগুলি অনন্য বিশিষ্টতা দিয়েছে। একদিকে শব্দকে অতিক্রম করে শব্দাতীত তাৎপর্যে পৌঁছানো; অন্যদিকে বিশ্বের পটে খোঁজা।
শঙ্খ ঘোষ মূলতঃ কবি হলেও গদ্য লেখায়
“কবিতার সৃজনশীলতা” এবং তীক্ষ্ম মননশীল যুক্তির ধারালো ঔজ্জ্বল্যে একজন সাহিত্যিক ও সমালোচক। তাঁর “ছন্দের বারান্দা”(১৯৭১), “জার্নাল” (১৯৮৫), “এ আমির আবরণ”(১৯৮০),
“ঐতিহ্যের বিস্তার (১৯৮৯) —- প্রত্যেকটি গ্রন্থই ব্যতিক্রমী এবং কবি পরিচয়ে সমৃদ্ধ। যাতে সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে আছে মেধা-দেশ-কাল-সময়- সংকট এবং আত্মপ্রশ্ন-সমালোচনা-জাগরণ।
তিনি তাঁর প্রবন্ধসমূহকে “স্মৃতিলেখা”, “লেখা জীবন”, “কবিতা কথা”, “শিল্প-সাহিত্য”, “রবীন্দ্রনাথ” এবং “অন্যান্য” —– এই ভাবে বিন্যস্ত করেছেন।
তাঁর প্রত্যেকটি গদ্যগ্রন্থ যেমন ভাবনার মূল শিকড় ধরে টান দেয়, তেমনি তাঁর কবিতা গ্রন্থগুলি আমাদের চিন্তা করতে শেখায়। এই যে চিন্তা করতে শেখা। চিন্তা করতে না পারলে কবিতা লিখেই বা লাভ কি? আর কবিতা নিয়ে চর্চা করেই বা লাভ কি? কবিতা প্রতিনিয়ত আমাদের নিজেদেরই মুখোমুখি দাঁড় করায়। যা শঙ্খ ঘোষের কবিতার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি যেমন নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে সংলাপে রত হন, তেমন বাইরের জগতের মানুষের দুঃখের দোসর হয়েও ওঠেন। তাঁর কবিতায় থাকে না অযথা জ্ঞান-প্রদানের চেষ্টা বা বিশেষ কোনো মতাদর্শকে বিজ্ঞাপিত করা।
বলা যেতে পারে তিনি সমসময়ের ‘বিবেক’ হয়ে ওঠেন। লিখে রেখে যান এক অন্য ইতিহাস।
অনুবাদক শঙ্খ ঘোষ দেশ, সমাজ, রাজনীতি, মানুষ, মানবতা, ভালোবাসা সচেতন।
তাঁর সকল অনুবাদকর্মে জীবন ও ঐতিহ্যের সামগ্রিক বোধে সুস্পষ্ট ধরা পড়ে কবি-মানসের মিল।
তাঁর কাছে নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, বরং শব্দের নতুন সৃষ্টিই অভিপ্রায় —— কবি ভালোবাসার কাছে পৌঁছান, সৃষ্টি করেন দেশকালের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে নতুন প্রেম-কবিতা। প্রবল অস্ত্যর্থকতার জন্য তাঁর সমস্ত কবিতা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে প্রেমের কবিতা —- ভালোবাসার কবিতা। শঙ্খ ঘোষের কবিতা সমাজ দেশকাল সংশ্লিষ্ট। সময়ের অস্থিরতার ক্ষোভ, ক্রোধ অভিমান, আত্মসংকট, বেদনার প্রগাঢ় যন্ত্রণাবোধ। আর এই কারনেই
কবি শঙ্খ ঘোষ বেঁচে থাকার এবং অন্যকে বাঁচতে শেখানোর কবি। আধুনিক, উত্তরাধুনিক পাঠ নিয়েই কবি শঙ্খ ঘোষ সামগ্রিক অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশ্ব জগতের সঙ্গে সরাসরি আনুভূমিক, সচেতন, ইতিবাচক সংযোগ স্থাপন করেছেন।
আধুনিকতার অনেকান্তিক শর্তে-ধর্মে তাঁর কবিতায় ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং সামাজিক উপলব্ধির সঙ্গে মিশে গেছে —- এক নিজস্ব অনন্য শঙ্খ-ধ্বনি।।