গল্পে সুমন দে

লাল কার্ড রহস্য

রাত তখন প্রায় দুটো, একটা মৃদু শব্দে অঙ্কিতার ঘুম ভেঙে গেল। আওয়াজটা বোধ হয় বসার ঘরের থেকে এসেছে, কিন্তু তারপর আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না বলে আবার স শোয়ার চেষ্টা করলো অঙ্কিতা। ঘুম এলো না, তাই বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিতে গিয়ে দেখলো তাতে জল নেই, রাতে শোয়ার আগে লক্ষ্য করা হয়নি জল নেই বোতলে,অগত্যা কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল ঘুম চোখে। লাইট জ্বালালো না আর,ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে এগিয়ে চললো,ফ্রিজটা খুলতে যাবে ওমনি অস্পষ্ট আলোয় অন্য একজনের উপস্থিতি টের পেয়ে অঙ্কিতা নিজের অজান্তেই প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো জ্বলে উঠলো এবং একজন মাঝবয়সী লোক বলে উঠলো “আরে আরে…আমি,ভয় পাসনা…ঘুম আসছিল না বলে এদিকে পায়চারি করছিলাম।”
এটা অঙ্কিতার বাবা,ইন্দ্রনীল ঘোষ বেশ কদিন হলো শরীরটা খারাপ যাচ্ছে তাই বাড়িতেই আছে বেশ কদিন। অঙ্কিতার বাবা অ্যান্টিক ডিলার, বিভিন্ন পুরাতন ও দুষ্প্রাপ্য জিনিসের কেনা বেচা করে,বাড়িতেও পুরনোও অসাধারণ কারুকার্য করা প্রচুর আসবাব রয়েছে।গম্ভীর দেখতে হলেও বেশ রসিক মানুষ, মাঝে মাঝেই ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে।
অঙ্কিতা রেগে বাবার উপর চেঁচাতে লাগলো,”তোমার শরীর খারাপ আর তুমি কি করছ এত রাতে? আর পায়চারি করছিলে না আমি জানি, টেবিলের দিকে কিছু করছিলে…”
“আরে নারে…দুদিন ধরে নতুন করে রং হচ্ছে বাড়ি, কেমন হচ্ছে আর কতটা বাকি এইসব দেখছিলাম আর কি।”
“ঢপ মেরোনা বাবা, নিশ্চয়ই অন্য কিছু করছিলে, যাইহোক এক্ষুনি ঘুমাতে যাও, কাল সকালে তোমার ফোন দিয়ে জানবো।”
“গুড নাইট বলে এগোতে যাবে অমনি বলে উঠলো,”লক্ষ্মী মা আমার, তোকে বড্ড ভালোবাসি”বলে বুকে জড়িয়ে ধরে আর‌ও বলে “আমি ডাইরিতে যে আবোল তাবোল লিখি, আমি মরে যাওয়ার পর ওগুলো পড়িস, তাহলে আমায় আর মিস করবিনা তখন…”
“তুমি চুপ করবে বাপি, তোমার কিছু হবে না, আই লাভ ইউ”।
পরদিন সকাল স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছিল, অঙ্কিতা ভোরে পাপীকে(কুকুর) নিয়ে বাগানে গেল, যোগাসন করলো, পেপার কাকু পেপার দিয়ে গেল। বাড়ির কিছুটা অংশ রং করা বাকি তাই মিস্ত্রিরাও চলে এসেছে, কাকা অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে আর কাকিমা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অঙ্কিতার মা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিল, বাবা নতুন বিয়ে আর করেননি। বাবা ডাইনিং রুমের জানালাটা দিয়ে রং করা দেখছিলো হঠাৎ এক মিস্ত্রি পিছলে গেল, রং করতে করতে বাঁশের কাঠামো পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা দুতলার সমান উঁচু, মিস্ত্রিটা যখন নীচের বাগানে পরছে ততক্ষণে এদিকে ইন্দ্রনীলবাবুর এই ঘটনা চাক্ষুষ দেখা মাত্র কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, মেঝেতে লুটিয়ে পরে, সকলেই দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসে। প্রথমে আসে অঙ্কিতা, ইন্দ্রনীলবাবু তাকে কিছু বলতে চাইছে,অঙ্কিতা গ্রাহ্য না করে বাবাকে তোলার জন্য বলছে কাকুকে। তখন‌ও ইন্দ্রনীলবাবু অঙ্কিতার কাছে কিছু চাইছে,বসার ঘরের দিকে আঙুল করে কিছু চাইছে, শুধু বারবার “দে…দে…”বলতে বলতে শরীরটা হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে গেল।
