T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সুবল দত্ত

তান্ত্রিক ফ্র্যাংকেষ্টাইন
সুপ্ত
ঘরময় কাঁচের গুঁড়ো ছড়ানো। মাঝে মাঝে চিত্র বিচিত্র মিশ্রিত আবীর। মাঝে ঘট পান সুপারি ফুল। আলো বলতে চারপাশে গোবরে পোতা জোনাকি দপ দপ করে জ্বলছে। এমনভাবে সেগুলো বসানো, তাঁর ছায়া পড়ছে না। তিনি হাঁটু মুড়ে বজ্রাসনে ধ্যানস্থ। নগ্ন। কোমরে দগদগে পোড়া ঘা। আগুন থেকে অর্ধমৃতাকে উদ্ধার করেছেন।
কাঁচধুলার উপর কয়েকটি বড় শামুক শুঁয়ো বের করে রাস্তা কেটে খুঁজে বেড়াচ্ছে জলাশয়। কয়েকটা জিয়ল মাছ, মাগুর ও কই এদিকে ওদিকে লম্বা লাফ দিচ্ছে। আছাড়িপিছাড়ি। উনি জানেন, ডাঙাতে বেঁচে থাকার জন্যে ঈশ্বর ওদের আলাদা একটা ফুসফুসের ব্যবস্থা করেছেন। যতক্ষণ ওরা বাঁচবে ততক্ষণ তাঁর সাধনা সম্পন্ন হবে। তারপর জলচরেরা জলে আর তাঁর সামনে শুয়ে থাকা এই স্থলচরটি নিশ্চিন্তে আপন শক্তিবলে নির্ভয়ে জীবনযাপন করবে। সত্যের মুখোমুখী করাবে জনেজনে। হিংস্রদের দমন করতে পারবে।
তিনি জানেন,তাঁর এই নিজস্ব তন্ত্রসাধনা ব্যতিক্রমী। প্রাচ্যের বহুদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন,বহু ধর্মের সাথে প্রায় মিলেমিশে গেছেন। ইহুদীদের জুডাইজম, মিশরের ইসলামিক সুন্নি, ইরানের সিয়া,তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম,খ্রিস্টানধর্ম এবং স্বদেশে বেদান্ত।
বিদেশে ঘুরতে ঘুরতে নানা রোগের শিকার হয়েছিলেন। সেনট্রাল আমেরিকার প্রত্যন্ত নিকারাগুয়াতে মারন জুনেটিক রোগের শিকার হয়েছিলেন। ইবোলা। চোখ লাল,চামড়া ফেটে রক্ত,রক্ত বমি। চীনে ভয়ানক সার্স কোভিডের শিকার হয়েছিলেন বহু আগে। দেশে এসে লেপ্রসির শিকার হলেন। কিন্তু তিনি দমে জাননি। বরং এইসব রোগ মানুষের দুঃখকষ্টের জ্ঞান দিয়েছে বলে কৃতজ্ঞ। তরতি শোকমাত্মবিত্। আত্মজ্ঞ শোক কষ্টকে অতিক্রম করে যায়। কিন্তু সর্বধর্মের সার জেনেছেন, মহাত্মাদের এতো পাওয়ার এত শক্তি থাকতেও কেউ নিপীড়িত শোষিত নির্যাতিতদের শক্তি দিতে পারেননি। শুধু সহানুভূতি উদারতা উগ্রতা থেকে বিরত থাকার জ্ঞান শিক্ষা এইসবের প্রবচন। অথচ ওনারা জানেন যে সহানুভূতি মানুষের কষ্ট অসহায়তা আরো বাড়িয়ে দেয়। শয়তানের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আরো কমে যায়। বাঁচার আগ্রহ কমে যায়। ভীতু হয়ে জীবনযাপন করে।
তিনি তপস্যাবলে সর্বজ্ঞ হয়েছেন। তাঁর প্রাকচেতনা বা ইনটুইশন তাঁকে অগ্রিম জানান দিচ্ছে অজ্ঞান ও কামাচারী মানুষের অবাধ শয়তানির কর্ম। উনি উঠলেন। তাঁর মাথায় এক তাজা সংকেত এসেছে। একটা বীভত্স ঘটনা আজ যা ঘটেছে উনি জানতে পেরেছেন। কি করতে হবে না হবে এবার সিদ্ধান্তে এলেন। অত্যাচার বন্ধ করতে এবার নতুন কর্মের পালা।
প্রায় অন্ধকার বনজ গাছপালা ঘেরা তাঁর কুটির। ভিতরে অত্যাধুনিক চিকিত্সা ও জৈব গবেষণার মেশিন ও যন্ত্রপাতি। উনি বাইরে বেরিয়ে ঘন ঝোপের আড়ালে একটা টয়েটো গাড়ি স্টার্ট করলেন। গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে এক হাসপাতলের কাছে শ্মশানে এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমে আধো অন্ধকারে দেখলেন একটা অসমাপ্ত চিতা। তার নিচে কাঁচের অজস্র টুকরোর উপর শুয়ে আছে এক নারী। স্থির। কেন চিতায় তোলেনি এই অর্ধপোড়া দেহ তার অন্য কাহিনি। কেন তাকে সম্পুর্ণ মেরে ফেলা হয়নি কেন তারা ফেলে পালিয়ে গেল তা এহবাহ্য। এখন দেহটি সযত্নে সাদাকাপড়ে ঢাকা। হয়তো নৃশংস মানুষদের মধ্যে কেউ একটু ধর্মভীরু।
সারাগায়ের কাটাক্ষত দিয়ে এখনো রক্ত ফুটে বেরচ্ছে সাদা কাপড়ের ওপর দিয়ে। তিনি জানেন এই দেহটি গতরাতে বেশ কয়েকজনের ধর্ষণের শিকার। তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন এটা পলিটিক্যাল মার। এই মহিলাটি মস্ত বড় ঘোটালার কথা জেনে গিয়েছিল। কোনখানে ঘরভর্তি বেআইনি কোটি কোটি টাকা ঠাসা আছে। হিউম্যান ট্রাফিকিং কোন রাস্তাদিয়ে কিভাবে হয়। সব সব। বিনা নোটিশে ওরা প্রফেশন্যাল কুকর্মীদের মহিলাটির উপর আক্রমণ করতে পাঠায়। সেখানেও পুলিশ নিষ্ক্রিয়। মহিলাটির উপর জন সমক্ষে অনিবার্য কুকর্ম হওয়ার পর, ডাক্তার ক্লিনিক্যাল ডেথ ঘোষণা করে। শেষে মাঝরাতে পুলিশ মিডিয়া সোসাইটি নীরব হয়ে যাওয়ার পর মেডিক্যাল ভ্যানে বডি শ্মশানে এনে ফেলে।
অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কয়েকটা কুকুর মৃত মাংসের সন্ধানে ইতঃস্তত ঘোরাঘুরি করছে। চারপাশে কেউ কোথ্থাও নেই। তিনি সাদা চাদরে মোড়া দেহটিকে তাঁর নিজস্ব গাড়িতে তুললেন। নির্বিঘ্নে তাঁর কুটিরে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু হল এই উপচার। উনি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানসম্মত ও মিশ্রতন্ত্রসাধনায় মেয়েটিকে জাগাবেন। মস্তিষ্কে বুদ্ধি ও শক্তিচেতনা ভরবেন। দুষ্টদমনের জন্য প্রস্তুত করবেন। এই বিশেষ গবেষনামূলক ক্রিয়াতে এবার মনোনিবেশ করলেন।
ঘরে সর্বক্ষণ একটা হামিং শব্দ। ওমমমমমম…। কৃত্তিম শ্বাসযন্ত্র,কৃত্তিম হৃদয়যন্ত্র,ইকো ইসিজি মেশিন,মাথায় বুকে হাতে পায়ে প্রচুর ইলেক্ট্রোড। মাথার খুলির ভিতর থেকে সূক্ষ্ম ইলেক্ট্রোড তারগুলি তিন চারটি মাছ শামুক ও ব্যাঙএর মাথায় ঢোকালেন। এই কাজে প্রচুর বিদ্যুত্ লাগে, তাই কাছের হাই টেনসেন ইলেকট্রিক তার থেকে ডাইরেক্ট লাইন টানা হয়েছে। ওনার সামনে ভূডুতন্ত্র ও এলকেমিস্টের সরঞ্জাম। ব্ল্যাক কাল্ট,টাইবেটিয়ান ও ৬৪তন্ত্রের সরঞ্জাম। এবং রেজারেকশন মানে প্রাণের পুনরুথ্থানের জন্য অত্যাধুনিক বিজ্ঞান সম্মত সরঞ্জাম। শরীর গরম রাখার জন্য তাপের ব্যবস্থা। শরীর গরম আছে কিন্তু শ্বাস চলছেনা। এই কাজে প্রচুর ধৈর্য দরকার। স্বামিজী শান্ত ও মৌন হয়ে প্রতিটি কর্মে মনোনিবেশ করলেন। ব্যাঙটি স্থির নিশ্চল হয়ে আছে কিন্তু উভচর কই ও মাগুর খুব অশান্ত। মাঝে মাঝে লাফ দিচ্ছে। তিনি খুব অল্প অল্প করে রিহোস্টাট দিয়ে বিদ্যুত্ শক্তি বাড়াতে লাগলেন। এরমধ্যে যেখানে যা ক্ষত আছে সেগুলো থেকে কাঁচের টুকরো খুব যত্নে তুলে ফেলে এন্টিসেপ্টিক দিয়ে যত্নে পরিষ্কার করলেন। কয়েকটি দগদগে চেরা ক্ষত সেলাই করতে হলো। কতটা অমানুষ হলে এমনটা করতে পারে, ভাবা যায়না। উনি মুখের দিকে তাকালেন। সরল সুন্দর কোমল নিষ্পাপ মুখ। এই মুখদেখে পাপী ছলকপটি মানুষেরা হয়তো আবার কুকর্মের জন্যে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এবারে ঘটনা হবে অন্যরকম।স্যালাইন ও ক্যাথিটার রেডি। যতক্ষণ না দেহে রক্ত প্রবাহ শুরু হচ্ছে ততক্ষণ ওগুলোর কোনও কাজ নেই।
জাগ্রত
এইসব করার পর স্বামীজি নগ্ন হয়ে দরজার বাইরে পূর্ণচন্দ্রের ফুটফুটে জ্যোত্স্নালোকে কাঠের ফাঁপা গুঁড়িতে ভূডুতন্ত্র মতে একটি কাঠের বাঁকানো লগ দিয়ে পিটতে পিটতে অদ্ভুত সুরে কুলকুলি ও চিত্কার করতে লাগলেন। একবার ভিতরে ঢোকেন সেই দেহটি ছুঁয়ে আসেন আবার শুরু করেন। সেই রোমাঞ্চক শব্দে নিশাচর প্রাণীরা ডাক ছেড়ে পরিসর থেকে পালিয়ে যেতে লাগল। একসময় তা সাঙ্গ হলে এলকেমিস্টের সরঞ্জাম থেকে এসিড দিয়ে গলানো সোনা রূপো তামা ইত্যাদি তরল ধাতু মেয়েটির বুকের ঠিক মাঝখানে রাখলেন। এবার শুরু হলো কালা জাদু বা ব্ল্যাক কাল্ট। সেইসব নানান উপচার নানান ভৌতিক পারলৌকিক চলতে লাগলো। চাঁদ তখন আকাশের মাঝখানে। এইসবের শেষে টাইবেটিয়ান তন্ত্রমন্ত্রে ধ্যান প্রাণায়াম শেষে এবার তাঁর শুরু হলো দেবী আহবান। তন্ত্র সাধনার চৌষট্টি তন্ত্রের সরঞ্জাম থেকে প্রতিটি সামগ্রী দিয়ে দেবী জাগরণ শুরু হলো। হোম আহুতি, অঙ্গশুদ্ধি নানাপ্রকারের মন্ত্র যজ্ঞ এবং সাথে সাথে ইকো মেশিনের দিকে নজর রাখা। এক একবার উঠে দেহের রূপ রঙের পরিবর্তন হচ্ছে কি না দেখে সন্তুষ্ট হয়ে দ্বিগুন উত্সাহে ক্রিয়া চলতে থাকলো। রাতের শেষ প্রহরের দিকে সমস্ত উপাচার শেষ করে ধ্যান মগ্ন হলেন। ইকো ও ইসিজি মেশিন এখনো সাড়া দিচ্ছে না। তবে গা এখন বেশ উত্তপ্ত। চোখের পাতা টেনে দেখে সন্তুষ্ট হলেন। চুল টেনে দেখলেন। নাঃ চুলের গোড়া বেশ মজবুত রয়েছে। হৃত্স্পন্দন ও শ্বাস ছাড়া মৃতের কোনও লক্ষণ নেই। মুখের খুব কাছে নাক দিয়ে গন্ধ নিলেন। নাঃ মৃত্যুর গন্ধ খুব একটা স্পষ্ট নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি কুটির ছেড়ে বাইরে প্রাঙ্গণে বেরোলেন। চাঁদের দিকে তাকালেন, শেষ প্রহরে ম্রিয়মান জ্যোত্স্না। গভীর ঘুমে রয়েছে চরাচর। আবার ভিতরে ঢুকে দেখলেন,উভচর প্রাণীগুলি কিন্তু আরো বেশি সচল ও সজীব হয়ে আছে। ওদের ব্রেন থেকে তবে ঠিক ঠিক সংবেগ প্রবাহিত হচ্ছে মেয়েটির দেহে। সব দেখে টেখে উনি এবার শেষবারের মত বিদ্যুত্ প্রবাহ অন্তিম মাত্রায় দিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির সারা দেহ কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। মনিটরে গ্রাফ দেখা গেল, তবে সামান্যই। কৃত্তিম হৃদয় মেশিন একটু সচল হয়ে থেমে গেল। কৃত্তিমশ্বাস দেওয়ার বেলুনটি একটু ফুলে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেল। সব দেখে উনি কিন্তু নিরাশ না হয়ে বরং স্মিত হাসলেন। এবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রয়োজন। দীর্ঘ প্রতীক্ষা মানে কয়েক ঘণ্টা, কয়েকদিনও হতে পারে। উনি কুটিরের দরজা বন্ধ করে কাপড় চোপড় গামছা নিয়ে নদীর দিকে রওনা হলেন। স্নানের প্রয়োজন।
স্নান সেরে কুটিরে ফিরতে ভোর হয়ে গেছে। উনি নিশ্চিন্ত এতো তাড়াতাড়ি তার দেহে স্পন্দন আসবে না। যদিও কৃত্তিম হৃদয়যন্ত্রের সাহায্যে জমে থাকা রক্ত শরীর থেকে বের করে তার বদলে নতুন রক্ত ঢোকান চলছে। এখনো অনেক কাজ। ওর মানসিক স্থিতি বদলাতে হবে। ওকে লড়াকু করতে হবে। হিংসার বদলে প্রতিহিংসা। কিন্তু কবে? তাঁর মনে আছে, একটা সদ্যমৃত ভীতু খরগোসকে একটা নেকড়ের মুখ থেকে ছিনিয়ে এনে এইসব উপচার করে তাকে পুনর্জীবিত করেছিলেন। বেশ কয়েকদিন সে তাঁর কুটিরেই ছিল। অবাধে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে। বরং ওকে দেখলে হিংস্র প্রানীরা ভয়ই পেত। তারপর কোথায় যে চলে গেল কে জানে। তবে স্বামিজী নিশ্চিত, সে ভালই আছে এবং তার প্রজন্ম নিশ্চয়ই নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হবে। তবে জেনেছেন সে এক ভিন্ন মাংসাশি হয়ে গেছে।
কুটিরের বন্ধ দরজা খুলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। মেঝেতেই থপাস করে বসে পড়লেন। সে নেই। ইলেক্ট্রোডস ক্যাথিটার হাতে পায়ের বজ্র বাঁধন সব খোলা। উভচরেরা সারা মেঝে জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। মেঝেতে পুজোর উপাচার সব ঠিকঠাক। শুধু মেঝে জুড়ে সিঁদুর দিয়ে লেখা, ‘প্রণাম জন্মদাতা গুরুদেব। আমি এখন নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম। চললাম। আমার মিশন হবে মানব ও প্রকৃতি প্রেম’।