ছোটদের জন্যে বড়দের লেখা ছোটগল্পে সুপ্রিয় চক্রবর্তী

পাহাড়ি আতঙ্ক

পেডং কালিম্পঙে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। অনেক খুঁজে এই গ্রামের কথা জানতে পারলাম। পঞ্জিকা মতে আজ মহাপঞ্চমী। এই পঞ্চমীকে কে বা করা মহা বানালো, তা জানা নেই। কাল সন্ধেবেলা এলাম, আলো কম থাকতে আশেপাশে কিছু দেখতে পেলাম না। কলকাতার কোলাহল থেকে কিছু দিন দূরে থাকবো বলে আজ এখানে আসা। এখান থেকে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় জিজ্ঞেস করতে, হোটেলের মালিক দেওয়ালে টাঙানো কালিম্পঙের ম্যাপ দেখালো, অজস্র গ্রাম আর সাথে একটি গির্জা, তিব্বতের বর্ডার আর ভিউ-পয়েন্ট। চোখ আটকালো একটি জায়গার নাম শুনে, দামসং ফোর্ট।
পেডংয়ের কাছে লেপচাদের দ্বারা 1679 খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ঐতিহাসিক দুর্গ দামসং ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এটি ভুটানের সাথে দীর্ঘকালীন বিরোধের কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীকালে, এটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। 1864 খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধের পরে দুর্গটি ক্ষয় হয়ে যায়। দামেস সাং দুর্গ (দামসং গাদি) পুরো দার্জিলিং জেলার একমাত্র দুর্গ। এটি সর্বশেষ লেপচা কিং- গ্যাবো আচুকের বাড়ি ছিল, লেপচারা এই জায়গার আদি অধিবাসী। প্রায় এক ঘন্টা হাঁটতে হবে এই জায়গায় পৌঁছতে। সন্ধে নামার আগে ফিরে আসতে হবে, কারন জায়গাটা নিরাপদ নয়।
হাটা শুরু করলাম, হাতে জল, নিচের গাড়িতে রাখা দুপুরের খাওয়ার আর মাঝে মাঝে পায়ে নিয়ম করে নুন ছিটানো। এক ঘন্টার একটু কম সময় লাগলো। পৌঁছে দেখি, এটাকে আর যাই বলি, দুর্গ বলা যাবে না। বাঙালিরা রাজস্থানের স্বপ্ন মুর্শিদাবাদে পূরণ করতে পারেন, আমাদের বাঙালি সেন্টিমেট সব থেকে প্রবল। আমার মনে হয়েছিল, ধ্বংস হলেও, কয়েকটা ঘর, নাট-মন্দির অথবা দাঁত-বের করা কিছু কামান থাকবে। কিচ্ছু নেই, আছে শুধু কয়েকটি কয়েকটি পাথর। নিরাশ হয়ে কিছুক্ষন বসলাম, দূরের পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা কালিম্পঙ রোদে ঝলমল করছে।
কিছুক্ষন পরে আশেপাশের জঙ্গলের মধ্যে থাকা কিছু জংলী ফুলের ছবি তুলতে শুরু করলাম।কয়েকটি জায়গায় রঙিন পতাকা পড়ে আছে, প্রতি বছর লেপচাদের মেলা হয় এখানে, সুতরাং এসব থাকাটা স্বাভাবিক। অন্যমনস্ক হওয়ার দরুন, কখন যে জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে চলে এসেছি খেয়াল নেই। শুধু দেখলাম, এই জায়গাতে আলো কম, মাথার উপরে একটি ক্যানোপি তৈরি হয়েছে প্রকৃতির দ্বারা। বেশ ঠান্ডা জায়গা, বসে পড়লাম একটি পাথরের উপর। আনমনে সিগারেট ধরাতে যাবো, এমন সময় কিছু এক হিস্ হিস্ আওয়াজ। সাপ থাকা অসম্ভব নয়। তবে আওয়াজটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে একটা সময় থেমে গেলো, তার মানে আপদ বিদায় হয়েছে। আবার ফোর্টের দিকে রওনা দিলাম। কিছুটা যেতেই আবার সেই শব্দ। এবার মনে হলো আমার পাশ থেকে শব্দটা চলে গেলো। আগে ভেবেছিলাম, জঙ্গলের ভিতরের অন্ধকার, ঘড়িতে দেখি এখন প্রায় বিকেল পাঁচটা, মানে কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্ধ্যে নামবে। পাহাড় আমাদের মতো তাড়াতাড়ি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে, সন্ধ্যে হয় তাড়াতাড়ি, ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে চোখের সামনে।
বেশ কিছুটা এগিয়ে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামতে লাগলো, রাস্তা ভুল করেছি। মোবাইল বের করে দেখলাম টাওয়ার নেই। কিছুটা এগিয়ে দেখলাম আমার ড্রাইভার দাঁড়িয়ে, আমাকে খুঁজতে এসেছে। ড্রাইভারকে হোটেল থেকে ফোন করেছে, আমাকে নিরাপদে না ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে, ওকে জবাবদিহি করতে হবে, সাথে পুলিশের ঝামেলা। বুঝলাম, হোটেলে পুরো টাকা অ্যাডভান্স না দিয়ে ভালোই করেছি।ড্রাইভারের সাথে টর্চ আছে, আমরা দ্রুত গতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড় থেকে নামতে অর্ধেক সময় লাগে। ড্রাইভার বললো – স্যার, আপনি এই রাস্তা দিতে নামতে থাকুন। আমি সামনে টর্চ নিয়ে যাচ্ছি।

রাস্তায় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে সাপের উপদ্রব আছে কি না। সেই আওয়াজের কথাও বললাম। সব শুনে বিজ্ঞের মতো বললো-থাকতে পারে স্যার, জঙ্গলে সাপ-হাতি-ঘোড়া তো থাকবেই। সাপের লজিকটা মানা যায়, কিন্তু এই জঙ্গলে হাতি আর ঘোড়া? হায় রে, বুদ্ধুজীবী একেই কয়।

আধঘন্টার মধ্যে নিচে নেমে এলাম, মনে হয় ড্রাইভার অন্য কোনো শর্ট-কাট দিয়ে নামিয়ে আনলো। যাক বাবা, বাঁচলাম। এবার একটা সিগারেট সহযোগে এক কাপ কফি খেয়ে, হোটেলে ফিরে যাবো। ড্রাইভারকে কফির ফ্লাস্কটা দিতে বললাম, আমি গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট বের করলাম। ভাবলাম শুনতে পারেনি, গাড়ির সামনের কাচ হাফ খোলা। ড্রাইভার সামনের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। সিগারেটটা ঠোঁট থেকে কোথায় পড়লো, অন্ধকারে খুঁজে পেলাম না। গাড়িতে ওঠার আগে কানের পাস থেকে শুধু একটা আওয়াজ পেলাম।..হিস্ হিস্ হিস্।….
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *