• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে সুবল দত্ত

মমতা

আবার নতুন করে বিকৃতের রোগ।হ্যানসান।মানবিক সামাজিক চেতনার অবক্ষয়। যেন কতযুগ কেটে গেছে ঘৃণার। কয়েক দশক আগে অভিশপ্ত ছায়া মাড়ানোর ভয়ে সমাজ কোনো পরিত্যক্ত অন্ধ কোণায় ফেলে রেখে দিতো, অবাধে বাড়তে দিতো শয়তানী রোগ। ঘৃণার কতো যে রকমফের ছিল।এখন আর সেই ঘৃণা আগেরমতো নেই। এখন ওরা সুস্থ মানুষের মমত্ব কাড়ে। ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের মাথার ভিতরে ঢুকে বংশ বিস্তারের জন্য আপ্রাণ চিত্কার।এ বাবু এ বাবু এ বাবু এ বাবু এ বাবু এ বাবু এ বাবু দে বাবু দে বাবু দে বাবু দে বাবু দে বাবু দে বাবু। সেন্টিমেন্টাল এক্সপ্লয়টেশন। মনোহরা দোতলার এক চিলতে ব্যালকনিতে চা খেতে খেতে এইসবকথা ভাবছিল। আবার এদের দেখে আমাদের মতন নিম্ন মধ্যবিত্তদের মমতা চাগিয়ে ওঠে। মনোহরা ভাবে,নারীত্ব ও স্নেহের মত এক প্রাচীন বিবশতা মমত্ব।ঠিক ওই কুষ্ঠ রোগ বীজানুর মত।যে মানুষে এই মমত্ববোধ জাঁকিয়ে ভর করে তার চরিত্র আর বশে থাকে না। তাকে রোগে ধরে। অফিস পলিটিক্স ছিঁড়ে খায়। সর্বত্র শোষিত হয়। তাকে কে কি না করে। পোকামাকড় পাখপাখালি অনু থেকে বৃহত্‍ সবাই মানসিক ভাবে খাবলে খেতে চায়।
শনিবারের সকাল।সেকেন্ড স্যাটারডের ছুটির আমেজের কাবাবে হাড্ডি। সরকারি কোয়ার্টারগুলোর নিচে ময়দান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা বিশেক লেপার। শনিবারে ওদের ভিক্ষের পারমিশন।ওদের কি ঠান্ডা ফাণ্ডা লাগেনা? এই হাড় হিম করা শীতের সকালে ওদের বাতাস চেরা কাতর ভিক্ষে চাওয়া। মনোহরার সারা গা আনচান করে। সারা শরীরজুড়ে দয়াভাব জাঁকিয়ে বসছে। এই এক রোগ। বহুবার আগ বাড়িয়ে দয়া দেখাতে গিয়ে ভয়ানক ঠকেছে আর ঠকছে। তবু। সপ্তাহ জুড়ে অনেকগুলো কয়েন আর কিছু টাকা জমা হয়েছে। সির্ফ আজের জন্য। বউ ভোর থেকে এক কড়াই ভর্তি সুজির হালুয়া করে রেখেছে, নিচে গিয়ে ওদের বিতরণ করবে বলে। মনোহরাও ভাবে,আহা বাচ্চা ফাচ্চা নেই কী এমন খরচ? তার চেয়ে এই সেবাই ভালো।নিচে বাচ্চা কোলে ক্ষয়ে যাওয়া রক্তমুখী হাতে বাটি উঁচু করে সমানে চিত্কার করে যাচ্ছে লেপার বউটা। চা এখনো হাফ কাপ বাকি।শরীর মন প্রবল উঠি উঠি করছে। মনোহরা উঠতেই যাবে, বাধা দিল বউ।‘বোসো আমি নিয়ে এসেছি’।মনোহরা দেখলো ওর হাতে খুচরো পয়সার পোঁটলা। অন্যহাতে একটা লাল সোয়েটার। মনোহরা বিরক্ত হয়। আমি যদি ঊনিশ তো এ আবার বিশ।দয়ার দুটো কলসী।বউ ব্যালকনির বারান্দায় ঝুঁকে বলতে লাগলো,-দ্যাখো দ্যাখো ওই ভিখিরি বৌটার কোলের বাচ্চাটাকে? ওমা কি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা। অই অইগো,দাঁড়াও যেওনা। তোমার জন্যে পয়সা নিয়ে আসছি। আর এইটে। তোমার বাচ্চাটার জন্যে বুনলাম। পরিয়ে দেব।হাঁ হাঁ করতে করতেও বউ তক্ষুনি নিচে। বাঁজা বউ। বাচ্চা দেখলেই লাফায়।যে চায় তাকে কেন দেয় না ভগবান? ওদের পথে ঘাটে ঝোপড়ি ঘুপসি বনে বাদাড়ে পিলপিল করে বাচ্চা বিয়ানো। অথচ আজ অব্দি বাচ্চা কনসিভ করাতে যত খরচ হয়েছে তাতে টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট হয়ে যেত। কোথাও কোনো দোষ নেই অথচ ডাক্তার, যে বিজ্ঞানের ধামাধরা, সে অব্দি বলে দিল এ ভগবানের মার।কিন্তু ও নিচে গেল তো গেলই এখনো আসছে না কেন?মনোহর উদ্বিগ্ন হয়ে দেখে বউ লেপারেরবাচ্চাটা কোলে তুলে হামি খাচ্ছে। শরীরে সংক্রামক ব্যাধি না নিয়ে এলে হয়। মনোহরার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। চাটা আর খেতে ইচ্ছে হলো না।এতোটা ভালো নয়। আরে! হাইজিন বলে একটা বস্তু আছে না কি? তারপর একটা বিচ্ছিরি সংক্রামক রোগগ্রস্ত। বাচ্চাটার মুখের লালা…দুর্গন্ধ…মা টার হাতে রক্ত পূঁজ ছি ছি। ও আসুক। বাথরুমে সোজা ঢুকিয়ে দরজা লক করে দেব। আজ সারাদিন ওকে আমি ছুঁচ্ছিনা।সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে উদ্বিগ্ন মনোহরা দেখল লাল সোয়েটার পরা বাচ্চাটাকে কোলে করে বউ উপরে চলে এসেছে। ব্যালকনি থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো ওই লেপার বউটা ক্ষয়ে যাওয়া বিকলাঙ্গ হাত ওপরে তুলে টা টা করছে। দাঁত বার করে হাসছে কিন্তু চোখে জল।
-আচ্ছা,রাখলুম গো। পরে একসময় এসে দেখে যেও।
মনোহরার ভিরমি খাবার জোগাড়। ওই বাচ্চাটাকে রাখবে মানে? এতোই সহজ? মনোহরা চিত্কার করে উঠলো,
-ওটাকে রাখবে মানে? তামাশা নাকি? পাগল হয়েছ?তোমার ঘেন্না পিত্তি নেই?নোংরা রক্ত পুজ লেগে আছে ছোয়াচে রুগীর বাচ্চার কি রোগ হয়না নাকি?যাও এক্ষুনি ওকে দিয়ে এসো। যাও বলছি।
বউ দুপা পিছিয়ে গেল। আরো ভালো করে জড়িয়ে ধরল বাচ্চাটাকে।–‘নাঃ। আমি একে আমার কাছে রাখবো। ওই মেয়েটার সাথে কথা হয়ে গেছে। দেখছো না? আমার কোলে এসে কেমন হাসছে? কি সুন্দর বাচ্চা। আমার কোল জুড়ে আলো করে এসেছে’।মনোহরা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এসেও পিছিয়ে গেল দু পা।
-হে ভগবান! এখন আমি কি করি? আচ্ছা বিপদে পড়লাম দেখছি। দেখ ! মন দিয়ে কথাটা শোনো। এখন দৌড়ে নিচে যাও। ওরা এখনো ক্যাম্পাসেই আছে। দিয়ে এসো। ঝামেলা বাড়িও না। বেশি দেরি করলে কি জানি হয়তো দলবল নিয়ে চলে আসবে। শেষে বাচ্চা কেড়ে নেওয়ার কেসে না ফাঁসায়।
বৌ কোনো কথা না বলে সিধা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মনোহরার রাগে গা গরম হবে কী? সারা গা ঘামে ভিজে সপসপ। এর পরের জীবনযাত্রা কেমনধারা হবে সেটা ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কতজনকে জবাবদিহি করবে সে? লেপার কলোনির লোকগুলো ছেড়ে দেবে কি? সরকারী অনুদান,মাঝে মাঝেই এন জি ওদের নানা প্রকল্প নানা বিতরণ। তারওপর কালো টাকা সাদা করতে অনেক দুনম্বরী ব্যবসায়ীর ঢালাও খাবার বিতরণ। এই দেদার লোভে রুগী বাড়ছে, রোগ কমার বালাই নেই। এইসময় কি মতলবে লেপার বউটা ওই দুধের শিশুটাকে দিয়ে দিলো?ওটা কোনো সামগ্রী নাকি?আচ্ছা ধরাযাক ও অনেকগুলো বাচ্চা সামলাতে পারছিল না। আপদ বিদেয় করেছে। কিন্তু আমাদেরকেই এই বাঁশটা দিতে হয়? সে তরফ থেকে কিছু হোক বা না হোক,কোয়ার্টার থেকে আগে বেরিয়ে যাবার হিসাব কিতাব হয়ে গেলো। সরকারী অফিস বলে কথা। শো কজ নোটিশ ধরাবেই। তারপর বাচ্চা সামলাও। সেটা না হয় পরের ব্যাপার এখন? এখন কি করব?মনোহরার এবারে রাগ ধাঁই করে চেপে গেল। জোরে বাথরুমের দরজা ঠেলতেই ধড়াস করে খুলে গেল। বউ কোনো ভ্রূক্ষেপই করলনা। গুনগুন করে গান ভাঁজতে ভাঁজতে বাচ্চাটাকে তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল।মনোহরা হাঁ। বেডরুমে ঢুকতে গিয়ে পিছন ফিরে মনোহরার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি নিয়ে বলল,
-দেখো দেখো? বাচ্চাটাকে চান করিয়ে দিতে কতো ফর্সা হয়ে গেছে? একেবারে সাহেবের বাচ্চা। এমন শিশু কি ওদের কোলে মানায়?
-সাহেবের বাচ্চা? তাহলেই হয়েছে।কার না কার বাচ্চা কোথ্থেকে উঠিয়ে এনে নিশ্চয়ই সামলাতে না পেরে আমাদের দিকে বাঁশটা ঠেলে দিয়েছে। বিষয়টা থিতোলে টাকা চাইবে এসে। এবার সামলাও।
-সে তুমি যাই বকো আমি কিন্তু আর কোল ছাড়া করছি না। বলে দিলুম।
-কোল ছাড়া করব না।হুঁহ। তবেই হয়েছে আর কি। খেলনা পুতুল। ওও তোমাকে দিলো তুমি নিয়ে নিলে।জিজ্ঞেস অব্দি করলে না,মা বাপের ঠিক ঠিকানা কি।
-হ্যাঁ তো। ও তো বলেইছে।ওর এণ্ডি গেন্ডি চার চারটে সঙ্গে হাঁটছে আর এটা কোলে। ওর বর অসুস্থ। অসুখে ওর পা দুটো অসাড়। চলাফেরা করতে পারে না। ও বলছিল সামলাতে পারছিনা দিদি। এই পোড়া বুকে এক ফোঁটা দুধ নেই।একটু দুধ কেনারও পয়সা হচ্ছে না।ভোকে মরে যাবে দিদি তুমি একে না রাখলে এখানেই ফেলে যাব।
শালা,দু পা অসাড় তো লোকটার তৃতীয়টা বেশ সতেজ দেখছি। এরাও পারে। আমাদের অভাগা মধ্যবিত্তের কপালেই যত ভোগান্তি মাথায় নিয়ে রাতে পাশ ফিরে শোওয়া। মনোহরা এইসব কথা মনে ভাবতে ভাবতে নিচে নামতে লাগলো। বউ বাচ্চা কোলে প্রায় ছুটে তার কাছে এসে জামাটা মুঠো করে ধরে টানলো।
-চললে কোথায়?
-যাই, একবার থানাতে এফ আই আর করে আসি। বাচ্চাটা অন্যকারোর হলে আবার আমি ফেঁসে না যাই।
-আমার কথার তো কোনো দামই নেই। বউএর কাঁদো কাঁদো গলা।
-বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা না। সত্যিই যদি লেপার বৌটার বাচ্চা হয়,তবু তো লিখাপড়ি এগ্রিমেন্ট চাই তো? তাই আগেভাগে পুলিশকে জানিয়ে রাখা আর কি। ঝামেলা পাকিয়েছো,সামলাতে তো আমাকেই হবে।
-সব দোষ তো আমার। বাচ্চা না হওয়া আমার দোষ,এইটুকুন একটা বাচ্চা কোলে রাখা আমার দোষ। যাচ্ছ যাও,আসার সময় একটা দুধের কৌটো কিনে এনো।
মনোহরা সিঁড়ির একধাপ নেমেছে কি আবার ওর কলার ধরে টান। ঘুরে তাকাতেই বউএর খিলখিল হাসি। বড় মায়া লাগলো মনোহরার। বড় ভালো লাগলো। বহুদিন ওর এমন হাসি দেখেনি সে।
-হি হি হি দেখ দেখ, তোমাকে কেমন টা টা বাই বাই করছে।
বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকাল মনোহরা ঝরঝরে শিশুর হাসি। নিষ্ঠুর মানুষেরো সেকেন্ডের জন্য হলেও মন নির্মল হয়ে যায়। সিঁড়ির পাশে গ্রিলের ছায়া পড়েছে মুখে। সেই ছায়া দেখেই নিমেষে আতঙ্কিত হয়ে গেল মন। লায়নস ফেস? ভরন্ত পূর্ণ কুঠে এমন দেখতেই হয় মুখ। গা ইচপিচ করে উঠলো। দু চার লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে মনোহরা নিচে। বাচ্চাটাকে বিদেয় করতেই হবে। সারাজীবনের অশান্তি কে ভোগ করবে? বউ বলে বলুক কাঁদে কাঁদুক।
থানাতে গিয়েই মহা বেকুব হয়ে গেল মনোহরা।‘বচ্চাকো লেতে আইয়ে। এইসেই এফ আই আর দর্জ হো জায়েগা’? রোদ তখন মাথার উপরে তালু জ্বালিয়ে দিচ্ছে। একটা বেবীফুড কিনে কোয়ার্টারে পৌঁছেই দেখে দেওয়াল ঠেসে ঘাসের উপর বসে আছে পাঁচজন। ভিখিরিই হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে দোতলার ব্যালকনির দিকে ঠায় তাকিয়ে।ওদের দেখেই হৃতকম্প শুরু হয়ে গেল। পায়ে পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে মনোহরা জিজ্ঞেস করল,-কি কি ব্যাপার?
-আইজ্ঞা ওই থেলির কোলের ছ্যেলাটো…
মনোহরা বুঝে গেল,ওরা নিগোসিয়েট করতে এসেছে।ঝামেলা শুরু।-ভালোই হোলো,তোমরা এসেছ বাচ্চাটা নিয়ে যেতে তো? ওর মা কোথায়?
-না না আইজ্ঞা, উ ইখেনেই থাকুক। আপনারা কত উদার লোক। ছ্যেলাট ভোকে থাইকবেক নাই। ওই জ্যে? কত দাম দিয়ে উয়ার জন্যে পাউডার দুধ লিয়ে আসেছেন? কত ভাল। সুদু…। মনোহরা ওদের কথা শেষ হতে দিল না। খুব রাগ হচ্ছে। প্রায় চিত্কার করে বলল,-কাল সকালে। কাল সকাল সকাল এসো। কথা হবে।এখন নয়।ওর মাটাকে নিয়ে আসবে। এখন বিদেয় হও।
ওরা চুপচাপ ঘাড় হেঁট করে চলে গেল। মনোহরা একটু দমে গেল। যা ভেবেছিল তা নয় তাহলে। ভেবেছিল ওরা হুজ্জুত হাঙ্গামা করবে।তবু। এ ঝামেলা রাখা চলবে না। ঘরের ভিতর ঢুকেই একঝলক আলমারির ভিতর থেকে বার করা পুরোনো কাপড়ের সুবাস এলো নাকে। প্রথমটা মিস ক্যারেজ হওয়ার সময় বাচ্চার তোয়ালে নরম গদি বালিশ কেনা হয়েছিল। সেগুলো বার করেছে বউ। বিছানার ঠিক মাঝে ওসব পেড়ে বাচ্চাটাকে শোয়ানো হয়েছে। মনোহরা ভুরু কুঁচকে তার দুপুর আরামের বঞ্চিত অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাত্‍ তার খেয়াল হলো বিছানার আসল মূল্যবোধ। যে অভাবটা প্রতিরাত কাঁটার মত শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিত। সঙ্গমে সুখ নেই। দুজনে এপাশ ওপাশ করে দূরে সরে থাকতো। মাঝটা খালি। একবার বউকে বলেছিল মনোহরা, একটা প্রমাণ সাইজের খেলনা পুতুল কিনে এনে মাঝখানটায় শোয়াতে। খুবজোর মুখ ঝামটা খেতে হয়েছে। এখন যেন সেই দুরূহ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু?
আবার কিন্তুর মেঘ ঘনিয়ে এল মাথায়। ওটা যে অস্পৃশ্য বাচ্চা? মন যে চাইছেনা ওর কাছে ঘেঁষতে? মনোহরার জন্ম যে গ্রামে, যেখানে বছর আট অব্দি বড় হওয়া সেখানে গ্রামের একপ্রান্তে নির্বাসিত কুষ্ঠরোগীরা বাস করতো। সেখানে তার দাদু শেষ জীবন কাটিয়েছিল। শিশু বয়েস থেকে ওদের কাছ থেকে দূরে থাকতে শেখানো হতো। ওদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। মনোহরার অস্তিত্ব জুড়ে রয়েছে ওদের সঙ্গ পরিত্যাগ করা। এখন আর আমি কি করব? একথা তো বউকে বলে বোঝানো যায়না। গরম লাগছে। মনোহরা ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিল। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে। একপাশে হেলে আছে মুখ। কষ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। মনোহরা ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। খুব সুন্দর শিশু। পেলব হাত পা আঙুল। মনেই হচ্ছে না দরিদ্র রোগগ্রস্ত বস্তির। কিন্তু এ তো সেখানেরই? যতই সাবান শ্যাম্পু রগড়াও ওই বিতকুটে গা বমিকরা গন্ধ যাবে কোথায়? একটু দেখবো? ধ্যাত। কি দরকার। নাঃ একটু দেখিই না। বিছানাটা তো অশুচি গন্ধে ভরে আছে হয়তো। এখুনি তো স্নান করতে যাব। একটু দেখি।
নিজের সাথে চরম বোঝাপড়ার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে মনোহরা শিশুর গালে ঠোঁট রাখলো। বাচ্চাটার মুখ থেকে অপূর্ব টকটক স্বর্গীয় গন্ধ। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ওর কচি হাতটা মনোহরা চোখে রাখলো। বহুদিনের ক্লান্তির বোঝাতে ভারী হয়ে আসা চোখের পাতা যেন আরামে হালকা হয়ে গেল। আর অবাক কথা! ঠাকুর দেবতার উপর বহুদিনের বিতৃষ্ণা। কিন্তু এখন বন্ধ চোখে নাড়ুগোপালের ছবি স্পষ্ট উদয় হল কেন? আর সেটা ভাবতে একটুও খারাপ লাগলো না মনোহরার। নিজের দেহ মন আর বশে থাকছে না। হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চাটার পাশে শুয়ে পড়তেই রাজ্যের ঘুম নেমে এল চোখে। একটুক্ষনের জন্য, তবু মনোহরা একটুকরো স্বপ্ন দেখে নিলো।
কম্পাউণ্ডের ভিতরে মাঝ ময়দানে রঙিন সামিয়ানা। ভিতরে ফিট সাদা কাপড়ে ঘেরা একটা স্টেজ। স্টেজের মধ্যিখানে রত্ন খচিত সোনারূপোর সিংহাসনে বাচ্চাটাকে শোয়ানো হয়েছে। পাশে অনেক টাকার বাণ্ডিল। স্টেজের নিচে সামনের রোতে বসে অনেকগুলো অসুস্থ মানুষ। প্রত্যেকের কাছে এলুমিনিয়ামের ভিক্ষার বাটি। স্টেজে চেয়ারে বসে উকিল ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশ সাদা টুপি ও খাদি পরা সমাজসেবী ও মন্ত্রী। টেবিলে রাখা এগ্রিমেন্ট স্ট্যাম্প পেপার।বাইরে বিশাল কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। অতিথিদের মধ্যে একজন মাইকে মাইকে অনুষ্ঠানিক ঘোষণা করলেন, ‘বাচ্চাকে কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে মনোহরা সাউ পরিবারের হাতে তুলে দিতে যাদের সম্মতি আছে, তারা হাত ওঠান এবং একে একে স্টেজে উঠে আসুন। এই কাগজে আঙুলের টিপ ছাপ দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত একসঙ্গে উঠলো। সব হাতগুলোতেই একটাও আঙুল নেই।বক্তা আর্তনাদ করে উঠলো। নুলো ও ও ও …। সবাই দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে লাগলো। চমকে জেগে উঠলো মনোহরা। দেখলো পাশে দাঁড়িয়ে মুখে হাত ঢেকে বউ খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। বাচ্চাটার পাশে শুয়ে থাকতে দেখে ওর খুব আনন্দ হচ্ছে। মনোহরা মুখ গম্ভীর করে সোজা বাথরুমে।

দুপুরের খাবার খেতে খেতে মনোহরা চুপচাপ শুনলো বাচ্চাটার জন্ম বৃত্তান্ত। বাপ এ অঞ্চলের নয়। একজন খ্রিস্টান পাশকরা মিশনারী ডাক্তার। কিন্তু পোলিওগ্রস্ত। ওই অবস্থাতেই পড়াশুনো ডাক্তারী পাশকরা আর চিকিত্সক হওয়া। মিশন থেকে তাকে এই অঞ্চলের দাতব্য চিকিত্সার জন্যে রাখা হয়েছিল। ওষুধ আসতো বাইরে থেকে। থেলি বলে মেয়েটার সাথে সম্পর্ক ও পরে বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে কিজানি কেন আজকাল ওষুধ ও অনুদান আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি দপ্তর থেকে ওষুধ আসে না। অনুদান বলতে শুধু খিচুড়ি ও পুরোনো জামাকাপড়।
-এইসব কথা তুমি জানলে কি করে? কে বলেছে?
– ওইতো। তুমি এলে তখন তো ওরা নিচে ছিল? দেখলে না? তোমার জন্যেই তো অপেক্ষা করছিল।
-মেয়েটার হাত তো গলে গেছে রোগে। ডাক্তার হয়ে ওই রুগীকে বিয়ে করে কি করে?
-সেই কথাও তো ওরা নিজেরাই বলল। এর মা তো এক সমাজ সেবিকা? হাতে ফলস ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ভিক্ষে পাওয়ার জন্যে।
-তবুও কি অছ্যুত আছে? নিশ্চয়ই রোগ হয়েছে। মনোহরা মিনমিন করে কথাটা বলে উঠে পড়ল।
কুষ্ঠ রুগীরা যেন আজকাল আর ওষুধ খেতে চায় না। সরকারী অনুদান,রেশনের চাল আটা তেল,নানান এন জি ওদের সহায়তা। এসব সত্ত্বেও ভিক্ষে একটা জীবিকা হয়ে দাড়িয়েছে। মনোহরা একসময় একটা সংস্থা ধরে পীড়িতদের সেবায় খুব মেতে ছিল। তখন দরিদ্র আর গরীবের তফাতটা বুঝতে পেরেছে। গরীবের আত্মসন্মান বোধ আছে। ছেঁড়াকাপড় পরবে কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পেটে ভাত নেই তবু হাত পাতবে না। কিন্তু দরিদ্রের পেট ভরানো মুশকিল। ওদের লোভ বেশি। সংস্কার নেই। ভালো থাকতে জানেনা। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শোয়ার ঘরে ঢুকল। বাচ্চাটা এখনো ঘুমিয়ে। আহারে। বহুদিন যেন ঘুমোতে পায়নি। মমতা বুকের ভিতর থেকে উথলে উঠতেই মনোহরার মাথায় আবার সন্দেহ চাগিয়ে উঠলো। ওদের সেবা করতে তো মন চায় কিন্তু বড় ছোঁয়াচে রোগ যে? বড় খচ্চর রোগ। ওই বাচ্চাটার গায়ে যদি ওই রোগ লুকনো থাকে তো কাল দিন আমাদের হয়ে গেলে কি কোরবো। লোকে জানবে যখন কি হবে? চাকরিটা থাকবে তো?
এইসব ভাবতে ভাবতে মনোহরার দৃষ্টি পড়লো বাচ্চাটার বাহুমূলে। চমকে উঠে মাথাটা শূন্য হয়ে গেল মনোহরার। এর হাতে এরকম দাগ কেন? জন্মদাগ? জড়ুল? নাকি ওই ছ্যাচোড় ছোঁয়াচে রোগের লক্ষণ? রান্নাঘর থেকে বাসনপত্রের ঠুংঠাঙ আওয়াজ। বউ বাসন মাজছে। মনোহরা বাচ্চাটার হাতটা উঠিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো। আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিল। নোখ দিয়ে আস্তে আস্তে আঁচড় দিল। নাঃ বাচ্চাটার কোনো সাড় নেই মনে হচ্ছে। নড়ল না পর্যন্ত। মনোহরার খুব নার্ভাস লাগলো। এতে যদি না বোঝা যায় তবে ওই একটিই উপায় আছে। একটু পিন ফুটিয়ে দেখবো? সাড় আছে কি না? কিন্তু ও যে শিশু? অন্য কারোর। কি হতে কি হয় বলা যায় না। মনোহরা দোনামনা করতে লাগলো। শেষে একটা বড়সড় শ্বাস নিয়ে টেবিল থেকে ছুঁচসুতোর বাক্স থেকে একটা ছুঁচ নিয়ে এলো। একটু হালকা টাচ করব,ঠিক আছে? আস্তে আস্তে ছুঁচটা বাচ্চাটার হাতে ফোটাতে যাবেই এমন সময় চমকে উঠে দেখে পাশেই বউ দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে ছুঁচ ফোটানো হয়েছে আর বাচ্চাটাও কেঁদে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে বউ তাকে কোলে তুলে নিয়ে কি চিত্কার।
-মেরে ফেলবে নাকি? বিষ ছুঁচ ফোটালে? অন্যের বাচ্চা ধর্মে সইবে? এই তোমার বিবেচনা?
আরো কতকি। বাচ্চাটার হাতে রক্ত দেখে মনোহরা গুটিয়ে শুটিয়ে যেন মাটিতে মিশে যেতে চাইল। ভীষণ অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করতে লাগলো। ওখান থেকে উঠে ব্যালকনির চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে রইল। বউ বেশ কয়েকবার খেতে ডাকলো, সে সাড়া পর্যন্ত দিলো না। ওই একইরকম গোঁজ হয়ে বিকেল অব্দি বসে রইল। একবার সেখান থেকে উঠে শোবার ঘরে গিয়ে দেখল বউ বাচ্চাটার পাশে ঘুমিয়ে আছে। বাচ্চাটা একটা চাদর মুড়ি দিয়ে ঢাকা। ঢেকে রেখেছে কেন? ভাবতে ভাবতেই বউ উঠে বসে মনোহরার দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে চাইল। মনোহরা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,-খাবার খেয়েছ?
-না। এর তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কি করলে তুমি? ওর মা কালকে এলে কি জবাব দেব? বউ মুখে কাপড় দিয়ে ফোপাতে লাগলো। মনোহরার বুকে হাহাকার উথলে উঠলো। কেন ওই কাজ করতে গেলাম? বেশ কিছুক্ষন স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মনোহরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। বাচ্চাটাকে চাদর মুড়ি দিয়েই কোলে তুলে নিল। বউ আর্তনাদ করে উঠলো,-কি করছো কি? ওকে উপর থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলবে? হে ভগবান। এই জন্যেই এই রাক্ষসটার কপালে এখনো বাচ্চা নেই। দাও দাও ওকে বলছি? মনোহরা খুব শান্ত গলায় বলল, -জ্বরটা ওইজন্যে হয়নি। ওর ঠান্ডা লেগেছে। এখন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। ওকে সারিয়ে তুলতে হবে তো? মনোহরা বৌয়ের জবাব শোনার অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
সন্ধ্যের পর ডাক্তারের চেম্বার থেকে ঘর ফিরতি মনোহরার যেন মনে হলো এই জীবনযাত্রা যেন নতুন নয়। এই বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া যেন সংসার ধর্মের একটা আবশ্যক দিক আর এটা যেন স্বাভাবিকভাবেই তার জীবনে বহুদিন ধরেই আছে। বাচ্চাটাকে ঘাড়ে নিয়ে যখন হাঁটছিল তখন ওর গরম ও কোমল শ্বাস গলা বুক বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল,মিশে যাচ্ছিল তার অস্তিত্বে। ও যেন তার জীবনে এমন শিকড় গেড়েছে আর তাকে ছিঁড়ে আলাদা করতে পারবে না। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে ঠায় বসে রইল। মাঝে মাঝে হাতের ছুঁচ ফোটানো জায়গাটাতে হাত বোলাতে থাকল। বউ দাঁড়িয়ে থেকে অবাক হয়ে মনোহরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-ডাক্তার তো বলেছে,ও কিছু নয় একটু ঠান্ডা লেগেছে, সেরে যাবে। তুমি তো সারদিন কিছুই খাওনি। চল খেয়ে নেবে।
-তুমি যাও। আমি একটু পরে যাচ্ছি। বাচ্চাটা কী শান্ত না? বেশি কাঁদে না। দেখ? গায়ে জ্বর তবু মুখে হাসি। হাসিটা কী সুন্দর না?
-হ্যাঁ গো। ওর উপর তোমার মায়া পড়লো তালে। আর জানোতো,তোমাকে একটা কথা বলি। ওর মুখের আদল ঠিক তোমার মত গো। সত্যি বলছি। আয়না দেখে মিলিয়ে নাও।
বউ যাবার পর মনোহরা আর থাকতে পারলো না। ছোটো দাড়ি কামাবার আয়নাটা নিয়ে এসে একবার নিজের মুখ আর একবার বাচ্চাটার মুখ দেখতে লাগলো। সত্যি হোক বা ভ্রম মনোহরার বুক পুলকে ও আনন্দে ভরে উঠলো। রাতে শোবার আগে অব্দি একবারও মনে পড়লো না বাচ্চাটা আসলে কাদের। কি যেন ভালো লাগার নেশায় বুঁদ হয়ে রইল। শোবার সময় বউ খাটের একপাশে বাচ্চাটাকে শোয়াতে মনোহরা প্রতিবাদ করে উঠলো,-না ওকে মাঝে শোয়াও। বউ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো,-নাঃ। তোমাকে বিশ্বাস নেই। তুমি কি জানি আবার কি করে বসবে। মনোহরা জোর করে বাচ্চাটাকে তুলে মাঝে শোয়াতে গিয়ে চমকে গেল,-একি! এর তো জ্বর আবার বেড়েছে?
দুজনারই চোখ থেকে ঘুম চলে গেল। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে রইল মনোহরা। মাথার জলপটি দেওয়া,বাতাস করা ওষুধ খাওয়ানো আর টেম্পারেচার দেখা,এই করতে করতে কখন যে ভোর হলো টের পেলনা। ভোরের দিকে জ্বর ছাড়তে মনোহরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। একসময় এ বাবু এ বাবু এ বাবু…নিরবিচ্ছিন্ন ডাক শুনে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে দেখে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে নিচে কয়েকজন ভিখিরি,বাচ্চাটার মা ও হুইলচেয়ারে বসে একজন ফর্সা সোনালী দাড়িওলা সাদা পোশাকের একজন উপরে তাকিয়ে হাসছে। ওরা নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে এসেছে। মনোহরার বুকটা মুচড়ে উঠলো। হাত উঠিয়ে ইঙ্গিত করল একটু অপেক্ষা করতে।
নিচে যেতেই মনোহরা হাতজোড় করে নমস্কার করলো হুইলচেয়ারে বসা লোকটিকে।
-নমস্কার ডাক্তারবাবু। আমি আপনার কথা শুনেছি। নিশ্চয় আপনি বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে এসেছেন?
কিছু না বলে হাসিমুখে উনি একটা স্ট্যাম্প পেপার বের করে বাড়িয়ে দিলেন মনোহরার দিকে। -এটাতে সব টাইপ করা আছে। পড়ে নিয়ে সাইন করে দেবেন। বাচ্চাটা আমারই। কিন্তু ওর মা অসুস্থ। আমিও পঙ্গু। আমি সারাজীবনের জন্যে বস্তির পীড়িত দুস্থদের সেবা করার কাজে ব্রতী। সংসারী আমার ক্ষমতার বাইরে। ওকে আপনার আমি জানি ওকে আপনারা লালনপালন করবেন। বাচ্চাটা তাই চিরকালের জন্যে আপনার। আপনাদের মতো হৃদয়বান…।
বাকি কথা আর শোনা গেল না। মনোহরা দেখল ওর বউ বাচ্চাটাকে কোলে করে তার পাশে দাঁড়িয়ে। মনোহরা বউ ও বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।