গল্পে সুমন দে

ভীতুরাম শান্তনু
আজ কোচিং ক্লাসে গিয়ে কিছুতেই শান্তিতে পড়াতে পারল না শান্তনু। বড্ড অস্থিরতা কাজ করছে মনের ভিতর। রিস্ট ওয়াচটা বারবার চেক করতে থাকলো। যথারীতি ছাত্র-ছাত্রীর দল পড়ার পাট চুকিয়ে মাছের বাজার বসিয়ে ফেললো। সেদিকে নজর পড়তেই শেষবারের মতো রিস্ট ওয়াচটা এক পলক দেখে নিয়ে রাগ দেখিয়ে শান্তনু বললো_”তোদের আজ এই পর্যন্ত থাক, বাকি পড়া পরের ক্লাসে নেবো। আজ যা ছুটি”। ছাত্র-ছাত্রীর দল উল্লাসে তল্পিতল্পা গোছাতে লাগলো।
হোয়াইট বোর্ডটা গায়ের জোরে ডাস্টার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলে ঢগঢগ করে আধ বোতল জল শেষ করে টেবিলের পাশাপাশি রাখা মোবাইল ফোন আর ডাস্টারের মধ্যে ডাস্টারটা তুলে বুকপকেটে গুঁজে বেরোতে উদ্যত হলো শান্তনু। হঠাৎ এক ফাজিল ছাত্রের মন্তব্য উড়ে এলো,”স্যার, মোবাইল ফোনটা কি OLX এ বেঁচে দেবো?”বাকি পড়ুয়া সব হো হো করে হেসে উঠলো। নিজের নির্বুদ্ধিতায় ফিক করে হেসে ডাস্টারটা রেখে মোবাইলটা বুক পকেটে গুঁজে নিয়ে বেশ স্বাস্থ্যবান, এক্সট্রা মেদ যুক্ত চেহারাটা নিয়ে থপাস থপাস করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো শান্তনু।
গাজীপুর মেইন রোডে উঠতেই বুক পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা শ্যামা সঙ্গীতের সুর তুলে ঘ্যানঘ্যানিয়ে উঠলো। একবার হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে… তোমার কর্ম তুমি কর মা’তেই রিংটোনের অন্ত করে ‘লোকে বলে করি আমি’ প্রথা মেনে ভয়মিশ্রিত কন্ঠে “হ্যালো” বলে উঠলো। ওপার থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে সুস্মিতার প্রশ্নবাণ হুড়মুড়িয়ে এলো।
হ্যাঁ, তুমি কোথায় এখন? বেরিয়েছে তো? মেইন রোডে জ্যাম আছে কি? আর হ্যাঁ সত্যনারায়ণ ভান্ডার থেকে নলেন গুড়ের রসগোল্লা নিতে ভোলোনি তো?
শান্তনু মনে মনে উত্তর সাজাচ্ছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ পুনরায় আগত পরপর আরো কয়েকটা নতুন প্রশ্নে শান্তনুর সবটা কেমন সত্যনারায়ণ পূজোর সিন্নির মতো ঘেঁটে গেলো। শান্তনুকে কোনরকম সুযোগ না দিয়েই সুস্মিতা বলতে থাকলো।
“বাবা, কিন্তু এককথার মানুষ। উল্টোসিধে কিছু বলবে না।”মা, পিসিমণি, দাদুভাই সবাই অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি এসো। আর হ্যাঁ ফর্মাল পোশাকে আসবে… আচ্ছা আমি রাখলাম।” শান্তনু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও আটকে গেলো ঠিক যেন নাক সুরসুর করে প্রবল জোরে হাঁচি দিতে গিয়েও কোন কারনে হাঁচিটা হলো না। তেমনই সুস্মিতা ফোনটা রাখতে গিয়েও রেখে দিল না। শেষ প্রশ্নটা করেই বসলো,”এই এই, আমার বাড়ির ঠিকানাটা মনে আছে তো তোমার? শান্ত গলায় শান্তনু বললো,”আর কোনও প্রশ্ন থাকলে করে নাও। তারপর বলছি”।
হঠাৎ কি জানি সুস্মিতার রাগটা সপ্তমে চড়ে বসলো। রেগে গিয়ে বলল,”তোমায় সত্যিই কিছু বলার নেই?”সভয়ে অস্ফুট স্বরে শান্তনু বলল,”তোমার বাড়িতে গিয়েই না হয়…” শান্তনুকে আর কিছু বলতে না দিয়েই সুস্মিতা সেন ফোনটা কেটে দিলো। তখনই শান্তনুর মনটা খচখচ করে উঠলো, কি যেনো একটা বলার ছিল?কি কি কি??? নাহ্ মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ সঞ্চার না করে শান্তনু অটো স্ট্যান্ডে গিয়ে রাজপুর গামি একটা অটোয় চেপে বসলো। অটোয় বসে থাকাকালীন কোন এক পরিচিত কন্ঠে নিজের নামটা শুনে একবার অটো থেকে মুখ বাড়ালো শান্তনু। নাহ যতদূর চোখ যায় কাউকেই তো দেখলো না। তাই আগাপাশতলা না ভেবে মনের ভুল বলেই চালিয়ে দিল।
বছর সাতাশের খুব সাদামাটা, নারকেল তেল মেখে পেতে চুল আঁচড়ানো পাতি স্কুল মাস্টার শান্তনু কোনদিন ভেবেছিল কি একালের সুচিত্রা সেন রুপি সুস্মিতা সেন তার গার্লফ্রেন্ড হবে? রুপে গুনে কোনোটাতেই সুস্মিতার সাথে খাপ খায় না শান্তনুর। সুস্মিতা যেমন সুন্দরী, তেমনি সুমিষ্ট গানের গলা। শান্তনু যেখানে ঝোড়াকাক বটে। সুস্মিতাকে পটানোর মনোবাসনা কোনদিনই শান্তনুর ছিল না। কর্মসূত্রে আলাপ। কে জানে কি দেখে ক্লাসিকাল সংগীত শিল্পী সুস্মিতার শান্তনুকে মনে ধরলো।সে যাই হোক ওদের বছর দেরেকের চেনা পরিচয়ে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুজনের জীবনটা এক সুতোয় বাঁধবে। তাই সুস্মিতার কথামতো আজ প্রথমবার সুস্মিতার বাড়িতে যাচ্ছে শান্তনু। যদিও সুস্মিতার বাড়ির লোক আর শান্তনুর বাড়ির লোকের মধ্যে কথাবার্তা একপ্রকার পাকা হয়ে গেছে বললেই চলে। ওদের কথা অনুসারে, মিয়া বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজী??
ঝড়ের বেগে ধেয়ে চলা অটোর ধারে সিটে বসেও শান্তনুর কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়লো। শার্টের কলারটা যেনো গলাটা টিপে ধরছে ক্রমশ। মোবাইল ফোনটা বিকট শব্দে অ্যালার্ম বাজিয়ে জানান দিল সময় এখন সন্ধ্যা ছটা। অন্য দিন এই সময়ে আর একটা ব্যাচ পড়ানো থাকে শান্তনুর, আজ স্কুল যাওয়ার সময়ের ঘন্টা দেড়েক পূর্বে বেরিয়ে সে পর্ব মিটিয়ে তারপর স্কুল করেছে। পড়ানোর দিক থেকে ও একেবারেই ফাঁকিবাজি পছন্দ করেনা। সময়টা দেখে একটু আশ্বস্ত হলো শান্তনু। তাও ভালো ঘন্টাখানেক সময় এখনো হাতে। তার মধ্যে সুস্মিতার বাড়ি পৌঁছতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। ভাবতে ভাবতেই অটো কালিতলাতে এসে থামলো। অটোওয়ালা বললো,”দাদা,কালিতলা এসে গেছে। নেমে পড়ুন।”
ভাবতে ভাবতেই অটো কালীতলাতে এসে থামলো। অটোওয়ালা বললো “দাদা,কালিতলা এসে গেছে। নেমে পড়ুন।”
সেদিকে বিন্দুমাত্র ভূক্ষেপ না করেই শান্তনু কোন এক ভাবনায় গভীর ভাবে নিমজ্জিত হয়ে রইলো। অটোওয়ালা ব্যস্ত হয়ে খানিক উঁচু গলায় হাঁক দিল “ও দাদা???”