এই বয়সেই দুজন কাছের মানুষকে হারিয়ে মেয়েটা একদম মনমরা হয়ে গেছে। একা ঘরে বসে থাকে, বাড়িতে একজন দুজন করে অনেক আত্মীয় দেখা করতে আসছে তবুও সে কারোর সাথে কথা বলে না। কাকা কাকিমা‌ যথেষ্ট যত্ন করে ওকে, নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে, নিজেদের ছেলেমেয়ে বলতে কেউ নেই। কাকিমা বলে ওকে কদিন সময় দাও, একা থাকতে দাও, ওর এমন আকস্মিক ঘটনাটা মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে, কদিন পর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
যে মিস্ত্রিটা পিছলে পাঠানো থেকে বাগানে পড়ে গিয়েছিল তার পা টা ভেঙে গেছে, প্লাস্টার করতে হয়েছে, আপাতত সেই ঠিক আছে আর বাড়িটুকু রং করা হয়ে ওঠেনি, ওভাবেই পড়ে আছে।
সুমিত হলো অঙ্কিতার খুব কাছের একজন বন্ধু। ওদের ভাষায় বেস্ট ফ্রেন্ড। অঙ্কিতার বাড়ি থেকে মিনিট ১৫ দূরে থাকে,ইন্দ্রনীলবাবুর মৃত্যুর পর সুমিত অঙ্কিতার পাশে সব সময় ছিল, মানসিকভাবে সফল হয়েছে। সুমিত হিস্ট্রিতে এম.এ করছে আর অঙ্কিতা বাংলা অনার্স প্রথম বর্ষ। যতক্ষণ সুমিত ওর পাশে থাকে বা ফোনে কথা বলে কতক্ষণ মেয়েটা সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু বাকি সময়টা কেমন গুমড়ে থাকে মেয়েটা।
আজ সুমিত রোজকার মতো বিকালে অঙ্কিতার বাড়ি এসেছে, জানালার ধারের টেবিলটায় বসে সুমিত একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো
“জানিস যারা সবসময় চুপচাপ ঘরে বসে থাকে তাদের ভুতে ধরে”
“প্লিজ ডোন্ট ট্রাই…হাসানোর চেষ্টা করার দরকার নেই আমি ঠিক আছি, কিন্তু কাকিমা যদি এদিকে এসে তোকে সিগারেট হাতে দেখে তোর কি হবে সেটা ভাব”।
“বড় হয়েছি খেতেই পারি, আর তোর কাকিমা জানে অলরেডি, কিন্তু তুই যখন ঠিক আছিস তবে মুখ গোমড়া করে কি ভাবছিস?”
“বাবার ডায়েরিটা পড়ছিলাম,কি সব ভুলভাল মজা কত কি লেখা,অর্ধেক বুঝতে পেরেছি অর্ধেক নয়। কিন্তু আমায় লালকার্ডের লেখাটা খুব ভাবাচ্ছে যেটা বাবা মারা যাওয়ার আগের দিনের ডেট লেখা পেজটায় আছে,আর সেদিন আমায় ডায়েরির কথাও বলেছিল কেন?”
“স্ট্রেঞ্জ…দেখি কি লেখা…”
অঙ্কিতা একটা কালো মলাটের ডায়েরি থেকে একটা লাল কার্ড বের করে সুমিতকে দিল,যাতে উপরে লেখা
“যা থাকলে অনামার ঐশ্বর্য বাঁচে
লাল দলিল,স্কটল্যান্ডের রাজার কাছে”
লেখাটা দুবার মনমনে আওড়ালো সুমিত তারপর হঠাৎ বলে উঠলো “আজ এলাম, আর এটা আমি নিয়ে গেলাম, আর মন খারাপ করবি না কেমন”
“এই তো এলি…”অঙ্কিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সুমিত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সুমিত নিজের বাড়ি ফিরে একটা নোটবুক আর পেন্সিল নিয়ে সোজা ছাদে উঠে গেল। লাল কার্ডের লেখাটা নোটবুকে লিখলো, কি যেন ভাবলো তারপর ‘ঐশ্বর্য’ শব্দটায় গোল করলো পেন্সিল দিয়ে এরপর ‘স্কটল্যান্ডের রাজার তলায় লাইন টানলো। একভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ওখানে বসে ভাবতে লাগলো কাকু ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন।
এদিকে রাত হয়ে এল প্রায় দশটা, অঙ্কিতা ভাবছে একবারও ফোন করল না সুমিত,পাত্তাই নেই ছেলেটার… হলো কি?এইভেবে নিজেই সুমিতের নাম্বার ডায়াল করলো। সুমিত রিসিভ করেই বলে উঠলো,
“তোর ঐশ্বর্য বলতে মাথায় কি আসে?”
“ঐশ্বর্য বলতে এই মুহূর্তে ঐশ্বর্য রাই বচ্চন এর কথাই মাথায় আসছে…”
“ধুর!!! ইয়ার্কি মারিস না, বল না…”
“ঐশ্বর্য বলতে ধনসম্পদ, গুপ্তধন… এইগুলোই…”
“আমিও ওগুলো ভাবছিলাম, ভাবছিলাম তোর বাবা কোনো গুপ্তধনের সন্ধান দিচ্ছে কিনা…কিন্তু না ওসব না।
আচ্ছা “অনামা” বলতে কি মনে হয় তোর?
“কোনো নাম নেই এমন কেউ বা বেনামী এমন কেউ”…
“ভুল, তোর বাবা যেটা বলতে চেয়েছে সেটা বাংলা অভিধান দেখলে দেখবি অনামা অর্থাৎ অনামিকা আর ঐশ্বর্য বলতে এখানে সম্মানের কথা বলেছেন…”
“তার মানে ‘যা থাকলে অনামার ঐশ্বর্য বাঁচে ‘মানে অনামার ঐশ্বর্য বাঁচে মানে অনামিকার সম্মান বলতে আংটি,
বাবা আংটির কথা বলেছে, কিন্তু কোথায়? কার আংটি?
“দ্বিতীয় লাইনটা মনে আছে?”
“হ্যাঁ, লাল দলিল, স্কটল্যান্ডের রাজার কাছে এটাই তো?”
“স্কটল্যান্ডের রাজা বলতে তোর মাথায় কি আসছে?”
অঙ্কিতা গুগলে সার্চ করলো king of Scotland,
“কিসব দিচ্ছে, চতুর্থ জেমস, রবার্ট দ্য ব্রুশ, ম্যারি কুইন… ধুস!!! কতসব আছে…”
“আরে তারপরের গুলো বল…”
“ওই তো ডোনাল্ড, ম্যাকবেথ…”
“স্টপ স্টপ…ম্যাকবেথ, শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ পড়েছিস তো? তোদের বাড়িতেই আছে…”
“ও মাই গড… ওয়েট ওয়েট আ মিনিট” বলে বইয়ের আলমারি থেকে ম্যাকবেথটা বের করল অঙ্কিতা আর পাতা উল্টাতে লাগলো।
সাথে সাথেই আর একটা লাল কার্ড পেল অঙ্কিতা, উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে ওর আর চোখমুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। ফোন নিয়ে লাফিয়ে উঠলো অঙ্কিতা বলে উঠলো,
“লাল দলিল পেয়ে গেছি, এতেও কিছু লেখা আছে,
কৃষ্ণকল, গ্রহর নির্দেশক
রবির সহিত সম্পর্ক, ছায়ার পরিপূরক।
আর নীচে আরেকটা লেখা বাংলায় ‘১’ দিয়ে ‘মাতামুল মূলক দাঁড়া তোকে whatsapp করছি” বলে ছবি তুলে সুমিতকে পাঠালো।
“এসব আবার কি বলতো, কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং বল, কেমন যেন থ্রিল থ্রিল অনুভূতি হচ্ছে”।
“ও হ্যালো মিস্টার, ডিনার হয়েছে? আগে গিলে আয় তারপর রহস্যভেদ করবি”
“ওকে ম্যাডাম, জো হুকুম… রাতে কথা হচ্ছে, টাটা” বলে সুমিত ফোনটা রেখে দিল।
রাতে কথা বলার পর অঙ্কিতা ঘুমিয়ে পড়লেও সুমিত সিগারেট ধরিয়ে ফোনের ছবি থেকে লেখাটা নোটবুকে কপি করল। ‘রবির সাথে সম্পর্ক…ছায়ার সাথে পরিপূরক’ এমন দুবার বলল আর কি যেন ভাবতে লাগলো। অনেক রাত পর্যন্ত লেখাটা নিয়ে সুমিত ভাবনা চিন্তা করলো, একবার ফোন দেখে কিসব সার্চ করে তো একবার নোটবুকে কিসব
দেখে। অনেক রাত পর্যন্ত এসব করেও মানে বুঝতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়লো সুমিত।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল সুমিতের,জানলা থেকে রোদ চোখে পরছে অনেকক্ষণ ধরেই, বিরক্ত হয়ে শেষমেশ উঠে পড়লো। জানলায় চোখ পড়তেই সুমিত লাফিয়ে উঠলো, কোনোরকমে ব্রাশ করে ব্রেক ফাস্ট না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। মা বলে উঠলো, “আরে যাচ্ছিস কোথায়? খেয়ে তো যা…”
“অঙ্কিতার বাড়ি যাচ্ছি, ওদের বাড়ি খেয়ে নেব।”
সুমিত রাস্তায় অঙ্কিতাকে ফোন করে বলে তোর বাড়ি যাচ্ছি,
কাকিমাকে কিছু রান্না করতে বলতো…”
“হাঁপাচ্ছিস কেন তুই? তার মানে লাল কার্ডের রহস্য ভেদ করে ফেলেছিস?”
“সম্পূর্ণ নয়, তবে হয়ে যাবে তোর সাহায্য লাগবে, কিন্তু “মাতামুল মুলক”টা এখনো অধরা। বাকি কথা বাড়ি গিয়ে, টাটা”।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুমিত অঙ্কিতার বাড়ি উপস্থিত হলো। কাকিমা বললো পরে কথা হবে আগে খাবার টেবিলে বোস তোরা, গরম লুচি আছে…”থ্যাংক ইউ কাকিমা আর একটু চা হলে ভালো হয়…”
“সব আছে, ডোন্ট ওয়ারি। তুমি না থাকলে মেয়েটার যে কি হতো… কাল থেকে কত হাসি খুশি লাগছে…”
অঙ্কিতা বলে উঠলো,”আবার এসব নিয়ে পড়লে? এখন শুরু করো না এসব, ও নিজের খেয়াল রাখতে পারে না ও নাকি আমার খেয়াল রেখেছে…দেখো ব্যস্ত মানুষ উল্টো জামা পড়ে চলে এসেছি কেমন…”
“তুই চুপ করবি? খেয়াল করিনি তাড়াহুড়োয়। কৃষ্ণ মানে যদি কালো হয় তবে কল মানে কি? আর ‘রবির সাথে সম্পর্ক ছায়ার পরিপূরক’ এটার সাথে এর মিল কোথায়?”
“কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
“প্রথমদিকে সূর্যের আলোর সাহায্যে পৃথিবীর আবর্তন অনুযায়ী একটা দন্ডের সাপেক্ষে ছায়া দেখে সময় নির্ধারণ করা হতো, মিশর বা ব্যাবিলনে এর সূত্রপাত। এগুলো জানিস নিশ্চয়ই, আর ‘প্রহর’ দিয়েই আগে সময় ধরা হতো। পরে থাকছে ‘কল’। কল মানে কোনো মেশিন বা যন্ত্র অর্থাৎ সময় নির্দেশক মানে ঘড়ি।”
“তাহলে ‘কৃষ্ণ কল, প্রহর নির্দেশক, রবির সহিত সম্পর্ক, ছায়ার পরিপূরক’ বলতে কালো ঘড়ি?”
“exactly!! কালো ঘড়ি কোথায় আছে তোদের?”
সুমিতের ডানপাশের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো অঙ্কিতা,সুমিত একটা টুল নিয়ে ওপরে উঠে ঘড়িটা পারতেই পিছনে আরেকটা লাল কার্ড। সুমিত আর অঙ্কিতার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো, মুখ জুড়ে চওড়া হাসি দু’জনের মুখেই। সুমিত ঘড়িটা জায়গা মতো রেখে যেই না নামতে গেছে অমনি পিছলে পড়ল অঙ্কিতার ঘাড়ে। অঙ্কিতা সুমিতের ওজন সামলাতে না পেরে দুজনেই মেঝেতে পরলো। নিচে অঙ্কিতা, তার ওপরে সুমিত। দুজনেই আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে যাবে এমন সময় দুজনের চোখ দুজনের দিকে তাকিয়ে। শুধু শ্বাস নেওয়ার গরম হাওয়া দুজনের ঠোঁটে এসে লাগছে, বুকের স্পন্দন দ্বিগুণ ভারে বেড়ে গেছে, দুজনেই অপ্রস্তুত কি করবে ভেবে পাচ্ছে না অঙ্কিতা আস্তে আস্তে বলল “তুই আসার সময় সিগারেট খেয়েছিলি? এখনো গন্ধ…”
সুমিত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠলো “ধুর!!! সর আমায় লেখাটা পড়তে দে” বলে অঙ্কিতার ওপর থেকে উঠে হাত দিয়ে অঙ্কিতাকে তুলে ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবে অমনি দেখে কাকিমা দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিল। লজ্জায় দুজনেই মাথা নিচু করে অঙ্কিতার রুমে চলে গেল।
“কাস্ট মেঝে, পুরাতন অক্ষয়
পুষ্পগুচ্ছের আঁধার, কেন্দ্রে বিরাজময়”

২. সুজাউদ্দৌলা
“এসব আবার কি? আগের ‘মাতামূল মূলক’টা কি সেটা বুঝতে পারলাম না আবার এসব।”
“কাষ্ঠ মেঝে বলতে কাঠের মেঝে তো আমাদের নেই কোথাও…
আমি জাস্ট আর ভাবতে পারছি না, অনেকদিন হলো কলেজ যাইনি আজ বেরোবো।”
“আমার ক্লাস নেই তবু চল যাই, একটু লাইব্রেরীতে যাব, ভালো লাগছে না!”
লাইব্রেরীতে বসে থেকেও সুমিত কিছু মানে উদ্ধার করতে পারলো না। কলেজ থেকে ফিরে সারা সন্ধ্যা কেটে গেল তবুও কিছু মাথায় এলো না। মনে মনে ভাবতে লাগলো, পুষ্প গুচ্ছের আধার বলতে কি ওদের ফুল বাগান? কিন্তু ‘কেন্দ্রে বিরাজমান’ বলছে বটে অথচ বাগানের কেন্দ্রে অর্থাৎ মধ্যিখানে তো কিছুই নেই, ফাঁকা শুধু জমি। আর কাঠের মেঝে সত্যিই তো ওদের বাড়িতে নেই… কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি…মনে মনেই সুমিত বলতে লাগলো।
রাতে অঙ্কিতা ফোন করলো,
“কিরে ফেলুদা, কাজ কতদূর এগিয়েছে?”
“নারে!! কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি তার উপরে এতেও ২নং লেখা ‘সুজাউদ্দৌলা’… শুধু সিরাজউদ্দৌলার কথা মনে আসছে বারবার, আমি পারবো না, আমার দ্বারা সম্ভব নয়, হবে না…”
“ও হ্যালো, ইউ আর দা মোস্ট ইনটেলিজেন্স গায় এভার,
ওকে? আগের দুটো কে পারলো শুনি? আমি তো হজবরল হয়ে গিয়েছিলাম, তুই পারবি। আমার পুরো বিশ্বাস আছে, তোর উপরে আর তোকে পারতেই হবে। আমার বাবার শেষ খামখেয়ালি কি বলতে চেয়েছে খুঁজে দিবি না বল?”
“আরে তুই ইমোশনাল হয়ে পড়ছিস কেন? আমি চেষ্টা করছি, সময় লাগবে ভাবতে দে।”
“ওমনি ভাও খেতে শুরু করলি? এজন্যে বাড়ে তুলতে নেই…”
“কি বললি? তুই বাড়ে তুলছিলি? আমি মানে উদ্ধার করব না কিন্তু… করলেও তোকে বলবো না…”
“আবার রাগ করে, জাস্ট কিডিং ইয়ার… আই ট্রাস্ট ইউ। আচ্ছা একটা কথা বলবি?
