গল্পের জোনাকিতে স্মরজিৎ দত্ত

অভাগাদের বাবা
বাগবাজারের সম্ভ্রান্ত জমিদার বাড়ির ছেলে সৌমেন। তবে জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও ব্যতিক্রম ছিল সৌমেন। সৌমেন ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম। আরম্বর, বিলাসিতা ওকে যতনা টেনেছে; তার থেকে বেশি টেনেছে ওই রাস্তার ফুটপাতে ছেলেমেয়েগুলো। বাড়িতে খেতে দিলে লুকিয়ে দুটো রুটি নিয়ে ছুটে যাবে সে ওই পাড়ার রিংকি, মুকুল,পুতুল ওদেরকে ভাগ করে দেবার জন্য। এর জন্য ওকে অনেক ঝড় পোহাতে হয়েছে বাড়িতে। তবে ওর পাশে নিঃশব্দে নিশ্চিত ভাবে যে প্রতিনিয়ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সে সৌমেনের মা তপতী। তপতী গরিব ঘরের মেয়ে জমিদার বাড়ির ছেলে তাকে পছন্দ করে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। তবে এখন আর সেই জমিদারি তাদের নেই কেবল এলাকায় জমিদারবাড়ি হিসেবেই পরিচিতি রয়ে গেছে।
সৌমেন তাদেরই বাড়ির ছেলে।সে বিএ পাস করেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। তবুও শিক্ষার মানদন্ড কে উঁচিয়ে সে হতে চায়নি ব্যারিস্টার, হতে চায়নি উকিল, হতে চায়নি ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা ডাক্তার। মনে তার একটাই বাসনা সে সমাজসেবী হবে। বাবা কৌতুক করে তাকে বলেছিল সমাজসেবীর তো কোন পেশা হয়না। তবে তুই কি করবি? ভ্যাবাগান্ডা হয়ে ঘুরে বেড়াবি? মুচকি হেসে সৌমেন বলেছিল বাবা আমার খাবারের তো অভাব নেই। আমি যে শিক্ষা গ্রহণ করেছি সেই শিক্ষা আমি ওই রাস্তার ছেলে পেলে গুলোকে বিলিয়ে দেব। ওদেরকে কিছু দিয়ে মানুষ করতে যদি পারি! ওদেরকে নিয়ে যদি আমি একটু বড় কিছু ভাবতে পারি! তাতে তুমি আমার পাশে দাঁড়াবে না? সেদিন বাবা কেন জানি ছেলের কথায় মনে মনে খুব খুশি হলেও প্রকাশ্যে বলেছিল শুনতে ভালো লাগে, করা বড় কঠিন। বেশ,তুমি এগোও আমি চেষ্টা করব।
সেদিনই জন্ম দিয়েছিল সৌমেন “ওম ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন”। জমানো পয়সা থেকে বাবাকে না জানিয়েই সে প্রতিষ্ঠা করেছিল এই ট্রাস্টের। যদিও মা জানতো। আর সকলের অলক্ষ্যে যে তার হাতে হাত মিলিয়েছিল সে তমালী। তমালী ওকে ভালবাসে। একই ইনভারসিটির একই বিভাগের ছাত্র ছাত্রী ওরা। নিজেদের খাবার পয়সা বাঁচিয়ে তারা কখনও কেক অথবা রুটি অথবা ভাত অথবা ছোট ছোট মিল প্যাকেটে করে বিলি করে বেড়ায় এই রাস্তার ছেলেগুলোকে। তাতেই ওদের আনন্দ। কদিন আগেই বেশ বড় করে উদঘাটন করেছে ওদের অফিসের। যদিও ফাউন্ডেশনের জন্ম হয়েছে বেশ কবছর আগেই। শুরু করেছিল ওরা দুজন। আজ ওদের জনসংখ্যা পঞ্চাশ পার করেছে। ওরা সবাই সৌমেনের পাশে আছে। আর রাস্তার ঐ ছেলে মেয়েগুলো যারা, সারা দিনের মধ্যে তিন দফায় অথবা চার দফায় প্রতীক্ষায় থাকে ; ওদের সকলের অঘোসিত বাবা; সৌমেনের জন্য ওরা প্রতিক্ষায় থাকে। থাকে কারণ সৌমেন সকালে আসবে ওদের প্রাতরাশ দিতে, দুপুরে আসবে ওদের দুপুরের খাবার দিতে, সন্ধ্যায় আসবে ওদের সন্ধার টিফিন দিতে, রাতে আসবে সে রাতে ঘুমোবার আগে শেষ খাবারটা দিতে।
ওদের একজন আজ বড় অসুস্থ তাকে নিয়ে ছোটাছুটি করেছিল সারাদিন সৌমেন। কিন্তু বাকিদের খাবার! সেই খাবার বন্ধ হয়নি। তমালী দুদিক সামলেছে; সেইই সকালে, দুপুরে, রাতের খাবার দিয়েছে। হঠাৎ একটি ছোট্ট ছেলে সে কিছুতেই খেতে বসলো না। প্রাতরাস দুপুরের খাবার কোনটিই খেল না সে। তমালী তাকে অনেক বোঝালো, তবু সে বলল না যে সে খাবে বা খিদে পেয়েছে। হঠাৎ এমন ব্যাতিক্রমে তমালী ঘাবরে গেল। তমালী তাকে কোলে নিয়ে আদর করে, জিজ্ঞাসা করল বাবা তুই খাবি না কেনরে? সে কেঁদে বলল আমার বাবা খায় নি, আমি খাব কি করে? অনেক চেষ্টাতেও তমালী সফল হল না।
শেষে তাকে নিয়ে অসুস্থ ছেলেটিকে নিয়ে সৌমেন যে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল, সেখানেই নিয়ে যেতে হল ওই ছোট্ট শিশুকে। সেখানে গিয়ে তার বাবার মুখে ছেলেটি নিজে গিয়ে কিছু খাবার মুখে গুঁজে দিল। সৌমেন তাকে কোলে উঠিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলল; বলল আমি বাবা হই নি ঠিকই। তবে আমার বাবা হওয়ার সাধ মিটে গেছে এই অসহায় গুলোকে নিয়ে চলতে গিয়ে। ঈশ্বরের কাছে হাত তুলে শুধু ভিক্ষা চাইল সৌমেন; ঈশ্বর! আমি যেন এদের বাবা হয়েই থাকতে পারি। অন্তত এদেরকে যেন দুবেলা দুটো খেতে দিতে পারি।
এ খবর কোনভাবে মিডিয়া মারফত পৌঁছে ছিল সরকারপক্ষের কাছে। সেখান থেকেই এই সংস্থার জন্য বিশেষ উপঢৌকন এসেছে; ওই রাস্তার পথশিশুদের সেবার জন্য। আজ সেই অনুষ্ঠানের দ্বার উদঘাটন করতেই এসেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সাথে বেলুড় মঠের বড় মহারাজ। সৌমেনের বাবা, সৌমেনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” আমি কোনদিন তোকে খুব রসিকতা করেছিলাম, তোর এই সমাজসেবাকে নিয়ে। আজ আমার সেই অহংকারকে তুই ভেঙ্গে দিলি। আমাদের শ্যামবাজারের একটি বাড়ি তোর এনজিওকে আমি দান করলাম”। সেখানেই এই পথ শিশুদের আশ্রম হবে। যার দেওয়ালে লেখা থাকবে ওম ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন।