• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় শুভম দত্ত

রবি কে চিঠি

প্রিয় রবিবাবু,
তোমায় কি বলে সম্বোধন করব এটা ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় চলে গেল। আজ তোমায় আমি প্রথম চিঠি লিখছি। জানিনা কেন আমার মনের কথাগুলো তোমায় এই চিঠি লিখে না জানালে চলছেনা। তাই সবশেষে তোমায় চিঠি লিখতে বসলুম।
আমার জন্মের সময় তুমি যদি বেঁচে থাকতে তবে তোমার বয়স হত ১২৫। কিন্তু তুমি ছিলে না। কিন্তু সত্যিই কি ছিলে না? আমি তোমার থেকে অনেকককক….. ছোট। তোমায় সম্বোধন করতে হলে তোমার নামের পাশে দাদু কথাটা বলাই হয়তো শ্রেয়। কিন্তু আমি তোমায় দাদু বলতে পারলাম না। তোমার সাথে আমার যে আত্মার সম্পর্ক এসে উপস্থিত হয়েছে তাকে ঠিক দাদু নাতনির সম্পর্ক বলা যায় না। তবে এই সম্পর্কে কি নাম দেওয়া উচিত সেটাও ঠিক আমার বোধগম্য হলো না। তাই শেষমেষ ভেবে তোমায় ‘রবিবাবু’ বলেই সম্মোধন করলাম।
তোমার সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ করিয়েছিলো সেই ছোটবেলায় আমার মা। তোমার লেখা ছড়া, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তখনও তোমার মুখখানি চিনতাম না। তোমায় চিনেছি অনেক পরে। সে কথা না হয় পরে বলব। প্রথম প্রথম তোমায় অবশ্য রবিদাদুই বলতাম। প্রত্যেক দিন দুপুরে খাওয়ার পর মা তোমার একটা বই নিয়ে বসত আর আমায় রোজ গল্প শোনাতো। তখন তো আমি পড়তে শিখি নি তাই জানতাম না। পরে জেনেছি ওটা গল্পগুচ্ছ। আমি কল্পনা করে আমার সামনে সব দেখতে পেতাম। তুমি অমন করে কিভাবে লিখতে পারো আমায় বলবে?
প্রথম চিঠিতেই তোমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিতে চাইনা। তাই প্রথম পত্র খুব বেশী দীর্ঘায়িত করলাম না। পরের চিঠিতে তোমায় অল্প অল্প আরো কিছু জানাবো। তুমি আমার চিঠি পড়ে একটু ভাবো। তোমার নতুন এক পাঠিকার চিঠি তুমি পাচ্ছো। একটু তো তোমায় ভাবতেই হবে।
তোমার এক
মুগ্ধ পাঠিকা।
প্রিয় রবি বাবু,
অনেকদিন পর তোমায় আবার চিঠি লিখছি। আচ্ছা আমার প্রথম চিঠি পড়ে কেমন লাগলো তোমার? পুরেছে মন দিয়ে অনেক চিঠির ভিড়ে আমার চিঠি টা ফেলে রেখেছো? না. . না… তুমি চিঠি ফেলে রাখবে না। তোমায় আমি জানি। তুমি পড়েছ আমার চিঠিটা আর পড়ে খুব দ্বন্দ্বে পড়ে গেছো তাইতো।
তোমার দ্বন্দ্ব আমি এক্ষুনি মেটাতে পারছিনা। একটু অচেনা থেকে তোমার কাছে থাকতে চাই। অচেনা থেকে চেনা হয়ে গেলেই সব রহস্য শেষ হয়ে যায়। তাই সেই রহস্য এক্ষুনি শেষ করার ইচ্ছে হচ্ছে না।
আজ তোমায় বলবো হঠাৎ আজই কেন তোমায় চিঠি লিখছি। সকালবেলা আমার আলমারির তাক তাক গুছাতে গিয়ে একটা ছবি পেলাম। ছবিটা আমার স্কুল জীবনের। আমার সেই প্রথম স্টেজে উঠে কবিতা বলা। ছবিটা বাবা তুলেছিল। তোমার লেখা কবিতাই বলেছিলাম। সেই যে তুমি লিখেছিলে ‘প্রশ্ন’ কবিতাটা, ওটাই।
মাগো আমায় ছুটি দিতে বল
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা
. . . . . . . .
লাইনগুলো আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। কবিতাটা মুখে বলতে বলতেই তোমায় চিঠিটা লিখছি।
আচ্ছা তুমি আমাদের মনের মতো করে তোমার লেখাগুলো কিভাবে লিখতে বলতো? তুমি যখন ছোট ছিলে তোমায় তোমার মা জোর করে পড়াশোনা করাতো? যদি বলো হ্যাঁ তাহলে বলব আমার মা খুব ভালো। আমায় একদমই বকে না।
আমার এই চিঠিতেও আমার পরিচয়টা তোমায় দিলাম না। ওফফ. . . খুব কি বিরক্ত হচ্ছো? নাকি নামহীন অজানা পাঠিকার চিঠি পেয়ে তুমি রোমাঞ্চিত বোধ করছ? খুব জানতে ইচ্ছে করছে। লেখার ভার আর সইছে না। আজ এইটুকুই।
তোমার নতুন
অজানা পাঠিকা
প্রিয় রবিবাবু,
আগের দুটো চিঠি পড়ে তোমার কি কৌতুহল হচ্ছে আমার নাম জানার। আচ্ছা এই চিঠিতেই বলবো আমার নাম।
যাই হোক আজ তো তোমাকে চিঠি লিখতে কি হতো। আজ যে তোমার জন্মদিন। তুমি জন্মদিনে কেমন ভাবে কাটাতে ভালোবাসো? নিশ্চয়ই অনেক গান আর কবিতা লিখে? স্কুল-কলেজে এখনো তোমার জন্মদিনে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। আমি নিজেও কতবার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি তুমি জানো! আজ সকাল থেকে কিছুটা তোমার লেখা পড়েই সময় কাটালাম। সঞ্চয়িতার কবিতা পড়ছিলাম, ঠিক যেমন করে স্কুলজীবনে কাটত ঠিক তেমন।
আচ্ছা এই যে প্রত্যেক বছর আমরা তোমাকে স্মরণ করি তোমার কেমন লাগে। তুমি আমাদের সবার মধ্যেখানে বসে গল্প শোনানোকে মিস করো? কিন্তু তোমায় একটা কথা বলি, কথা না ঠিক অভিযোগ। তুমি এত কম ছবি এঁকেছো কেন? তোমার গানের যে সম্ভার তেমন ছবি ও তো আঁকতে পারতে নাকি? না হয় লেখাটা কিছু কম লিখতে।
আচ্ছা তোমায় বলেছিলাম আমার নাম জানাবো। আমার নাম অনুরিমা। তুমি আমাকে কি বলে ডাকবে? সোনা দিদি, নাকি অনু দিদি। না না…… এমন দিদি বলে ডেকো না বরং শুধু অনু বলো। তোমার অত বড় বড় পাকা দাড়ি গোঁফের মাঝে তোমার হাসিটা বড্ড ভালো লাগে আমার। আজ আর কিছু বলব না। তোমার গান শুনে দিন কাটাবো।
তোমার ছোট্ট
অনু।
প্রিয় রবিবাবু,
আগের চিঠিটা তোমায় লিখেছিলাম তোমার জন্মদিনে। তোমার জন্মদিনের আনন্দটা তোমার সাথে ভাগ করে নিতে। কিন্তু আজ তোমায় চিঠি লিখছি আমার দুঃখ গুলোকে ভাগ করে নেব। আমার মনের দুঃখ কে তুমি ছাড়া আর কেউ তেমনভাবে বুঝবে না।
আজ আমার মায়ের মৃত্যু দিন। সেই দিনটা আমার আজও মনে আছে। আষাঢ়ের প্রথম বর্ষা সেদিন ঝরে পড়েছে আকাশের ঘন কালো মেঘের থেকে। তারই মধ্যে দুপুরের শেষভাগে গাড়িটা এসে থামল। চির নিদ্রায় শায়িত মায়ের হাত দুটো স্পর্শ করে বুকটা তীব্র যন্ত্রণায় ভেঙে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একছুট্টে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ কোথাও নেই। কোন কোলাহল নেই শুধু নিঃশব্দতা থাকবে। তোমার ‘রূপনারানের কুলে’ কবিতাটা আগে অনেকবার পড়েছি কিন্তু উপলব্ধি বোধহয় ঠিক এই সময় করলাম। মা আবৃত্তি কন্ঠে যেন বলে উঠেছিল
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আচ্ছা খুবই কিভাবে তুমি এত মৃত্যু দেখেও বারবার নিশ্চল থেকেছ বলতে পারো? তুমিতো জীবনে বারবার স্বজনহারা হয়েছ। বারবার তোমার চোখের সামনে তোমার মনের আপন মানুষগুলো পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে। তোমার কি দুঃখ হয়নি? তোমার কি যন্ত্রণায় বুক ভেঙে যায় নি? তোমার চোখে কি জল আসেনি? কিন্তু সেই যন্ত্রণাকে বুকে করে বার বার নিজের সৃষ্টিকে আরও আরও গভীরতা নিয়ে গেছো। কিভাবে? আমরা তোমাকে তোমার সৃষ্টির জন্য বারবার স্মরণ করি কিন্তু তোমার অন্তরের কঠিন যন্ত্রণাগুলো, সেগুলি তো আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা কি সত্যিই তোমায় বুঝতে পেরেছি।
চোখের জল আর বাঁধ মানছে না। তোমাকে সামনে পেলে বলতাম আমায় গান শোনাতে। কিন্তু সেটি তো আর হবার নয়। তাই গীতবিতানেই নিজেকে অন্তর্হিত করলাম। ভালো থেকো।
তোমার অনু
প্রিয় রবিবাবু,
আজ অনেকদিন পর আবার তোমায় চিঠি লিখছি। তুমি কেমন আছো? আমি তোমায় না দেখতে পেলেও তুমি তো আমায় দেখতে পাও তাই না? কিন্তু আমার অন্তরটা তোমার চোখে পড়ে কি? জানি না হয়তো পরে কিন্তু তুমি আমায় বুঝতে দাওনা।
জানো আমার জীবন থেকে মা চলে যাবার পর তোমার অনেক গুরুত্ব ছিল। তোমার কবিতাগুলো বারবার পড়ে পড়ে জীবনকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। জানিনা সত্যি কতটা বুঝতে পেরেছি। তোমার মত জীবন দর্শন আমার নেই।
আমি ভেবেছিলুম আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। মা চলে যাওয়ার অনেক বছর পরে আমার জীবনেও ভালোবাসা এলো। তোমার মুখ গোমড়া হচ্ছে বোধহয়। না তোমার জায়গাটা আমার কাছে অনন্য। ওই জায়গাটা কেউ নিতে পারবে না কোনোদিনই। কিন্তু একটা মানুষ আমার জীবনে এলো। সেও তোমার হাত ধরে। আমি তখন কলেজ পেরিয়ে সবে কিছুদিন পরে একটা অনুষ্ঠানে তোমার কবিতায় আবৃত্তি করছি। কিন্তু সেই কবিতার মাঝে একজন তোমার গান করছিলো। অমন সুন্দর দরদী গলা আমায় মুগ্ধ করেছিল। বন্ধুত্ব, প্রেম আর শুভ পরিণয় হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এই যে বন্ধনে বাঁধা পড়ে আমি ভেবেছিলুম একটা অন্য জীবন পাব কিন্তু হলো না জানো। তিন বছর পর আমি একা হয়ে ফিরে এলাম। তখন আমি সম্পূর্ণ একা।
বিয়ের প্রথম দুই বছর ভালোই কেটেছিল। অনেক ভালোবাসা পেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ সব বদলে গেল, কেন? বলছি শোনো, আমার গর্ভে এক মৃত কন্যা সন্তান জন্ম নিল বলে। ওই বাড়ির সব আত্মীয়-স্বজন আমায় কেমন নিচু নজরে দেখতে শুরু করলো। তাও চলে গেছিল কিন্তু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না যখন আমার ভালোবাসার মানুষটা ও আমায় অবহেলা শুরু করলো। আমার সাথে কোথাও যাওয়া তো দূরস্থান আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। তোমার লেখা সেই ‘স্ত্রীর পত্র’- এর মৃণাল কে মনে পড়ে গেল। মৃণালের তো বিন্দু ছিল আমার তাও কেউ ছিলনা।
আমি চলে এলাম। একা। আমার কেউ খোঁজ পর্যন্ত নিলে না। আমি ‘ফিরবো না’ বলে একটা পত্র লিখে এসেছিলুম হয়তো ওই চিঠিতে ওরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আজ প্রায় বছর পার হতে গেল একবারও ওদের আমার কথা মনে হয়নি। মানুষেরা কেমন অদ্ভুত ভাবে পাল্টে যায়। কাছের মানুষগুলো কেমন ভাবে পর হয়ে যায়। আজও আমার কাছে তুমিই সব। তাই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তোমার কাছে সঁপে দিয়েছি বলতে পারো। আমার রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, প্রেম, দুঃখ, আনন্দ সবটাই এখন তুমি।
ইতি
তোমার অনু
প্রিয় রবি বাবু,
বেশ কিছুদিন ধরেই তোমায় বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছি। নিজের সবটুকু তোমায় খুব সংক্ষেপে জানিয়েছি। এ ছাড়া আর কাকে জানাতুম বলো? আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। টুকু নিয়ে এতদিন বেঁচে আছি সেটা তো তুমি।
একটা কথা তোমায় বলছি, আর কাউকে বললে হয়তো কেউ বিশ্বাসই করবে না। আমি মাঝে মাঝেই নিস্তব্ধ রাত্রির অন্ধকারে একটা ডাক শুনতে পাই। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি। এখন সেই ডাক এর মানে বুঝি মৃতজন্মা মেয়ের ডাক। জানো আমি ওর মুখ দেখিনি তাও একটা মুখ আমার মনের সাথে বারবার লুকোচুরি খেলে। আমায় বারবার কাছে আসতে বলে।
আজ বাইশে শ্রাবণ। আমাদের সকলের থেকে তোমার বিদায়ের দিন। কিন্তু সত্যি কি তুমি বিদায় নিতে পারলে? তোমার লেখা কবিতা, গান, গল্প সবকিছু দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আমাদের বেঁধে দিলে তোমার সাথে। তাই তোমার তো মরণ নেই। কিন্তু আমার তো মানুষের মরণ আছে। আজি তোমায় শেষ চিঠি লিখছি হসপিটালের বেডে বসে। আর লিখতে পারবো না। আমার সামনের পৃথিবীতে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আর যতই ঝাপসা হচ্ছে ততই চারপাশটা বড্ড অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আর সেই ঘন অন্ধকারে আমার মেয়ের ডাক শুনতে পাচ্ছি। আরো দৃঢ় হচ্ছে ডাক। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। আমি আর কিছু সময়ের অতিথি।
জানো আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। কেন? আমার সাথে তোমার দেখা হবে তাই। বেঁচে থাকতে যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি মরে যাবার পর সেই স্বপ্ন সার্থকতা লাভ করবে।
তুমিতো রানুকে নিয়ে শেষের কবিতা লিখেছিলে। আমায় নিয়েও কিছু লিখো। সে লেখা শুধুই আমার হবে। সে লেখার অধিকার একমাত্র আমারই হবে। আর কিছু বলবো না। আজীবনের ছুটি নিয়ে তোমার কাছে আসছি। অপেক্ষা কোরো।
ইতি
অনু
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।