বেশ চমকে উঠে থতমত খেয়ে শান্তনু বললো “অ্যাঁ… আমাকে বলছেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি তো কালিতলা নামবেন বললেন?” বড়ো করে ঘাড় নেড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে শান্তনু বললো “এটাই বুঝি কালিতলা?”
অটোওয়ালা বিরক্তি প্রকাশ করে সবে কিছু বলতে যাবে ওমনি অটোর ডান পাশ থেকে গোপাল দার ভারি গলা শোনা গেল “এটা শিবতলা মহেশতলা যাই হোক তুই এইখানেই নামবি শান্তনু!”
কোচিং সেন্টারের বাংলা মাস্টার গোপাল দা বড়ো ভালো মানুষ। শান্তনুর মতো সাদামাটা ইতিহাসের শিক্ষককে নিয়ে পিছনে অনেক হাসাহাসি করলেও একমাত্র গোপালদাই সবসময় শান্তনুকে আশা-ভরসা-বিশ্বাস জোগায়। সব সময় নিজের কর্ম করে যেতে বলে।
এখানে হঠাৎ গোপাল দাকে দেখে শান্তনুর চোখ তো ছানাবড়া!
“গোপাল দা তুমি এখানে?” শান্তনু প্রত্যুত্তরে এক গাল হাসি হেসে গোপাল দা কে বললো “অটো থেকে নাম আগে ব্যাটা!”
আর কোনো প্রশ্ন না বাড়িয়ে ভাড়া মিটিয়ে অটো থেকে নেমে পরে শান্তনু। রাস্তায় খুব একটা যানজট নেই আজ। অটোটা দূর থেকে দূরান্তে মিলিয়ে যাওয়া অব্দি শান্তনু অটোর ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে থাকে,সাথে সাথে অটোওয়ালার মৃদু গজগজানি। ওর চোখের সামনে তুড়ি মেরে গোপাল দা বলে “গাজীপুর রোডে তোকে অটোতে দেখে আমি কতবার ডাকলাম! শুনিস নি?”
চমকে উঠে শান্তনু বলে “এহ হে হে!তুমিই তখন ডাকছিলে? একদম খেয়াল করতে পারিনি গো। তা তুমি একটা ফোন করলেই তো পারতে?
চোখ পাকিয়ে গোপাল দা শান্তনুর কথা রিপিট করে বলল। “এঃ ফোন করলেই তো পারতে? ফোনটা বুকে থাকলেও মনটা তো সেই সুচিত্রা সেনের বাড়িতেই!”
শান্তনু তোতলাতে তোতলাতে “মাআআনে…?” বলতে বলতে বুক পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই দেখলো স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে গোপালদার পাঁচটা মিসড কল। জিভ কেটে গোপালদার দিকে তাকাতেই গোপাল দা একটা চকচকে রঙিন কাগজের মোড়া গিফট বাক্স এগিয়ে বললো “এটা কে নেবে? তোর শ্বশুর?
দেখা মাত্রই আঁতকে উঠে প্রায় এক প্রকার হুমড়ি খেয়ে গিফটের বাক্স টা গোপালদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শান্তনু
বললো “কি সর্বনাশ!!! আসল জিনিসটাই ফেলে এসেছিলাম তো!কি কান্ড দেখো!!! ভাগ্যিস তুমি সময় মতো পৌঁছে দিলে! না হলে আজ আর রক্ষে ছিল না, সাক্ষাৎ রণচন্ডী আমাকে নজরে ভস্মিভূত করতো!”
“তুই বেরোনোর পরই তো আমি দেখলাম এটা ফেলে এসেছিস রিসেপশন রুমে। তাই তো আর দেরি না করে বাইক নিয়ে তোর অটোর পিছু পিছু চলে এলাম”।
“ধন্যবাদ দিয়ে আর ছোট করবো না গোপাল দা। সে যাই হোক আসলে কি বলি বলতো? আজকাল এত ভুলোমন টাই না হয়ে গেছি! তাই আর কি! সুস্মিতা তো জানলে আমাকে শুলে চড়াত নির্ঘাত!”
গোপাল দা বললো “সেতো বুঝতেই পারছি। তাড়াতাড়ি যা, নয়তো আজই তোকে শুলে চড়ানো থেকে কেউ আটকাতে পারবেনা!”
হাত ঘড়িটা দেখেই বুকটা কেঁপে উঠল শান্তনুর। রাম রাম!!! এইরে! সাড়ে ছটা এখানেই?
“গোপাল দা আমি আসি হ্যাঁ!একদম সময় নেই হাতে বুঝলে।”
“এখান থেকে আর একটা অটো ধরতে হবে তো?”
“হ্যাঁ দাদা”
“ঠিক আছে সাবধানে যা”
“হুমমম..”
“এই শোন!”
“কি হলো?”
“জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছিস?”
“হ্যাঁ! এই না তো!!!”
“সর্বনাশ!! গিয়েই একেবারে সটাং সুস্মিতার চরণে শুয়ে পড়ে বলে দিস!!”
কোন উত্তর না করে কেবল বোকা হাসি হেসে শান্তনু গন্তব্যে পা বাড়াতেই আবার গোপাল দার ডাক “হ্যাঁরে শোন”
“আবার কি হলো?”
“অল দ্যা বেস্ট!”
আসলে শান্তনু জানতই না আজ সুস্মিতার জন্মদিন। কালই তো সুস্মিতা ওকে ফোন করে নেমন্তন্ন করেছে আজ ওদের বাড়িতে আসার জন্য, তার সাথে ওর বাড়ির সবার সাথে পরিচয় পর্ব টাও সেরে নিতে বলেছে। তবে জন্মদিনের
নিমন্ত্রণ সেটা তো বলেনি। অনেকদিন ধরেই সুস্মিতা বলছিল ওর বাড়িতে একদিন আসার জন্য। কিন্তু শান্তনু সেদিকে কর্ণপাত না করে নিজের কাজে গলা ডুবিয়ে বসেছিল। যার কারণে কিছুটা অভিমানে আর কিছুটা কাজের ব্যস্ততায় ওদের দেখা হয়নি প্রায় মাস তিনেক। এইজন্যেই আরো বেশি করে আজকের এই নেমন্তন্ন রক্ষা করাটা শান্তনুর কাছে জরি হয়ে পড়ল। ওই আর কি রথ দেখা, কলা বেচা দুটোই হবে। যদিও আজ সকালে স্কুল যাবার পথে অটোতে বসে ফোনটা চেক করতেই ফেবুতে বার্থডের নোটিফিকেশন টা পেয়েছিল শান্তনু। আর পাওয়া মাত্রই সুস্মিতাকে ফোন করেছিল। কিন্তু তখনও গানের ক্লাস করাতে ব্যস্ত ছিল আর তারপর স্কুল থেকে বেরিয়ে গিফট কিনে কোচিং ক্লাস সেরে আর বলা হয়ে ওঠেনি। তাই একেবারে সামনাসামনি দেখা হলেই বলবে ভেবেছে।
যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব পা চালিয়ে কালিতলা অটো স্ট্যান্ডে গিয়ে শান্তনুর মনে হলো ‘নলেনগুড়ের রসগোল্লা’? আর সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার? সেতো কখন ফেলে এসেছি! বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ছারখার হয়ে গেলো। না মানে আমার সাথে কেন এমন হয়? বলবেন কেউ? রাস্তায় দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হলো শান্তনুর।আর কেঁদে কি হবে? ভাবতে ভাবতে অটো স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা গুটিকয়েক লোকজনের মধ্যে এক প্রৌঢ় কে জিজ্ঞাসা করলো “দাদা কলতলায় কোনো মিষ্টির দোকান আছে?প্রৌঢ় বললেন “কি বললেন মশাই? কলতলা? না মানে কুলতলা শুনেছি, কালিতলা শুনেছি কই কলতলা তো শুনিনি বাপু!”
পাশের আর এক ভদ্রলোক ঠাট্টার সুরে বললেন “কার বাড়ির কলতলা? আপনার না আমার?”
শান্তনুর মাথার মধ্যে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। মুখে কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে দু পা এগোতেই দেখল বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘মা কালী সুইটস’। মনে মনে একটু শান্তি পেয়ে রসগোল্লার কৌটোটা নিয়ে অটোয় চেপে বসলো। কিন্তু কোথায় যাবে তা তো জানা নেই? সবে ফোনটা হাতে নিয়েছে সুস্মিতাকে একটা কল করবে বলে। সাথে সাথেই বেজে উঠলো ‘সকলি তোমারি ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি মা…’সামনের সিটে দুটো কুল ড্রেস পরা বাচ্চা পেছনে তাকিয়ে মুখ চেপে ফিচেল হাসি হাসতে লাগল। সেদিকে লক্ষ্য করে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ফোনটা রিসিভ করতেই রাগত স্বরে সুস্মিতা বলে উঠলো “আর কতক্ষণ হ্যাঁ? সাতটা তো বাঁচতে চললো? সময়টা দেখো ভালো করে! আর তাও যদি দেখতে না পাও চশমাটা কোন ভিখারি কে দান করে দাও!”
গলা নরম করে শান্তনু বললো “আহা সুস্মিতা অন্ধের শহরে আমি কি আয়না বেচবো?”
দ্বিগুণ ঊর্ধ্ব গলায় সুস্মিতা বলল “এই আমি তোমার ছাত্রী নই, আর তুমিও আমার মাইনে দেবে মাস্টার নও, বেশি ভেজর ভেজর না করে তাড়াতাড়ি আসলে এসো! নয়তো জাহান্নামে যাও!”
“বলছি জাহান্নামটা কোনদিকে?”
“এই এই তুমি কি আমার সাথে মসকরা করছো?”
“না না!!!সেই স্পর্ধা কি আর আমার আছে? আমি তো বলছিলাম তোমার বাড়ির রোডটার নাম বলো?”
“বি.সি.রায়.রোড”
“ওটাই তো জাহান্নাম!”বিড়বিড় করে শান্তনু বলল।
“এই কিছু বললে তুমি?”
“কই না তো!”
এবারও ঝনাৎ করে মুখের ওপর ফোন কেটে দিল সুস্মিতা।
অটো চলতে শুরু করল স্লো মোশানে। শান্তনু কপালটা বার বার রুমাল দিয়ে মুছতে থাকলো। সস্তার একটা পারফিউম স্প্রে করছিল সেই স্কুল বেরোনোর সময়। তার গন্ধ তো কখন উবে গেছে উল্টে কেমন যেন বিশ্রী ঘামের গন্ধ সারা শরীরে জাঁকিয়ে বসেছে। চশমাটা খুলে বাক্সে পুরো হ্যান্ডব্যাগ টাতে চালান করে দিলো শান্তনু। সুস্মিতা বলে এই চশমাটায় ওকে নাকি ‘আদ্যিকালের বুড়ো’ মনে হয়। মনে মনে ভাবলো এ মাসের শেষেই একটা হিরোওয়ালা সানগ্লাস কিনবে। এরূপ ভাবনা চলাকালীন আবার ফোনটা সানাই বাজিয়ে উঠলো। এবার অটোর সমস্ত প্যাসেঞ্জার যে যার মতো করে হাসি গোপন করার জন্য বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলো। সেদিকে নজর যেতেই শান্তনুর মনে হল ও একাই যেন সমাজের বাইরে বাকি সব এক একটা সমাজসেবী নেতা মন্ত্রী!!! বিশেষ করে দুই স্কুলের ছাত্রের হাসি দেখে মনে মনে ছক কষল ‘যদি এরা আমার স্কুলের ছাত্র হতো না, একেবারে পিটিয়ে পেটাই পরোটা বানিয়ে দিতাম’। যাই হোক রাগ চেপে ফোনটা রিসিভ করল। “এই তুমি ঠিক অটোতে উঠেছো তো? না মানে কালিতলা থেকে এতক্ষণ লাগার কথা তো না?” তুমি এক্সাক্টলি কোন জায়গায় আছো এখন বলতো?”
“এই তুমি ঠিক অটোতে উঠেছো তো? না মানে কালিতলা থেকে এতক্ষণ লাগার কথা তো নয়? তুমি এক্সাক্টলি কোন জায়গায় আছো এখন বলতো?”
“কোন জায়গা? সেটা তো জানা নেই সুস্মিতা?”
“আরে অটো ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়!”
একবার অটো ড্রাইভারের দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে দেখে নিয়ে শান্তনু বললো “না না ওরা সব সমাজসেবী নেতা মন্ত্রী! ওদের জিজ্ঞাসা করবো কেনো?”
“তোমার কি পেট খারাপ না মাথা খারাপ শান্তনু?”
শান্তনু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ফোনের ওপার থেকে সুস্মিতা বলল “এই শোনো! তুমি যেখান দিয়েই আসছ তার চারপাশে কি দেখতে পাচ্ছ সেটাই বলো?”
“আমি তো আমার সর্বদিকেই শুধু আর শুধু তোমাকেই দেখিতে পাই সজনী!”
“তোমার সাথে কথা বলাই বেকার, জমের দখিন দুয়ারে যাও, আর তোমাকে একবারও ফোন করবো না, বেস্ট অফ লাক!”
ফোন কেটে দেয় সুস্মিতা।শান্তনু আমতা আমতা করতে থাকে।
বাকি প্যাসেঞ্জার ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে তখনও। শান্তনু ভাইব্রেট করে দিল রিংটোনটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কেঁপে উঠল ফোন। শান্তনু ধড়মড়িয়ে পকেট থেকে হাতরে ফোন বের করল। মনে মনে ভাবলো রণচন্ডী মুখে যতই বলুক কিন্তু আমায় ফোন না করে পারবেই না, আমি জানতাম। ঠিক ঠিক যে সময় ফোনটা রিসিভ করবে বলে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো ঠিক সেই সময় পাশের ভদ্রমহিলা মুচকি হেসে বলল,”আপনার ফোন ভাইব্রেট করছে!” “ওহ্!”
যাই হোক যাত্রা পর্বের ৯০ শতাংশের সমাপ্তি ঘটিয়ে শেষমেষ পাক্কা সাতটায় অটো থেকে নেমে হনহন করে হেঁটে চলল শান্তনু। বেশ অন্ধকার রাস্তাটা। সুস্মিতা বলেছিল অটো থেকে নেমে সোজা গিয়ে ডানদিকে। সেই অনুযায়ী রীতিমতো ছুটতে ছুটতে রাস্তার মধ্যে এক মহিলার সাথে ধাক্কা হতে হতে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্তনু ওনাকে বললো,”আচ্ছা মাসিমা, রণচন্ডীর বাড়িটা কোথায়?”
কোনরূপ উত্তর না পেয়ে নিজের অজান্তে মুখ ফস্কে বলা নামটা সংশোধন করে পুনরায় আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল শান্তনু,”না মানে ওই সংগীতশিল্পী সুস্মিতা সেনের বাড়ি”
মহিলা আবারও কিছু না বলেই হাতের ইশারায় সামনের দোতলার বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে নিজেও ওই বাড়ির দিকে হেঁটে চললো”তারপর বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে ওনার সাথে মেন গেট পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল শান্তনু।
বসার ঘরে পৌঁছতেই ঘর ভর্তি লোকজন দেখে শান্তনুর মুখটা শুকনো আমসির মতো হয়ে গেলো। তার চোখ তো শুধুই রণচন্ডীকে খুঁজছে। সেই সময়ই পাশের ভদ্রমহিলা যিনি বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন, যাকে দেখে শান্তনুর মাসিমা গোছের লেগেছিল সেই তিনি সামনের বয়স্ক লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বাবা এই যে এসেছেন তিনি! অবশেষে ধরা দিয়েছেন মহাপুরুষ!”
কথাটা কানে পৌঁছতেই শান্তনুর চোখ জোড়া আটকে গেলো ওই ভদ্রমহিলার ওপর। রাস্তার অন্ধকারে মুখটা ঠিক করে দেখতে না পেলেও বসার ঘরের উজ্জ্বল আলোয় চির পরিচিত সেই মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো।। মনে মনে শান্তনু বলল,”আরে এ যে সুস্মিতা! আমার রণচন্ডী! ইনিই আমার সুচিত্রা সেন!!!”
বুটিকের কাজ করা শাড়িতে কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে! চিনতেই পারেনি হায়! শান্তনুকে এমন ক্যাবলার মতো সুস্মিতার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুস্মিতার মা বললো,”তা বাবা আজকে কোনো রকম অসুবিধা হয়নি তো?”
সে আর বলতে! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়!!!(মনে মনে)
উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকা জিজ্ঞাসু কয়েক জোড়া চোখ পড়তেই বোকা বোকা হাসি দিয়ে শান্তনু মুখে বলল….”
একদম না মাসিমা! কোনরকম অসুবিধা হয়নি”
সৌজন্য মূলক হাসি হেসে সুস্মিতার মা বললো,”বসো তুমি আমি একটু চা মিষ্টি আনি”
এই হলো শান্তনুর কাছে এক বড় অস্বস্তিকর সময়, সে ওর কোনো আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব বা কলিগের বাড়ি হোক যেই না মিষ্টি করে কিছু খাওয়ার কথা বলে শান্তনুকে,শান্তনু মুখে না…না করলেও মনে মনে আগত খাবারকে সগৌরবে সুস্বাগতম করতে ব্যস্ত থাকে। এদিকে আজকে ওর তেমন কিছু দানাপানি পেটে না পড়া সত্ত্বেও এবং পেট পুজো করা তীব্র বাসনা থাকা সত্ত্বেও সৌজন্যতা রক্ষার্থে কিংবা হবু শশুর বাড়িতে নিজের হ্যাংলামো ঢাকতে লজ্জা লজ্জা মুখে বলতে থাকে “না না থাক না,ওসব তো পরেও…”ওর কথাগুলো না শুনেই সুস্মিতার মা চলে গেল ভিতরে।
শান্তনু অপ্রস্তুত হয়ে একপ্রকার সুস্মিতার দিকে তাকিয়ে তারপর উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে নেয়। তারপর হঠাৎ বসার ঘরের ফুল আর বেলুনে সাজানো পরিবেশ দৃষ্টিগোচর হতেই হাতের গিফটটা সুস্মিতার বাবার দিকে এগিয়ে একপ্রকার হড়বড় করে বলে ফেললো “হ্যাপি বার্থডে টু মাই লাভ!!!”
সুস্মিতার মা মিষ্টির প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার হবু জামাইয়ের কান্ড দেখে হেসেই কুপোকাত। সারা ঘরে হাসির রোল উঠলো। শেষে সুস্মিতার বাবা বলল “আমাদের হবু জামাই তো দেখছি বড় মনখোলা!”
সুস্মিতার বাবার মুখ থেকে “হবু জামাই” উপাধিটা পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল শান্তনু।
এদিকে সুস্মিতা ক্ষেপে বোম হয়ে গেল। তারপর আর কি? সুস্মিতার পিছন পিছন গিফ্টটা নিয়ে “ক্ষমা কর হে দেবী, হে রণচন্ডী,হে মা মঙ্গলময়ী… বলতে বলতে ছুটতে থাকলো শান্তনু….।
আমাদের আজকের গল্প সমাপ্ত হল, কিন্তু রাগী সুস্মিতা আর মনখোলা শান্তনুর প্রেমটা শুরু হলো। চলতে থাকুক ওদের ভালোবাসায় ভরা দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি।