ছোটগল্পে সৌরভ দেবদাস

বাঁশির সুর

সময়টা ছিল আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের ঘটনা না, তখন ব্রিটিশদের অত্যাচার ক্রমশ বেড়ে চলছিল। মুর্শিদাবাদের একটা নাম না জানা গ্রামে রফিক ও অন্নপূর্ণা তখন অনেক ছোটো দুজনে একসাথে খেলা করত। মানে অন্নপূর্ণার বাবা নারায়ণ দাস, রাজা রামমোহন রায় কে আদর্শ মনে করতেন বলে জাতপাতের নিয়ম মানতেন না। এ ছাড়াও রফিক এর বাবা হাজী সাহেব ওনাকে খুব ভালো বাসতেন, কারণ রাতের খাবার সেরে দুজনে মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিতেন, তারপর দুজন বাড়ি যেতেন। সময় পেরিয়ে গেলো রফিক ও অন্নপূর্ণা ক্রমশ বড় হতে লাগলো দুজনের মধ্যে একটা আশ্চর্য ভাব দেখা দিতে লাগলো। তবে দুজনের মধ্যে কেউ সেটা বুঝতে পারলো না। তারা দুজন এ স্কুল এর ছুটি তে একসাথে বাড়ি যেতো, বিকেলে রফিক বাঁশি বাজাতো অন্নপূর্ণা
সেই সুরে গভীর ভাবে হারিয়ে যেতো, এই ভাবে তাদের মনে সুপ্ত প্রেমের জাগরণ ঘটতে শুরু করলো। তবে একদিন দেশে ঘোষণা হল দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু দেশ বিভক্ত হবে দু ভাগে, সেই র‍্যাডক্লিফ এর দাগ যে রফিক এর বাড়ি অন্নপূর্ণার কাছ থেকে দূরে করবে সেটা তারা জানত না। একদিন ব্রিটিশ আর্মির একটা জিপ আসলো তাদের দেশ বিভক্ত এর কথা জানালো তাদের সীমানা দেখিয়ে দিল, রফিক এর বাড়ির দিকে লোক দের বললো তাদের কে জায়গা ফাঁকা করতে কারণ ওদিকে দিয়ে বর্ডার এর সীমানা পড়েছে। তাদের একদিনের সময় দেওয়া হল। স্কুল থেকে ফিরে এসে যখন বাড়ি এসে দুজন এই খবর শুনল দুজনে হতবাক হয়ে গেলো, অন্নপূর্ণা চোখে জল এলো, সে রফিক কে জড়িয়ে ধরলো। রফিক কিছুটা সামলে বললো, অন্নপূর্ণা সন্ধ্যায়
দেখা করিস ঠিক আছে, অন্নপূর্ণা চোখের জল মুছে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তারপর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। রফিক ছাদে উঠে গেলো দেখলো অন্নপূর্ণা আগে দাঁড়িয়ে আছে রফিক চারপাশ দেখলো তারপর অন্নপূর্ণার কাছে গেলো তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
অন্নপূর্ণা: কিরে কাল তাহলে চলে যাবি আমাদের ছেড়ে।
রফিক: হ্যাঁ, আর তো কিছুই করার নেই বল। যেতে তো হবেই।
অন্নপূর্ণা: জিনিস পত্র সব রেডি তো, দেখিস কিছু ছাড়া না পড়ে।
রফিক: আচ্ছা তোর খারাপ লাগছে না আমি চলে যাচ্ছি যে।
অন্নপূর্ণা: (মাথা নিচু করে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর বললো) কই না তো?
রফিক: (বুঝতে পারলো মেয়েটার বড্ড অভিমান হয়েছে, কিন্তু সে তো নিরুপায় কারণ সে তার জন্য কিছুই করতে পারবে না। কিছুটা চুপ হয়ে বললো) ওই বাঁশি বাজাতে পারি।
অন্নপূর্ণা: নীরবে তাকিয়ে সে বললো কালকে কখন যাবি তুই?
রফিক: সকালে রে কেনো?
অন্নপূর্ণা: এমনি তুই বলে বাঁশি বাজাবি কই বাজা।
রফিক তারপর বাঁশি বাজাতে শুরু করলো অন্নপূর্ণা তার কান্না চেপে রাখতে পারলো না হুর হুর করে কেঁদে ফেললো।কান্না শুনে রফিক বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দিলো, অন্নপূর্ণা কে জড়িয়ে ধরলো।
অন্নপূর্ণা: তুই আমাকে ছেড়ে যাস নারে থেকে যা নারে।
রফিক: সেটা অসম্ভব রে। আমারো তোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু কি করব বল।
অন্নপূর্ণা: তুই কি আমাকে ভালোবাসিস? দেখ তোকে আমি খুব ভালোবাসি সেই ছোট্ট বেলা থেকে।
রফিক: আমিও তোকে ভালোবাসি খুবই।
অন্নপূর্ণা: আচ্ছা আমাদের আর দেখা হবেনা, তোর বাঁশি শুনতে পাবো না।
রফিক: দেখা না হোক কিন্তু বাঁশি রোজ শুনতে পাবি।
অন্নপূর্ণা: কিছুটা আনন্দে সে বলে উঠলো কেমন করে?
রফিক: আমি রোজ সন্ধ্যা বেলায় ওপারে বাঁশি বাজাব তুই ছাদে উঠে বসবি।
রফিক: পরের দিন চলে গেলো যাওয়ার সময় অন্নপূর্ণার বাড়ির ছাদে তাকিয়ে থাকলো কিন্তু তার দেখা পেলো না। এই দিকে অন্নপূর্ণা লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখছিল।
সপ্তাহ দুই অর্থাৎ দেশ স্বাধীনের কিছু দিন পরে,
অন্নপূর্ণা ছাদে বসে আছেন রফিক এর বাঁশির আওয়াজ শুনতে পেলো এই ভাবে দিনের পর দিন সে বাঁশির সুর শুনতে পেতো আর নীরবে চোখের জল ফেলতো।
অনেক বছর পর (রফিক এর সাথে সম্পর্ক এর কথা জানা জানি হওয়ার তার কোথাও বিয়ে হয়নি।) রফিক এর বাঁশির সুর জেনো থেমে গেলো, বুঝতে দেরি হলো না অন্নপূর্ণার, সে আর নেই। কয়েক দিন বাদে অন্নপূর্ণাও মারা গেলো।
একদিন প্রচণ্ড বর্ষায় বন্যা হল, ওই পারে থেকে এই পারে দুই দিকে জল এ ভরে গেলো। অনেক বাড়ি ঘর ডুবে গেলো। অনেক প্রাণ হানি ঘটল, মজার ব্যাপার টা হল অন্নপূর্ণার অস্থিটা সেদিন ভেসে গিয়েছিল। ভাসতে ভাসতে রফিক এর কবরে আটকে পড়ে।
দেশ তাদের আলাদা করলেও প্রকৃতি তাদের এক করে দেয়। এই ভাবেই তাদের ভালোবাসা স্বার্থকতা পায়…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *