অমাবস্যার রাত্রিতে হিরণ্য ফন্দি করে আশ্রম থেকে পালাবার। অনেক চিন্তাভাবনা করার পর হিরণ্য সিদ্ধান্ত নেয় পালানোই যথাযথ কাজ। না পালালে যে তার মস্ত ক্ষতি হবে বা হতে পারে এমনটি নয় কিন্তু পালানোর মধ্যে একটা কিছু করে উঠতে পারার মানসিকতা বিদ্যমান থাকে সেটা সে মনে করে। অদ্ভূত তার এই খেয়াল। পালিয়েই সে এসেছিল এই আশ্রমে। আবার এখান থেকেও পালানোর ভাবনাটাও তার মাথায় নতুন করে উদয় হল।
বিষয়টা হল এমনই যে, হিরণ্য কোন জায়গাতেই দীর্ঘদিন থাকতে পারে না। পালানো তার কাছে এক নেশার মতো। নেশার মতো বলা বোধ হয় ঠিক হবে না, এটা তার নেশাই। তা না হলে খুব ছোটবেলাতেই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় হাওড়া ব্রীজে? বাড়ির থেকে যদিও খুব কাছেই ব্রীজ। তবু, তখন তার বয়স কতই বা আর হবে। সাত কী আট। তবু নিমতলা ঘাট স্ট্রীট থেকে ওই বয়সের একটি বালক একা একা চলে গেল হাওড়া ব্রীজে। খোঁজাখুঁজি জকরে যখন তাকে পাওয়া গেল, তখনও সে হাওড়া ব্রীজেই দাঁড়িয়ে। বাড়ির লোক তাকে লক্ষবার জিগ্যেস করেও কোন উত্তর পায়নি। শুধু চুপ করে থাকে অথবা খেতে চায়। যাক, সে কথা।
এরপর থেকে মাঝেমাঝেই এই বাড়ির লোকেদের ঘোল খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতো হিরণ্য।
সবকিছুরই একটা গা-সোওয়া ব্যাপার থাকে। একই অস্ত্র বারবার শান দিলে যেমন ভোঁতা হয়ে যায়, বহু ব্যবহারে যেমন দীন হয়ে পড়ে স্লোগান ঠিক তেমনি হিরণ্যকে নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাতো না। সবাই ধীরেধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।যদিও সবপাড়াতেই যেমন কিছু আত্মীয়স্মন্য মানুষ থাকেন, যাদের কাজই হচ্ছে সমস্যা খুঁজে সমাধানসূত্র বার করা, তারা কিন্তু বিষয়টার গুরুত্ব হারাতে চাইল না। তারা বিষয়টা নিয়ে কয়েক কিস্তি শলা-পরামর্শ করতে চাইলেন হিরণ্যের মামাদের সাথে।পরামর্শ দিলেন- চিকিৎসা দরকার।
ও হ্যাঁ,বলাই তো হয়নি ; হিরণ্য কিন্তু তার মামাবাড়িতেই থাকত।সেখান থেকেই সে পালিয়ে গেছিল হাওড়া ব্রীজে। সেই মামাদের চত্বর থেকেই সে নানান জায়গায় পালিয়েছে বহুবার। প্রথম প্রথম আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি, তারপর ধীরেধীরে তার পায়ের সঞ্চার বাড়ল। মাঝেমাঝে যে ফিরেও আসতো না, এমনটা নয়। দু-একদিন কাটিয়েই হঠাৎ কোন এক সাত সকালে অথবা সন্ধে হবো হবো সময়ে সে এসে দাঁড়াতো বাড়ির ফটকের কাছে।একবার তো আবার মেজমামি দু-কথা শোনানোতে আবার দু দিনের জন্যে দিয়েছিল ডুব।সেবার বাড়িতে খুব অশান্তি হয়। বাড়ির বড়জন মেজকে ডেকে বলে, এটা ঠিক হলো না। আমাদের বোন মারা গেছে। বোনের স্মৃতি বলতে আমাদের এই এক ভাগ্নে। তোর বৌ বেশি আস্পর্ধা পেয়ে গেছে। হতে পারে ভাগ্নে একটু পাগলা গোছের। তাই বলে সে তো আর চোর-ছ্যাঁচড় নয়, যে ভাগিয়ে দিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইথেকেই মামিরা একযোগে হিরণ্যের ব্যাপারে একেবারে স্পিকটি নট।
হিরণ্যের ব্যাপারে একজনই শুধু সারাদিন প্যানপ্যান করে।সেটা তার দিদা। সে তো করবেই। একটামাত্র মেয়ের দিকের নাতি।তায় আবার পাগলা গোছের। ডাক দেবার তো বিশেষ কেউ নেই।শুনুক না শুনুক, বাড়িতে থাকলে সারাটাক্ষন হিরণ্যকে সে চোখে চোখে রাখে। হিরণ্যকে চোখে চোখে রাখা এক বিরাট মাতব্বরের কাজ। অতো সোজা কাজ নয়। আর একটা কথা আছে না – যে যাবার সে যাবে।পাখিকে যতই ভালো খাওয়া দাওয়া দাও না কেন, সে শিকল ছিড়বেই।
হিরণ্য দিদার ভালবাসা টের পায়। এখন সে স্নেহ-মমতা বিষয়গুলো পড়তে পারে।দিদার প্রতি তারও যে একটা মৃদু টান আছে সেটা হিরণ্যের দিদা নাকি বুঝতে পারে। আর সেইজন্যেই হিরণ্যকে দু-দন্ড না দেখতে পেলেই তার দিদার চিল-চিৎকারে সারা বাড়ি, পাড়া মাথায় ওঠে।কাঁদতে কাঁদতেই সে মানুষকে জানান দেয়, হিরণ্য নাকি তার দিদাকে কোথায় যাবে সেইজায়গার নামও বলেছিল কিন্তু এখন সে ভুলে গেছে। সবাই শুনে বলে — আহা রে।
সেই হিরণ্য দু- তিনদিন নানা জায়গায় ঘুরেফিরে শেষে উঠে এসেছিল এই আশ্রমে। আশ্রমের আবাসিকরা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো বা চোর বা হারিয়ে যাওয়া ছেলে। প্রধান মহারাজ যখন তাকে ডেকে বাড়ির ঠিকানা জানতে চায়, হিরণ্য উত্তরে বলে ‘পৃথিবী’। বারবার একই কথা বলে। প্রধান মহারাজ অবাক হন আবার হেসেও ফেলেন। কিন্তু ওই যে বলে না সাধুসঙ্গ। আশ্রমের সবাই নিজেদের অন্তত সাধুই ভাবেন।আর ঠিক সেইকারণেই মহারাজ অন্য আবাসিকদের ডেকে বলেন – এই বালকটিকে সেবা দাও, বেলা গড়িয়েছে – অন্ন নয়, উহাকে ফলাহার করানো হোক।
এবারে এখানে দশ-বারোদিন টানা থেকেছে হিরণ্য। তাকে আশ্রমিকরা কতবার খোঁচা দিয়েছে তার ঠিকানা জানার – হিরণ্যের সপাট উত্তর – পৃথিবী। মহারাজ বরং হিরণ্যের জবাবে ফিলজফি খুঁজে পান।
আসল ব্যাপার হলো, গত দু- একদিন ধরেই হিরণ্যের মনে দিদার জন্য একটা কু জাগতে থাকে।কেন জানি তার মনে হতে থাকে, দিদা মারা গেল না তো। আর ব্যস্, এই ভাবনা মনে আসার পর থেকেই তার মনের চাকা বাড়ির দিকে গড়াতে থাকে। তার মনের মধ্যে এক ছটফটানি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সে বাড়ি ফিরবে কী উপায়ে? বাড়িতে ফিরতে গেলে দু-চার পয়সা হাতে থাকা দরকার। সেসব সে পাবে কোথা থেকে? এখানে খাওয়াদাওয়া মুফত কিন্তু হাতে কানাকড়িও তার নেই। তবু সে পিছিয়ে থাকার মানুষ নয়। হিরণ্য মনে করে, আসতে যখন পেরেছি, যেতেও পারবো। কিন্তু তাকে ফিরতে গেলে আগে তাকে ফিরতে হবে ঠিক আগের জায়গায়, সেখান থেকে যদি তার আগে অন্যকোন জায়গা থেকে থাকে সেখানে যেতে হবে। এইভাবে ব্যাকমেমোরির মত অঙ্ক কষে কষে পৌঁছে যাবে সে বাড়ি। কিন্তু আশ্রমে আসার আগের শেষ জায়গাটায় তার ফেরবার ইচ্ছে নেই। সেইজায়গাটা তাদেরই কোন আত্মীয়-বান্ধবদের। কিন্তু তারা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল তাকে তার মামাদের ডেকে।ব্যস্, বুঝতে পেরেই হিরণ্য দিয়েছিল চম্পট। ফলে সেই জায়গাটায়
ফেরা যাবে না।হিরণ্য ভাবে- যাকগে, সে দেখা যাবেখন।
বয়সের নিক্তিতে হিরণ্য কিছুটা বেপরোয়া গোছের তো বটেই এমনকী একটু বেশিই ডেঁপো। স্কুলের নিয়ম তার ভাল লাগতো না। একটা ঘরে অনেককে বসিয়ে রাখা তার না- পসন্দ। সে কারো নিয়ম মানতে পারবে না। দু বছর পরপর ফেল করার পরেই স্কুলের টিচাররাও ঠিক করলো, এটাকে এবারে ভাগাও।
ভাগাবার খবরটায় খুব আনন্দ পেয়েছিল হিরণ্য। এবার সে বাড়ি থেকেও পালাতে পারবে । মোদ্দা কথা, তার মামারাও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। আর কত ভাববে। বারো বছর পার হয়ে যাওয়া ছেলের মাথায় যদি কিছু না ঢোকে তাহলে কী করার। ব্যস্, হিরণ্য ভাবল – এবারে সে স্বাধীন।
সেই হিরণ্য এবার দিদার কারণে আশ্রম থেকে পালাবে। আশ্রমে বললে পরে আশ্রম থেকেই তার যাবার ব্যবস্থা করতে পারে।কিন্তু হিরণ্য তো বলে যাবে না। তাহলে তার মানহানি হবে।
মন বেড়িমুক্ত হতে চাওয়ায় হিরণ্য বারেবারে কথা না কথায় বলতে লাগলো, পৃথিবীর কাছে যেতে হবে, যেতেই হবে।মহারাজকে শুনিয়েই সে বলতে থাকে।শুনতে পেয়ে মহারাজ কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন হিরণ্যকে বাড়ি ফিরতে চায় কীনা। হিরণ্য বললে না, সে পৃথিবীতে যাবে। মহারাজ হেসে বলে – এখন তাহলে কোথায় আছো? এটাও তো পৃথিবী। হিরণ্য চুপ করে থাকে।
পরদিন দুপুর থেকেই হিরণ্যকে পাওয়া গেল না আশ্রমে।মহারাজ খোঁজার নির্দেশ দিলে আশ্রমিকরা দায়সারাভাবে কাজ সারে।তারা বুঝে গিয়েছিল, পাখি উড়ে গেছে। সবাই বলাবলি করলো – পাগলটা গেছে। মহারাজ শুধু হাই তুলে বললেন- কেন যে আসা, আর কেনই বা যাওয়া; কে জানাবে তার উত্তর,জানা নেই, জানা নেই।
হিরণ্য এসে পড়েছে বাড়ির কাছাকাছি। তার মন এখন দু নৌকায়।একদিকে দিদার কাছে আসা। অন্যদিকে দিদার জন্যে দুঃখ। কেন যে মনের ভেতর খালি কু গায়। বাড়ির কাছাকাছি হতেই পাড়াপড়শি তাকে দেখেই জাপটে ধরলো। বেশ কয়েকজন মিলে তাকে মালকোঁচা মেরে তুলে নিল একটা অটোয়। হিরণ্য যত বলে – ছাড়ো আমায়, বাড়ি যাবো।তারা শুনতেই চায় না।বলে – চোপ, চোপ। আধ মিনিটের মধ্যেই গঙ্গার ধার। তারপরই শশ্মান। হিরণ্য তাকিয়েই বুঝে গেল দিদা নেই। তাকে হাত ধরে নিয়ে গেল এক মামি।
দিদা ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু হিরণ্যের মনে হল দিদা পালিয়েছে। একেবারে সঠিক সময়ে।হিরণ্যের এটাও মনে হল, দিদাই এখন একমাত্র বলতে পারে – তার ঠিকানা পৃথিবী। হিরণ্য নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এইপ্রথম সে টের পেল পালালে আপনজনদের কেমন লাগে। এইপ্রথম সে টের পেলো পালানো সহজ নয়। পালাতে জানতে হয়। ঠিক ঠিক পালাতে জানলে সবাই চিন্তায় ভ্রু কুঁচকায় না, ভ্রু যুগলের নিচে যে থাকে সেখানে আপনা থেকেই গঙ্গা প্রবাহিত হয়।