“হ্যাঁ,বল…”
“সকালে যখন পড়ে গিয়েছিলি, তখন তোর মনে কিস পড়ার কথা একবারও মাথায় এসেছিল?”
“পুষ্পগুচ্ছের আধার কেন্দ্রে বিরাজমান, আমায় ভাবতে হবে, তোর উল্টোপাল্টা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। চল টাটা, গুড নাইট।”
শয়তান কোথাকার, গুড নাইট।”
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে কি একটা সার্চ করছিল সুমিত, হঠাৎ চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো আর সেই পরিচিত মুখ চওড়া হাসি।
অঙ্কিতাকে মেসেজ লিখলো “মিসিং লিঙ্ক পেয়ে গেছি”।
অঙ্কিতা সাথে সাথে কলব্যাক করে,”কি মানে উদ্ধার করলি বল…”
“বলছি বলছি…মেঝে বলতে আমরা যে মেঝে বুঝি তা ছাড়াও আর একটা মানে হয়, ইংরেজি টেবিলের বাংলা অর্থ মেঝে, আর ‘আধার’ মানে পাত্র আর ‘পুষ্প ‘মানে ন্যাচারালি ফুল অর্থাৎ ফুলের আঁধার ফুলদানি। কেন্দ্রে বিরাজমান বলতে কেন্দ্র অর্থাৎ সেন্টার এবং মেজে বলতে টেবিল।
“কাষ্ট মেঝে, পুরাতন অক্ষয়
পুষ্প গুচ্ছের আধার, কেন্দ্রে বিরাজময়”
শব্দ পাঠের পুরনো কোনো সেন্টার টেবিলে দেখ একটা ফুলদানি পাবি, দেখতো কিছু পাস কিনা”
“আউটস্ট্যান্ডিং! দাঁড়া দাঁড়া বসার ঘরেই একটা ইজিপ্সিয়ান কাঠের সেন্টার টেবিলে ফুলদানি আছে, ওটা নেপাল থেকে আনা…হ্যাঁ পেয়েছি,এতেও একটা লাল কার্ড আছে। ছবি পাঠাচ্ছি ওয়েট বলে ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে দিল সুমিতকে।

15145156891979620

৩. আসাদ জং

অঙ্কিতা বলে উঠলো,
“এটা তো সম্পূর্ণ আলাদা রে, শুধু নিচের লেখাটার ক্রমানুযায়ী রয়েছে ৩নং। একে ‘মাতামূলমূলক’ এটা ‘আসাদ জং’ আর কালকের টায় কি যেন সিরাজউদ্দৌলা…”
“আজ্ঞে না, সুজাউদ্দৌলা”
“সে যাই হোক কিন্তু এই সংখ্যাগুলোর মানে কি?এতো কঠিন হয়ে ক্রমশ… রহস্য জট পাকাচ্ছে…”
“ফেলুদা কি বলতো মনে নেই?’রহস্য যদি জাল না বিস্তার করে তবে ফেলু মিওিরের মস্তিষ্ক পুষ্ট হয় না”
“তবে মিস্টার ফেলুদা, আমাকে আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কোড বানাবেন?”
“তুই হবি ব্যোমকেশের সত্যবতী, এখন রাখ এটা ভাবতে রে, আমি একটু ন্যাশনাল লাইব্রেরী থেকে ঘুরে আসছি।”
পরদিন রবিবার অঙ্কিতার কাকা বাড়িতে রয়েছে। সুমিত সকালে উপস্থিত এবং হাবভাব দেখে অঙ্কিতার বুঝতে দেরি হলো না পাজেল ক্রাকড।
কাকিমা চা দিয়ে গেল, সুমিত অঙ্কিতাকে বললো মন দিয়ে শোন,
১. মাতামুল মুলক এর অর্থ Gurdian of the country বা রাষ্ট্রের কর্তা।
২. সুজাউদ্দৌলা এর অর্থ Hero of the state বা রাষ্ট্রের নায়ক।
৩. আসাদ জং এর অর্থ lion in war বা যুদ্ধের সিংহ।
আমি প্রথমেই যদি একবার গুগলে এগুলো সার্চ করতাম তাহলে পাঁচঘন্টা ধরে লাইব্রেরীতে মুখ গুজে থাকতে হতো না।”
“সে তো বুঝলাম কিন্তু এগুলোর মানে কি?”
“এগুলো উপাধি বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানের…”
সাথে সাথেই অঙ্কিতার কাকা বললো “কি”?
“আরে হ্যাঁ, সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানের…”
সাথে সাথেই অঙ্কিতার কাকা বললো “কি”?
“আরে হ্যাঁ, সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান ছিলেন বাংলার একজন নবাব। তিনি মুর্শিদকুলি খানের কন্যা জয়নব-উন-নিসা ও আজমত-উন-নিসা বেগমকে বিয়ে করেছিলেন। তার তৃতীয় স্ত্রীর নাম দুরদানা বেগম সাবিহা।৩০শে জুন ১৭২৭ সালে তার শশুর মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তিনি নবাব সিংহাসনে আরোহন করেন। এবং ওই উপাধি গুলো মুঘল সম্রাট নবাবকে দেন, সাথে অনেক উপহার সামগ্রী ও উপঢৌকন হিসেবে দেন। কিন্তু আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এ বিষয়ে আপনি কিছু আলোকপাত করতে পারেন… আপনি কিছু জানেন? কাকু কি কিছু বলে গিয়েছিলেন?”
“ইন্দ্রনীল তো মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগেই একটা আংটি নিয়ে এসেছিল হীরে, চুনি, নীলা, পোখরাজ আরো কত কি বসানো অসাধারণ দেখতে সেই আংটি,ওর অ্যান্টিকের দোকানেই একজন দিয়ে যায় কম দামে পরে ইন্দ্রনীল আংটিটার আসল মূল্য জানতে পেরে লোকটার আর হদিশ পায়নি, তারপর থেকেই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল ও,এর আগেও ওর দুটো অ্যাটাক হয়েছিল, কিন্তু এবারে আর ধরে রাখতে পারলাম না…”
অঙ্কিতা বলে উঠলো,”তুমি জানতে আংটির কথা? আমায় তো বাবা কিছু বলেনি…”
সুমিতকে অঙ্কিতার কাকা বললো,”তুমি আর কি জানো নবাবের সম্পর্কে? তুমি বলো তাহলে আমার বলতে সুবিধা হবে…”
তুমি তো একটা বই তুলে হাতে তাল দিতে দিতে নাটকীয় ভঙ্গিমায় ফ্লোরে পাইচারি করতে করতে বলতে শুরু করল।
“সরাসরি উত্তরাধিকারী না থাকায় মুর্শিদকুলি খান তার নাতি সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ খানকে সিংহাসনের জন্য মনোনীত করেন। এদিকে মুর্শিদকুলি খান ১৭২৭ সালে মারা যান ও সরফরাজ খানের সিংহাসন লাভের উপক্রম হয়।
ওদিকে সুজাউদ্দিন ছিলেন উড়িষ্যার সুবেদার ও তার ডেপুটি ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। মুর্শিদকুলি সাধারণত সুজাউদ্দিনের জনগণের জন্য গৃহীত সর্বব্যাপী নীতি কে সমর্থন করতেন না। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন সরফরাজ খানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয় তখন সুজাউদ্দিন নিজ পুত্রের অধীনে চাকরি করতে বিরক্ত ছিলেন। আলীবর্দি খাঁ ও তার ভাইজি, সুজাউদ্দিনকে বলেন এই পদের জন্য তিনি সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি। আলীবর্দি খাঁ ও হাজির সাহায্যে সুজাউদ্দিন সিংহাসন দখলের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এছাড়াও তিনি মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ-এর সাহায্য পেয়েছিলেন, সম্রাট তাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলার নবাবদের রাজধানী মুর্শিদাবাদের দিকে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে গমন করেন। পরিবারের মধ্যে কলহ এড়ানোর জন্যে তখন মুর্শিদকুলি খানের স্ত্রী বৈঠক করেন ও সরফরাজ খান পিতা সুজাউদ্দিনকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সিংহাসনে বসতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৭২৭ সালের আগস্টের দিকে সুজাউদ্দিন পরিপূর্ণভাবে সিংহাসন লাভ করেন ও বাংলার দ্বিতীয় নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
সুজাউদ্দিনকে সমর্থন করার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি মুঘল সম্রাটের কাছে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন পাঠান। মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ পরিবর্তে তাকে মুতামল মূলক(দেশের কর্তা), সুজাউদ্দৌলা (রাষ্ট্রের নায়ক) ও আসাদ জং (যুদ্ধের সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়াও মুঘল সম্রাট তাকে বিভিন্ন দামী উপঢৌকন দিয়ে সম্মান জানান।”
অঙ্কিতা সুমিতকে থামিয়ে বললো,”১৭২৭ এর ইতিহাস খুলে বসে আছিস এখন, এগুলোর সাথে কি সম্পর্ক এর?”
সুমিত বলে উঠলো,”সম্পর্ক আছে, আর সেটা কাকা এখন বিস্তারিত বলবেন। আর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করি সেটা ভুলে যাস না, যদিও উইকিপিডিয়াতে সব পেয়ে যাবি।”
অঙ্কিতার কাকা শুরু করল,
“১৭২৭ সালের দিকে নাদের শাহকে নিয়ে একটি উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সুজাউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মৃত্যুভয়ে তিনি তার পুত্র ওর দুরদানা বেগমকে উড়িষ্যা পাঠিয়ে দেন। এই সময় এক আয়ুর্বেদ চিকিৎসক তাকে সুস্থ করে তোলেন, নবাব খুশি হয়ে নাকি ওই আংটি চিকিৎসকে দেন। তবে শরীর সুস্থ বেশিদিনের জন্য হয়নি, এছাড়াও তিনি সরফরাজ খানকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। তিনি সবসময় সরফরাজ খানকে হাজী আহমেদ, আলম চাদ ও
জগতশেঠের উপদেশ মেনে নিতে বলতেন যদিও সরফরাজ তাদের পছন্দ করতেন না। ২৬শে আগস্ট ১৭৩৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বংশ পরস্পরাই ওই আংটি ওই ভদ্রলোকের কাছে ছিল এবং তারপর ইন্দ্রনীলের হাতে আসে, এখন কোথায় রেখে গেছে তা বলতে পারি না।”
“তার মানে ‘অনামা’র ঐশ্বর্য অর্থাৎ এই সেই আংটি?”
“একদম ঠিক তাই হবে সেটা পেতে এই নম্বর গুলো রহস্য উন্মোচন করতে হবে, তার আগে খেতে হবে পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।”
কাকিমা বললো,”খাবার রেডি, যদি গোয়েন্দাগিরি শেষ হয়ে থাকে তবে আহার গ্রহণ হোক”।
অঙ্কিতা বিছানায় শুয়ে একটা নোটপ্যাড নিয়ে বললো,
“আমি 1=A, 2= B, 3= C… ধরে করার চেষ্টা করেছি হয়নি, কোন মানেই আসেনি”
“তুই ঠিকই যাচ্ছিলি কিন্তু গন্ডগোল করলি শুরুতেই, যদি এভাবে চলে তাহলেও তো 1 থেকে 9 অর্থাৎ A থেকে I এর মধ্যেই চলবে,1514515681979620 এমন ছিল আর যদি 1 আর শেষের 2টা কে A অথবা B না ধরে এমন ভাবলে কেমন হয়?”বলে অঙ্কিতার কাছে এসে নোটপ্যাডে লিখলো

15 14 5 15 6 8 9 19 7 9 6 20

“এবার তোর নিয়ম অনুযায়ী 15 মানে কত নাম্বার অ্যালফাবেট?”
“O”
“আর 14এর?”
“N”
“এভাবে পরপর কি হচ্ছে?”
“ONEOFHISGIFT… ভাঙলে one of his gift”
“এখানে his বলতে নবাব সুজাউদ্দিন এর কথা বলেছে যেটা আমরা আগে জেনেছি, কিন্তু কোথায় সেটা লেখা নেই, হয় উনি পরে লিখতেন, লেখার আগেই আকস্মিক মৃত্যু হয় না হয় মৃত্যু কালে কিছু বলে গেছেন যাতে আমরা খোঁজ পেতে পারি…কিছু বলেছিল কি মনে কর”
“আমায় বলেনি,বলার পরিস্থিতিতে ছিল না বাবা, আমি সেই দৃশ্য কখনো ভুলবো না। হয়তো লিখে বোঝানোর চেষ্টা করত তাই টেবিলের দিকে আঙ্গুল করে শুধু “দে…দে” বলে কিছু চাইছিল, হয়তো টেবিল থেকে প্রেম চাইছিল কিন্তু আমি কখনো এমনটা হবে ভাবিনি, আমি ভাবতেই পারিনি বাবাও আমায় ছেড়ে চলে যাবে…”
সুমিত অঙ্কিতাকে জড়িয়ে বুকে টেনে নিল,”ডোন্ট ওয়ারি এভরিথিং উইল বি অলরাইট। আমি আছি তো, কাকু কাকিমা আছেন। এখনো রহস্য সমাধান বাকি… তুই হবি তো, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”
“যাহ্ পচা ছেলে, আমি তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হবো না, বল আগে আইসক্রিম খাওয়াবি?”
সুমিত অঙ্কিতার কপালে একটা স্নেহের চুম্বন এঁকে বলল,”চল আইসক্রিম খেতে”।
সুমিতের মাথায় তখন ঘুরছে যে কাকু কি লিখে বোঝাতে চেয়েছিলেন? আদৌ পেন চেয়েছিল নাকি অন্য কিছু? যদি অন্য কিছু হয় তবে কি?
রাস্তায় আইসক্রিম খেতে খেতে সুমিত অঙ্কিতাকে বলল,”তোর বাবা যে টেবিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে কিছু চাইছিল সেখানে একটু ভালো করে দেখবি তো কিছু রহস্যজনক দেখলে আমায় বলিস, আমার মনে হয় কাকু সবকটা ধাঁধা কমপ্লিট করে যেতে পারেনি বলে কিছু ক্লু দিতে চেয়েছিলেন।”
“আরে দেখেছি কিছু নেই তেমন, তখন ঘর রং হচ্ছিল তাই আসবাব সরানো ছিল, সবে ওদিকটায় রং কমপ্লিট হয়েছে ওমনি সোকেস আর টেবিলটা রাখা হয়েছে, এমনকি কিছু গোছানোও তখন ছিল না, বইপত্র,পেন, খাতা এসব অগোছালো ভাবে টেবিলের ওপর ছিল।”
“তবুও দেখিস আবার ভালোভাবে,যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো…”
অঙ্কিতা বাধা দিয়ে বলে “হ্যাঁ আই নো আই নো, অমূল্য রতন, তাইতো? বেশ তাই হবে।”
সেদিন রাতে সুমিতের কিছুতেই ঘুম আসছে না, ছাদে উঠে সিগারেট ধরিয়ে দূরে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিসব। বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘরের দিকে মুখ ঘোরাতেই দরজার পাশের দেওয়ালে দূরের ল্যাম্পপোস্টের আসা আলোয় সুমিত নিজের ছায়া দেখতে পেল আর বিদ্যুৎগতিতে সারা গায়ে শিহরণ জেগে উঠলো, এবং ঠোঁটের কোণে সেই চেনা হাসি।
পরদিন সকালেই অঙ্কিতাকে ফোন করে কাকাকে অফিসে যেতে বারণ করল সুমিত, বললো হয়তো রহস্যের সমাধান আজই হবে তাই সেটা সকলের সামনে হওয়া উচিৎ। এই বলেছে অঙ্কিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
বাড়িতে তখন উৎকণ্ঠার পারদ চরমে, যবনিকা পতনের আগে যেমন নিস্তব্ধ থাকে ঠিক তেমনি সব চুপচাপ বসার ঘরে বসে আছে অঙ্কিতা, কাকা আর কাকিমা। অঙ্কিতা বলল,
“তুই কি খোঁজ পেয়ে গেছিস আংটি কোথায় লুকানো আছে?”
“বলতে পারিস ৯৯ শতাংশ আন্দাজ করতে পেরেছি, তবে এক শতাংশ রিস্ক থেকেই যায়, আমি তো আর ফেলুদা ব্যোমকেশ নই..”
“তুই হেঁয়ালি না করে বলনা…”
কাকু কাকিমা দুজনেই একসাথে বলে উঠল,”হ্যাঁ সুমিত, তুমি জানলে বলো এক্ষুনি”
কাকিমা আর‌ও বললো,”আমি আর সাসপেন্স ধরে রাখতে পারছি না, এ বাড়িতেই এত কিছু রহস্য দেখব ভাবিনি, তার ওপর চোখের সামনে রহস্য উন্মোচন হবে ভেবেই কেমন যেন একটা হচ্ছে..”
সুমিত অঙ্কিতাকে জিজ্ঞেস করল,”বলতো কাকুর মুখে তুই লাস্ট কোন কথাটা শুনেছিলি?”
“কিছুই না শুধু টেবিলের দিকে আঙ্গুল করে ‘দে..দে..দে..’বলে কিছু চাইছিল”
সুমিত বলতে শুরু করল,
“দে মানে যে কিছু চাইছে এমনটা ভাবা বোকামি, দে হয়তো কোন শব্দের অদ্যক্ষর। আর ‘হয়তো’ না, এটা আমার মন বলছে দে মানে আসলে টেবিল যেদিকে আছে অর্থাৎ পূর্বের দিকের দেওয়াল। মেঝে তে পড়ে গিয়েছিল আর কাকু তোলার চেষ্টা করছিল আর সেজন্যেই হাতটা বেশি উঁচুতে ওঠেনি তাই তোরা টেবিল ভেবেছিলি।”
বলেই ওই টেবিলের দিকে গিয়ে টেবিল আর সোকেসটা টেনে সরিয়ে পুলিশি কায়দায় আঙ্গুলের পিছন দিকে নক করার মত গোটা দেয়াল জুড়ে দেখতে লাগলো। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেওয়ালের মাছ বরাবর আঙুলের ভারী মৃদু ‘ঠক ঠক’ শব্দ আচমকাই তীব্র তীক্ষ্ণ ‘টক টক’ শব্দে পরিণত হলো।”
সুমিত “ইউরেকা” বলে চেঁচিয়ে উঠে একটা হাতুড়ি আর ভারী জিনিস চাইল। কাকু হাতুড়ি নিয়ে এসে সুমিতকে দেওয়ার পর দেওয়ালের ফাঁপা অংশটায় জোরে জোরে ঘা মেরে প্লাস্টারটা ভাঙতে থাকল। গোটা ইটের চেয়ে বেশি কিছু জায়গা জুড়ে ভিতরটা ফাঁকা এবং ছোট লাল রাজকীয় ধাঁচে বাক্স আবিষ্কার করল সুমিত। বাক্সটা নিয়ে ঘরের মধ্যিখানে এলো সুমিত, সুমিতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বাকি তিনজন। সুমিত বাক্সটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল বাংলা নবাব সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানের মোগলদের থেকে পাওয়া হিরে ও অন্যান্য পাথর বসানো অসাধারণ আংটি।
কাকু বলে উঠলো,”ব্রাভো! ব্রাভো ইয়ং ম্যান, তুমি পেরেছ..”
অঙ্কিতা আংটিটি নিয়ে বলল,”এত অনেক মূল্যবান, কি সুন্দর কাকিমা দেখ”
কাকু আংটিটা নিয়ে বলে “প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো আংটি এর মূল্য হয় না, অমূল্য।”
অঙ্কিতা সুমিতকে জড়িয়ে বলে উঠলো “অল ক্রেডিট গোজ টু ডিটেকটিভ মিস্টার সুমিত সেনগুপ্ত‌ওওওও”

চা, জল খাবার খাবার পর ওরা দুজনে অঙ্কিতার ঘরে ঢুকলো। সুমিত বলল,”তা অ্যাসিস্ট্যান্ট মশাই, এই যে লাল কার্ডের রহস্যভেদ করলাম, আমার পারিশ্রমিক?”
“পারিশ্রমিক… একটা সিগারেট। তবে আজ তোকে উত্তরটা দিতে হবে যেটা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সত্যি বল সেদিন তোর ইচ্ছে হয়নি আমাকে চুমু খাওয়ার যেদিন আমার উপর পড়ে গেলি?”
সুমিত বলল,”জানি না”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *