গল্প গাথায় সায়ন্তনী দাস সান্যাল

সেই তো আবার কাছে এলে

– তাহলে আমরা বন্ধু হতে পারি?
হাতটা বাড়িয়ে দিলো মৈনাক, অপর পক্ষও এ প্রস্তাবে সলজ্জ হেসে হাত এগিয়ে দিলো।
***
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রত্যেক সন্ধেয় ঝড়টা হয়েই চলেছে। মেঘ করে আসবে,তারপর ঝোড়ো হাওয়া, টিপটিপ বৃষ্টি,তারপর হাওয়ার চোটে মেঘ উধাও। মৈনাকও গুটিগুটি বাড়ি ফেরে অফিস থেকে।কিন্ত আজ ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেলো। প্রচন্ড ঝড়ের সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তায় গাছের ডাল পড়ে থাকায় অটো টা এ গলি ও গুলি ঘুরে মৈনাক কে যে জায়গায় নামালো সেখান থেকে ওর বাড়ি হেঁটে দশ মিনিট। কোনো ব্যাপারই না ভেবে হালকা ধরে যাওয়া বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে যেতেনা
যেতেই আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। দৌড়ে গিয়ে সামনের অর্ধেক হয়ে থাকা ফ্লাটের কার্নিশের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো।
নাকে হঠাৎ করে ল্যাভেন্ডারের মিষ্টিগন্ধ ভেসে আসতেই পাশে তাকিয়ে দেখে ওরই মতো আরেকজন কার্নিশের নিচে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তবে সে পুং নয়, স্ত্রী। কার স্ত্রী না জানলেও মৈনাক আস্বস্ত হলো এই ভেবে যে ,ও একা নয় এই মুহূর্তে।
চিরকালের উচ্ছল ছেলে মৈনাক নিজের মনেই বলে ওঠে, কি বৃষ্টি, কখন যে থামবে…
পাশ থেকে ভেসে আসে, বৃষ্টি থামার অপেক্ষাটা কিসের জন্য? নিশ্চই কেকেআর এর ম্যাচ পন্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়? মুখ ফিরিয়ে হেসে ওঠে মৈনাক, না না,তারচেয়েও বাড়ি ফেরার তাড়ার জন্য।
-কেউ অপেক্ষা করছে বুঝি?
– এখনো অপেক্ষার কেউ আসেনি জীবনে। আড়চোখে পাশের জনের দিকে তাকায় মৈনাক, স্ট্রিট আলোয় মায়াময় মুখচ্ছবি, চঞ্চল কৌতুকে ভরা চোখ, আদুরে চিবুক,হাতের ব্যাগ টা সামনে ধরে রাখা পেলব হাতদুটো দিয়ে। লং কুর্তার নিচের অংশটা ভিজে গিয়েছে বৃষ্টিতে।
– আপনি বুঝি খুব ক্রিকেট ভালোবাসেন?
– বাসতাম, এখন আর খুব একটা দেখা হয়না , এত কাজের চাপ, তবে রাসেলের খেলাটা প্রথম থেকেই বেশ লাগছে। মিশুক সঙ্গিনীর মধ্যে যে একটা সহজিয়া স্রোত রয়েছে, বুঝতে পারে মৈনাক।
– সেই …ঠিক বলেছেন, কাজের চাপে আমরা কত কিছু যে আজ স্যাক্রিফাইস করছি।
– যেমন বলুন, আগে চারপাশের মানুষের কত খোঁজ খবর রাখতাম আমরা আর এখন …।
– জানেন এই যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এখানে আমি ফিজিক্স পড়তে আসতাম ইলেভেন টুয়েলভ এ, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেয়ে বাইরে চলে গেলাম,দশ বছর হয়ে গেল, স্যারের খোঁজও নেওয়া হয়নি আর, ওনার বাড়িটা যে প্রমোটিং এ চলেগেছে জানতামই না। কত্ত বড় বাগান ছিল স্যারের বাড়ির সাথে।
মৈনাকের গলায় বিষাদের সুর শুনেই বোধহয় মেয়েটি বলে উঠলো, আজ এখন কোন গানটা মনে পড়ছে বলুন তো? বলেই নিজে গুনগুন করে উঠলো, ইয়ে রাত ভিগিভিগি, ইয়ে মস্ত ফিজায়ে,উঠা ধীরে ধীরে ও চান্দ প্যায়ারা প্যায়ারা।
মৈনাক হঠাৎ বুঝতে পারলো, ওর মনের ভিতর টাও কেমন ভিগিভিগি হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে আরো কিছুক্ষন চলুক বৃষ্টি, তার বাড়ি ফেরার তাড়া নেই আর।
-মান্না দে কিন্তু আমারও খুব প্রিয় গায়ক।
– তাই ? আমার ভীষণ ভালো লাগে… লাগা চুনরি মে দাগ ছুপাউ ক্যায়সে..ক্যায়সে বাবুলকে ঘর যায়ু ক্যায়সে…
গানের মাঝপথে থামিয়ে দিলো মৈনাক,
– আমাদের ইমোশনগুলো একই রকম, আমরা কি বন্ধু হতে পারি? হাতটা বাড়িয়ে দিলো মৈনাক, সলজ্জে হাত এগিয়ে দিলো সেও, হাতের পাতার ঠিক উপরেই অদ্ভুত একটা জরুল, খানিকটা ফুলের পাঁপড়ির মতন, স্ট্রিট আলোতেও খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, মৈনাকের চোখটা বিস্ফারিত হয়েগেলো, ততক্ষণে দুটো হাতের আঙুল ছুঁয়েছে পরস্পর কে………………
********
পরের দিন খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় স্থান পেল একটা খবর, বরানগরে নির্মীয়মান একটি বহুতলে ঝড়ের সময় কার্নিশ ভেঙে এক তথ্য প্রযুক্তি কর্মী র মৃত্যু, সম্ভবতঃ তিনি বৃষ্টির সময় ওখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যদিও ওই বহুতলটি নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থপতির বক্তব্য, তাঁদের প্রজেক্টটি এত ঠুনকো নয় যে ঝড়ে কার্নিশ ভেঙে পড়বে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা যায় ,প্রায় দশ বছর আগে ওই জায়গায় অবস্থিত বাড়িটিতে একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে। বাড়ির মালিক টিউশনি পড়াতেন, তাঁর ই একছাত্রীকে এরকম এপ্রিল মাসের ঝড় বৃষ্টির রাত্রে ধর্ষণ করে ফেলে রাখা হয় বাড়ি সংলগ্ন বাগানে। সন্দেহ করা হয়েছিল মেয়েটির সহপাঠীদের মধ্যেই কেউ এই নৃশংস অপরাধ করেছিল।কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়নি। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটি সন্ধে থেকে নিখোঁজ থাকার পর যখন বাগানে মৃতদেহটি পাওয়া যায় তখন তার অর্ধনগ্ন ক্ষতবিক্ষত দেহ ও ইঁট দিয়ে থেঁতলানো মুখ দেখে তাকে সনাক্ত করা যায়নি, কিন্তু পরে তার আত্মীয়রা তাকে চিনতে পারে তার হাতের পাতা দেখে, যার উপরে ছিল প্রকটিত ফুলের পাঁপড়ির মতো একটি জরুল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।