T3 – স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় সায়ন্তন ধর

“কেমন ছিলেন অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা? (তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা কেমন ছিল…)”

বহ্নিশিখা

ইতিহাস যে শুধু জয়ীদের মনে রাখে তা নয়, যাঁদের সুতীব্র ইচ্ছে থাকে জেতার, তাঁদের পরাজয়ের পরেও বীরগাথা লেখা হয়। কারণ তাঁদের সেই পরাজয় আগামীর জয়ের অম্লজান। এভাবেই লেখা হয়ে থেকেছে অগ্নিযুগের অগ্নিপুত্রদের পাশাপাশি অগ্নিকন্যাদের যশোগাথা। কিন্তু এর বাইরেও যাঁদের কথা আমরা কোন বই, পত্রিকা বা হালের নেটদুনিয়ায় পাই না, তাঁদের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি আমাকে একটি স্বাধীন জন্মভূমি উপহার দেওয়ার জন্য।

অগ্নিযুগের বীরাঙ্গনাদের কথা বলতে গেলে উঠে আসবে মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, কল্যাণী দাস, ভাবিনী মাহাতো, দেবী চৌধুরানী, বেলা মিত্র, চামেলী গুপ্ত, কুসুম বাগদী, ফুলবাহার বিবি, বেগম রোকেয়া, বীণা দাস, কমলা দাশগুপ্ত, রাণী শিরোমণি, সুনীতি চৌধুরী, রাণী লক্ষ্মীবাই, সরোজিনী নাইডু, ম্যাডাম ভিকাজি কামা, বেগম হজরত মহল, অরুণা আসফ আলি, কস্তুরবা গান্ধী, অ্যানি বেসান্ত, কমলা নেহেরু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, লক্ষ্মী সায়গল, সুচেতা কৃপালনি, লক্ষ্মী ইন্দিরা পান্ডা, মিথুবেন পেটিট প্রমুখের নাম। আমরা কমবেশি সবাই এঁদের মহান আত্মত্যাগ, দেশের প্রতি তাঁদের জীবন উৎসর্গ করার কথা, তাঁদের বীরত্বের কথা, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লড়ার কথা অথবা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও সাংসদ বা মন্ত্রী হিসেবে সুযোগ্য প্রতিনিধিত্বের কথা জানি। কিন্তু এর মাঝেও অনেকেই আন সাং হয়ে রয়ে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে। আজ তাদের খুঁজি…

আজ আমরা আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় একশো বছরের ইতিহাসে যেসব অগ্নিকন্যা বা অগ্নিপুত্রদের পেয়েছি, তাঁদের জন্ম হয়েছে অগ্নিগর্ভে। হ্যাঁ সেই মায়েরাই তো প্রথম অগ্নিকন্যা যাঁরা তাঁদের কোলের সন্তানকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। জন্মদাত্রী মায়ের চেয়েও মহান দেশমাতৃকা… এই শিক্ষা দিয়েছেন। আজ এই মায়েরা না থাকলে তো আমরা পেতাম না প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে, ক্ষুদিরামকে বা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে। আমি সকল বিপ্লবীপ্রসু মায়েদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। এরপর আসি বিপ্লবীদের বোন, দিদি, বৌদি ও স্ত্রীদের কথায়। তাঁরাও সাধ্যাতীত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের প্রিয় ভাই, বোন, দেওর বা স্বামীকে দেশসেবার জন্য উৎসর্গ করেছেন। বিপ্লবীদের সাহায্য করেছেন পুলিশের চোখে ধুলো দিতে। আমি তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞ। তাঁরাও নীরবে, নিভৃতে অগ্নিযুগের আগুনে নিজেদের ঘৃতাহুতি দিয়েছেন অথবা স্বাধীনতার জ্বলন্ত উনুনে গুঁজে দিয়েছেন নতুন অগ্নিপ্রদীপক।

কলমকে তরবারিসম ব্যবহার করে যেমন দেশাত্মবোধকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মুকুন্দ দাস, তেমনি নারীরাও অগ্নি স্ফুলিঙ্গে শানিত লেখনীতে জাগিয়ে তুলেছেন দেশপ্রেম। যেমন:

সরোজিনী নাইডু: তাঁর কবিতায় স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ গর্জে উঠেছিল। তাঁর লেখা কবিতা “Awake!” ভারতবাসীকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে জাগিয়ে তোলে। “The Gift of India” কবিতাটি তুলে ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতের অবদান ও ঔপনিবেশিক অবিচারের কথা।

সুবর্নলতা সেন: দেশপ্রেমমূলক কবিতা ও গান লিখেছিলেন, নারীদের জাগরণের ডাক দিয়েছেন। “জাগো ভারতবাসী” গানে স্বদেশপ্রেম ও ব্রিটিশ বিরোধী আহ্বান ছিল। “স্বদেশের ডাক” শীর্ষক কবিতায় ছিল মাতৃভূমিকে মুক্ত করার আবেদন।

টোরু দত্ত: তাঁর অনুদৈর্ঘ্য জীবনকালে লিখে গেছেন একাধিক দেশপ্রেমমূলক কবিতা ও গান। “Our Casuarina Tree” আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির কবিতা, কিন্তু গভীরে দেশ ও শিকড়ের প্রতি অনুরাগ ও ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতার বেদনা রয়েছে তাতে। অনুবাদ করেছেন “Ancient Ballads and Legends of Hindustan.”

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন: প্রধানত প্রবন্ধকার হলেও, তাঁর লেখায় নারী জাগরণ ও স্বাধীনতার আহ্বান স্পষ্ট। নারীদের শিক্ষার আলোকে আনতে ও নারীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে লিখেছেন “সুলতানার স্বপ্ন” এর মতো গল্প ও “নারীর অধিকার” নামক প্রবন্ধ, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে নারীমুক্তির যোগসূত্র স্থাপন করে।

কমলা দাস গুপ্ত: বিপ্লবী কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবিতার পাশাপাশি লিখতেন গান। বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করতে যা গোপনে প্রচার হতো। তাঁর “আমার দেশ” কবিতায় রয়েছে মাতৃভূমিকে স্বাধীন দেখার অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।

লীলা নাগ: মূলত কর্মী, তবে তাঁর লেখা দেশপ্রেমমূলক কবিতা ও বক্তৃতা তরুণদের উদ্বুদ্ধ করত। নারী-পুরুষ সকলকে আন্দোলনে নামার ডাক দিয়ে লিখেছিলেন “শৃঙ্খল ভাঙো”। তিনি সুর করতেন তাঁর লেখা গানেও।

প্রভাবতী দেবী সরস্বতী: তাঁর কবিতা ও ভক্তিগীতিতে স্বাধীনতার বাণী লুকিয়ে থাকত। “জননী জন্মভূমি” গানে রয়েছে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের আহ্বান। “তপস্যার অগ্নি” সংগ্রাম ও আত্মশক্তির কাব্যিক রূপ।

এ তো গেলো কিছু উদাহরণ মাত্র। আরো কত কবি নীরবে বুনেছেন দেশপ্রেম দিয়ে কাব্য-সোয়েটার। তাঁদের নাম আর আমরা জানতে পারি না। আজ আমি একটা এমন গল্প বলবো, যা আমি শুনেছি আমার দিদার কাছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় যে সাহসীকতার কথা স্থান পায়নি। আমার দিদার মা শ্রীমতী বীণাপাণি দত্ত তেমনি একজন অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা। হয়তো তাঁকে যদি আমি কাছে পেতাম, তাহলে আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম। তবে যা জেনেছি তাও কিছু কম নয়। তাঁর সাহিত্যপ্রীতি ছিলো। লিখতেন অনেক কিছুই, তাঁর মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে কখনো পেন্সিল কখনোবা ঝর্ণা কলমে লেখা বিপ্লবীযুগের গানগুলির মাঝে টুকটাক স্বরচিত দেশপ্রেমের কবিতা কি ছিল না? এ আমার অনুমান। তাঁর পিঠোপিঠি দুই কাকা ছিলেন একাধারে ডাক্তার ও ফুটবলার। খেলেছেন মোহনবাগান ও দেশের হয়েও। উনারা স্বদেশী আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন। একবার বাড়িতে ইংরেজ পুলিশ এলো। এদিকে বাড়িতে সদ্যপ্রস্তুত বোমা রাখা। মুশকিল আসান করলেন বীণাপাণি দত্ত। পড়তে বসেছিলেন, পরনে একটি ফ্রক। সেই ফ্রকের তলায় লুকিয়ে রেখে স্বাভাবিকভাবে রইলেন। বৃটিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাঁচিয়ে দিলেন তাঁর বিপ্লবী দেশপ্রেমী কাকাদের। এমনই আরও কত গল্প বীণাপাণিদের মৃত্যুতেই হারিয়ে গিয়েছে…

অগ্নিযুগ হয়েছে অতিবাহিত। দেশ হয়েছে স্বাধীন। ভোগবাদী যুগের নারীরা স্বাধীন ভারতেও আরও স্বাধীনতা চায়। সে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর হয়ে দেখা দিয়েছে। আবার একদল মেয়ে ক্রমাগত এ সমাজে নির্যাতিত হয়ে চলেছে, মানুষ ভুলে গেছে এরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মা। আর মা-কে রক্ষা করতে না পারলে জাতি অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে যাবে।

সেই সমস্ত অত্যাচারিত মেয়ে বা উশৃঙ্খল মেয়েদের আদর্শ হোক অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা। আজ ৭৯ তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তাই তাদের উদ্দেশ্যে রইলো বর্তমানের গীতিকার আকাশ চক্রবর্তীর লেখা ও সুর দেওয়া, শতরূপ ঘোষের কণ্ঠে একটি গান…

“দেখো প্রিয়তমা আকাশে উড়ছে প্রীতিলতার নিশান,
স্বামী বা কর্তা শব্দগুলোকে করে ফেলে খানখান
চারকোল-রাঙা কপালের ভাঁজে আটকে যাচ্ছে রোদ,
একুশে মৃত্যু তবুও মেয়েটা আজও গড়ে প্রতিরোধ…
তার বাবা মাও দিয়েছিলো কিনা বিয়ের জন্য চাপ,
ইতিহাস বই ভুলে গেছে বিলকুল
তাকেও ধিঙ্গি বলেছিলো কিনা পাশের মানুষজন,
হয়তো সেটাও জানা নেই নির্ভুল…
শুধু জানি সে তো তোমার চাইতে ভীষণ আলাদা নয়,
লাজলজ্জার গয়নাগাটিতে তাকেও সাজানো হয়
তবু আজকে যখন তোমার আঁচলে পড়েছে টান,
আকাশে উড়ছে তোমার বন্ধু প্রীতিলতার নিশান…”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *